নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়া গ্রামের সাহাপাড়ার পরিবেশ ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। সেখানে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ভাঙচুর হওয়া মন্দির ও আগুনে পোড়া ঘর মেরামত করা হয়েছে। প্রাণ ফিরে পেয়েছে দিঘলিয়া বাজার। এলাকায় পুলিশ নিয়মিত টহল দিচ্ছে।
প্রায় প্রতিদিনই রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা সাহাপাড়ায় যাচ্ছেন। নিজেদের স্বাভাবিক যোগাযোগ ও কর্মচাঞ্চল্য ফিরে পেয়েছে পাড়ার নারী-পুরুষেরা।
ইসলাম ধর্মের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে কটূক্তি করে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার একটি অভিযোগকে কেন্দ্র করে ১৫ জুলাই সন্ধ্যার পর দিঘলিয়ার সাহাপাড়ার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর ও দোকানপাটে হামলা হয়। এ সময় ভাঙচুর করা হয় চারটি মন্দির, পাঁচটি দোকান, একটি বসতঘর এবং একটি বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। হামলার পর সেদিন সন্ধ্যায় আতঙ্কে বাড়ি ছাড়ে ওই পাড়ার বাসিন্দারা।।
গত সোমবার বিকেলে সাহাপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, পাড়ার নারী-পুরুষেরা অনেকটা স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরেছে। একে অন্যের বাড়িতে যাচ্ছে। খোঁজখবর নিচ্ছে একে অপরের। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত দিপালী সাহার বাড়ির ঘরটি নতুন টিন দিয়ে মেরামত করা হয়েছে। মেরামত করা হয়েছে ভাঙচুর হওয়া আখড়াবাড়ি মন্দিরও। ঘটনার পর দিঘলিয়া বাজারের দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। দুদিন পর থেকে তা-ও খুলতে শুরু করে। বর্তমানে প্রাণ ফিরে পেয়েছে বাজারটি। লোকজন যাচ্ছে আগের মতোই।
সাহাপাড়ার বাসিন্দা দিপালী সাহার (৬০) বাড়িতে দেয়ালঘেরা টিনের চালার দুটি বসতঘর। দিপালী সাহার ছেলে গোবিন্দ সাহা দিঘলিয়া বাজারের ফুটপাতে পান বিক্রেতা। হামলার দিন দরিদ্র ওই পরিবারের একটি ঘরের মালামাল ও টিনের চালা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় । ঘরটি নতুন টিন দিয়ে সরকারি অর্থায়নে মেরামত হয়েছে।
দিপালী সাহা বলেন, ‘ঘরটির চালা নতুন হয়েছে, কিন্তু ঘরের মালামাল তো সব পুড়ে গেছে সেদিন। তবে এখন ভয় লাগছে না, মনে সাহস আসছে।’
পাড়ার বাসিন্দা ডলি সাহা বলেন, পাড়ার নারী-পুরুষ সবাই বাড়িতে এসেছে। প্রতিদিনই বড় বড় লোকজন আসছেন। পুলিশ ও প্রশাসন টহল দিচ্ছে। এখন সমস্যা মনে হচ্ছে না।
তিনি বলেন, ‘আমরা দান চাই না। ভালোভাবে থাকতে চাই। আগের মতো মিলেমিশে শান্তিতে থাকতে চাই। যা ঘটার ঘটেছে। এখন সবাই যেন ভালো থাকতে পারি, আগের মতো চলাফেরা করতে পারি, শুধু এটুকুই চাওয়া।
সাহাপাড়ার রাধাগোবিন্দ মন্দিরের সভাপতি ও পাড়ার মাতবর শিবনাথ সাহা বলেন হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত দুটি বাড়ি, চারটি মন্দির ও পাঁচটি দোকানের তালিকা প্রশাসনকে দিয়েছেন তারা। বিভিন্ন ব্যক্তি, সংগঠন ও সরকার থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। দিঘলিয়া বাজারটি আগের মতো প্রাণ ফিরে পেয়েছে। আতঙ্ক কেটেছে সাহাপাড়ায়। পুলিশ দিনরাত টহল দিচ্ছে। পাশাপাশি লোহাগড়ার ইউএনও প্রতিদিনই এলাকায় আসছেন।
এদিকে গত রোববার রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত ব্র্যাক সেন্টার ইনে এক সভায় শিবনাথ সাহার ছেলে হ্যামলেট সাহা ওই রাতের নির্মমতার কথা তুলে ধরেন। এ সময় তিনি হামলাকারীদের বিরুদ্ধে পাড়ার সব ঘরে ঘরে চাঁদাবাজির অভিযোগ করেন। হ্যামলেট বলেন, ‘আমরা যখন অশোক সাহাকে পুলিশের কাছে দিলাম, যখন তাঁকে নিয়ে পুলিশ চলে যাচ্ছে। ঠিক সেই মুহূর্তে ৫০০-৬০০ জন, যাদের অনেককে চিনি, অনেককে চিনি না। এ পাড়ায় আমরা ১০৮ ঘর সাহা থাকি। তারা আমাদের পাড়ার ভেতরে প্রতিটি বাড়িতে ১০-১২ জন করে ঢুকে গেল। প্রতিটি বাড়ির দরজায় তারা কড়া নেড়ে বলেছে, “টাকা দে, না হলে ঘরবাড়ি ভেঙে দেব, পুড়িয়ে ফেলব, তোদের মেরে ফেলব।” যাঁদের কাছে টাকা ছিল, তাঁরা টাকা দিতে পেরেছেন। তাদের ঘরবাড়ি ভাঙেনি। আর যে বাড়ির লোকজন আগে থেকে পালিয়ে গেছে, সেসব বাড়ি ভেঙেচুরে এবং একটি বাড়িতে তো আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।’
তবে এ অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন হ্যামলেটের বাবা শিবনাথ সাহা। তিনি বলেন, ‘বাড়িতে বাড়িতে যে চাঁদাবাজির কথা শোনা যাচ্ছে, তার কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। হামলা হয়নি আমার বাড়িতে। ঘটনার দিন বিকেলে ১৫০-২০০ বিক্ষুব্ধ মানুষ আমার বাড়িতে এসে অভিযুক্ত তরুণের বিচার দাবি করে। আমি বিচার দিতে চাইলে তাঁরা তখন ফিরে যায়। তাঁরা আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেনি।