সাতক্ষীরা পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পরাজয় নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। দলের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে চায়ের আড্ডায় বসে সাধারণ মানুষের মধ্যে এনিয়ে আগ্রহের কমতি নেই। বিশেষ করে ১৪ ফেব্রুয়ারি চতুর্থ ধাপের নির্বাচনে সারাদেশের ৫৫টি পৌরসভার মধ্যে একমাত্র সাতক্ষীরা পৌরসভায় বিএনপির প্রার্থী জয়লাভ করেছে। আর আওয়ামীগের নেীকা প্রতীকের প্রার্থীর এনিয়ে টানা দ্বিতীয়বার পরাজয়।
গত রোববার (১৪ ফেব্রুয়ারি) অনুষ্ঠিত সাতক্ষীরা পৌরসভার নির্বাচনে জেলা বিএনপি’র সাবেক সাংগঠণিক সম্পাদক তাজকিন আহমেদ চিশতি ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে ২৫ হাজার ৮৮ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী নাসিম ফারুক খাঁন মিঠু পেয়েছেন ১৩ হাজার ২২১ ভোট। অপরদিকে ১৩ হাজার ৫০ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী শেখ নাসিরুল হক। জেলা জামায়াতের সাবেক সেক্রেটারী নুরুল হুদা পেয়েছেন ২৮৮৮ ভোট ও ইসলামিক শাসনতন্ত্র আন্দোলনের আব্দুর রউফ পেয়েছেন ১৬৭৯ ভোট। মোট ভোটার ৮৯ হাজার ২২৪। নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৫৫ হাজার ৯২৬ টি।
এদিকে নির্বাচনে আ’লী প্রার্থীর পরাজয়ের কারন হিসাবে দলের তৃণমূল পর্যায় সাংগঠনিক দূর্বলতা, নেতৃত্বের সঙ্কটসহ আওয়ামী লীগ মনোনীত কাউন্সিলর প্রার্থীরা প্রতিপক্ষ মেয়র প্রার্থীর কাছ থেকে সুযোগ সুবিধা নেয়াসহ নানা বিষয়ে আলোচিত হচ্ছে। কাউন্সিলর প্রার্থীরা নিজেদের ভোট চাওয়া ছাড়া দলীয় মেয়র প্রার্থীর জন্য কিছুই করেন নি। এমনকি আওয়ামী লীগের একাধিক কাউন্সিলর প্রার্থীর কর্মীরা প্রকাশ্যে ধানের শীষ অথবা নারিকেল গাছের ব্যাজ বুকে লাগিয়ে ভোট কেন্দ্রের আশে পাশে অবস্থান করেছে। এছাড়া আওয়ামী লীগের এক নেতা মুখে নৌকার কথা বললেও প্রশাসনের উপর প্রভাব সৃষ্টি করে নিরপেক্ষ ভোটের নামে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কর্মী সমর্থকদের কোনঠাসা করার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেন বলে বিভিন্ন মহলে গুঞ্জন রয়েছে।
জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক শেখ হারুণ অর রশিদ জানান, ২০০৫ সাল থেকে সাতক্ষীরা পৌরসভার ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে আ’লীগের কোন কমিটি নেই। ফলে এখানে দলের সাংগঠনিক ভিত্তি খুবই দুর্বল। এছাড়া আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বিগত দিনে সাতক্ষীরা পৌরসভার উন্নয়নে পাহাড় পরিমান ব্যর্থতার চিত্র ভোটারদের সামনে তুলে ধরতে পারেন নি। পৌরসভার দোকান উচ্ছেদের বিষয়ে আমরা কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি। তিনি আরও বলেন, সাতক্ষীরা পৌরসভায় হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ভোটার আছে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার। তাদেরকে অনেকে আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাঙ্ক হিসেবে চিহ্নিত করলেও প্রকৃত পক্ষে তাদের অনেকেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থীরা অনেকেই প্রতিপক্ষ প্রার্থীর কাছ থেকে সুযোগ সুবিধা নিয়ে দলের মেয়র প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করেছেন বলেও সমালোচনা করেন তিনি।
শেখ হারুণ আরও বলেন, দলীয় নেতা কর্মীদের সমন্বয়হীনতা, চারদলীয় ভোট ব্যাংকে আঘাত হানতে ব্যর্থ হওয়া, জামায়াত ও বিএনপি উভয়দলের প্রার্থী থাকার পরও দু’দিন আগে তাদের মধ্যে সমঝোতা হওয়া, নির্বাচনে কালো টাকার প্রভাব ও জেলা আ’লীগের সভাপতি মুনসুর আহমেদ এর মৃত্যুর কারণে দলীয় নেতাকর্মীরা তাৎক্ষণিক ভেঙ্গে পড়া ইত্যাদি সাতক্ষীরা পৌরসভায় আ’লীগ মনোনীত প্রার্থী শেখ নাসেরুল হকের পরাজয়ের অন্যতম কারণ।
আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পরাজয় সম্পর্কে জানতে চাইলে তৃণমূল পর্যায়ের কর্মী মাঠপাড়ার আসাদুল ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের অধিকাংশই নৌকার সঙ্গে তাকে ভোট দেওয়ার কথা না বলে মেয়রের ভোট যাকে পারবেন তাকে দেবেন, অন্তত: কাউন্সিলর প্রাথী হিসেবে তাকে ভোটটি দেওয়ার জন্য ভোটারদের কাছে অনুরোধ করেছেন।
নৌকার পক্ষে সক্রিয় কর্মী হিসেবে লস্করপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কাজ করা রবিউল ইসলাম বলেন, কোন বাঁধা ছাড়াই ভোট হচ্ছে এমন খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে বিএনপি জামায়াত কর্মীরা বাড়ি বাড়ি যেয়ে ভ্যানে ও ইজিবাইকে ভোটার নিয়ে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। ফলে তাদের ভোট বেড়েছে।
বিশিষ্ঠ মানবাধিকার কর্মী মাধব চন্দ্র দত্ত মনে করেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের সঙ্কট, নৌকা প্রার্থীর তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে জনসম্পর্ক গড়ে না ওঠা, সর্বোপরি মৌলবাদি চেতনা মুক্তিযুদ্ধের ও প্রগতিশীল চেতনার বিরুদ্ধে এক জোট হয়ে কাজ করায় সাতক্ষীরা পৌরসভায় নৌকার পরাজয় হয়েছে।
সাতক্ষীরা পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও দলীয় প্রতীক নিয়ে মেয়র পদে পরাজিত শেখ নাসিরুল হক বলেন, সাতক্ষীরা আওয়ামী লীগের জামায়াত বিএনপি’র ভোট ব্যাংক ভাঙ্গার শক্তি নেই। ধানের শীষ ও নারিকেল গাছ প্রার্থীর অর্থনৈতিক অবস্থার কাছে তিনি প্রায় জিরো। তাছাড়া শেষ রাতেই জগ প্রতীকের প্রার্থী জামায়াত নেতা নুরুল হুদার সঙ্গে ধানের শীষের সমঝোতা হয়ে যায়। ফলে জামায়াতের ভোটের অধিকাংশই পড়ে ধানের শীষে। এছাড়া বাবার মতো অভিভাবকের দায়িত্ব পালনকারি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মুনসুর আহমেদের আকষ্মিক মৃত্যু ভোট বাক্সে প্রভাব ফেলেছে।
জেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা ফিরোজ কামাল শুভ্র বলেন, আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশের ভোট নারিকেল গাছ প্রতীকে পড়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের আত্মসন্তুষ্টিতে ভোগা ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে বসাবসি হলেও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হওয়ায় সাতক্ষীরা পৌরসভায় নৌকার পরাজয় হয়েছে।
জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান বাবু মনে করেন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুনসুর আহমেদের মৃত্যু পৌরভোটে প্রভাব না ফেললেও প্রশাসনের বৈরি আচরণ, দলীয় নেতা কর্মীদের সমন্বয়হীনতা ও আন্তরিকতার ঘাটতি নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছে।
বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সাতক্ষীরা জেলা শাখার সম্পাদক এড. ফাহিমুল হক কিসলু বলেন, সমন্বয়হীনতা, আন্তরিকতা ও দূরদর্শিতার অভাবের কারণে নৌকার পরাজয় হয়েছে। এছাড়া নেতা কর্মীদের আত্মসন্তুষ্টিতে ভোগার কারণে ও ভোটে কালো টাকার প্রভাব পড়ায় নৌকা প্রার্থীর পরাজয় হয়েছে।
জাতীয় পার্টির সাতক্ষীরা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আশরাফুজ্জামান আশু বলেন, সাতক্ষীরায় অধিকাংশ সময় এন্টি আওয়ামী লীগাররা ক্ষমতায় থেকেছে। আগে তারা ১৪ দলে থাকলেও এখন তারা বিরোধী দল। এরপরও সমন্বয়ের অভাবে আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীরা সংগঠিত হতে পারেনি। পুলিশের ভূমিকা নিরপেক্ষ ছিল দাবি করে তিনি বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির মৃত্যু একটা শূণ্যতা সৃষ্টি করেছে।
সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোঃ নজরুল ইসলাম বলেন, সাতক্ষীরা সদরে চার বার জামায়ত ও বিএনপি’র সাংসদ ছিল। এখানকার জনগণের একটি বড় অংশ ভারত থেকে মাইগ্রেটেড। ফলে তারা আওয়ামী লীগ বিরোধী। তারা জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য পার্টিতে ভোট দেয়। আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা যথেষ্ট ভালো প্রার্থী শেখ নাসিরুল হকের পক্ষে কাজ করলেও অনেকে কাউন্সিলর প্রার্থী হওয়ায় তারা নিজেদের ভোট করতে যেয়ে মেয়র প্রার্থীর জন্য কাজ করতে পারেননি। ফলে নৌকার পরাজয় হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালে সাতক্ষীরা পৌরসভা নির্বাচনে ভোটার ছিল ৭৯ হাজার ৬৩৪টি। ভোট পড়ে ৫১ হাজার ৬২০টি। বিএনপি মনোনীত ধানের শীষের প্রার্থী তাসকিন আহম্মেদ চিশতি ১৬ হাজার ৪৭০ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন। ওই নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী শেখ আজাহার হোসেন পেয়েছিলেন ১২ হাজার ৮৮৩ ভোট। যুবদল নেতা নাসিম ফারুক খান মিঠু পেয়েছিলেন ১২ হাজার ৫৩২ ভোট। সাতক্ষীরা পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাদাৎ হোসেন নৌকা প্রতীকে পেয়েছিলেন নয় হাজার ৭২ ভোট।
খুলনা গেজেট/কেএম