খুলনা, বাংলাদেশ | ১৪ বৈশাখ, ১৪৩১ | ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

Breaking News

  বাগেরহাটের রামপালে ট্রাকচাপায় নিহত ৩, আহত আরও ২ জন
  গাজা নীতির বিরোধিতা করে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের পদত্যাগ

সাতক্ষীরার বধ্যভূমি প্রভাবশালীদের দখলে, সংরক্ষণে নেই কার্যকর উদ্যোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক, সাতক্ষীরা

স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও সাতক্ষীরার অনেক গণকবর ও বধ্যভূমি আজও সংরক্ষণ করা হয়নি। নির্মাণ করা হয়নি কোনও স্মৃতিসৌধ। অযত্ন অবহেলায় পড়ে থাকা এসব বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো সরকারিভাবে সংরক্ষণ না করায় তা চলে গেছে প্রভাবশালীদের দখলে। বিশেষ করে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার একটি বধ্যভূমি গণকবরও সংরক্ষণে কোন কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তাই বধ্যভূমিগুলোর ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে রয়ে গেছে অস্পষ্ট।

এদিকে প্রায় এক যুগ আগে সাতক্ষীরা খুলনা রোডের মোড়ে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য একটি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। কিন্তু এখনও স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করা হয়নি। পরবর্তীতে ২০১৯ সালে মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থানসমূহ সংরক্ষণ ও মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি যাদুঘর নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় একই স্থানে ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা জন্য দরপত্র আহবান করা হয়। কিন্তু বারংবার চেষ্টা করেও চাহিদা মাফিক জায়গা না পাওয়ায় কার্যাদেশটি বাতিল করা হয়েছে বলে একটি সূত্রে জানা গেছে।

মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থানসমূহ সংরক্ষণ ও মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি যাদুঘর নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ২০১৮, ২০১৯ এবং ২০২০ সালে সাতক্ষীরা জেলায় ১৫টি স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা জন্য দরপত্র আহবান করা হয়। স্থানগুলো হলো-আশাশুরি উপজেলার কেয়ারগাতী, খাজরা ইউনিয়ন পরিষদের পাশে ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন সংলগ্ন স্থানে, দেবহাটা উপজেলা কুলিয়া ব্রিজের পাশে ও কেদার মাঠে, কালিগঞ্জের পিরোজপুরে ব্রিজের পাশে ও নলতায়, কলারোয়ার মমতাজ আহমেদ কমপ্লেক্সে ও বালিয়াডাঙ্গায়, সাতক্ষীরা সদরের খুলনা রোড মোড়ে ও ভোমরা বিজিবি ক্যাম্পের পাশে, শ্যামনগরের গোপালপুরে ও বিকে উচ্চ বিদ্যালয় খুটিকাটা পদ্মপুকুর, তালার পারকুমিরা ও হরিণখোলা-গোয়ালপোতায়। এরমধ্যে কলারোয়ার বালিয়াডাঙ্গায় স্তম্ভটি সাড়ে ৬৩ লাখ টাকা এবং শ্যামনগরের বিকে উচ্চ বিদ্যালয় খুটিকাটা পদ্মপুকুর স্তম্ভটি ৫৮ লাখ টাকা এবং বাকি স্তম্ভগুলো ৩৫ লাখ টাকা করে নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়।

এদিকে, দেবহাটা উপজেলার কুলিয়া ব্রিজের পাশে এবং সাতক্ষীরা সদর উপজেলার খুলনা রোড মোড়ের স্বম্ভটি নানা জটিলতায় কার্যাদেশ বাতিল করা হয়েছে বলে জানা গেছে। অপরদিকে দরপত্রের তিন বছর পার হলেও কাজ শেষ হয়নি সাতক্ষীরার ভোমরায় বিজিবি ক্যাম্পের পাশে স্তম্ভ, কলারোয়ার বালিয়াডাঙ্গায় স্তম্ভ এবং দেবহাটার কেদার মাঠের স্তম্ভটির। দরপত্রের তিন বছর পরেও কলারোয়ার বালিয়াডাঙ্গায় স্তম্ভটির কাজের অগ্রগতি শূন্য শতাংশ, ভোমরায় বিজিবি ক্যাম্পের পাশে স্তম্ভটির ৪০ শতাংশ এবং দেবহাটার কেদার মাঠের স্তম্ভটির ৬০ শতাংশ কাজ শেষের অগ্রগতি দেখানো হয়েছে গত নভেম্বর পর্যন্ত। তবে বাকি ১০টি স্তম্ভের কাজ শতভাগ শেষে হয়েছে বলে জানা গেছে।

সাতক্ষীরা শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকার মধ্যেই রয়েছে পাঁচটি গণকবর। জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আরও পাঁচটি বধ্যভূমি। হত্যাযজ্ঞের চিহ্ন হিসেবে স্বাধীনতার পর এসব বধ্যভূমি ও গণকবর থেকে শতশত মানুষের মাথার খুলি, হাড় ও কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়েছে।

বীর মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল খুলনা, বাগেরহাট, ৯৬ গ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ৬০০-৭০০ নির্যাতিত মানুষ ভারতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সাতক্ষীরা আসেন। প্রবল বৃষ্টির কারণে তারা বর্তমান সাতক্ষীরা সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেন। পরদিন সন্ধ্যায় হানাদার বাহিনী স্কুলের পেছনে দীনেশ কর্মকারের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তাদের নৃশংসভাবে হত্যা করে। তবে বর্তমানে ওই স্থানে বধ্যভূমির কোনও চিহ্ন নেই।

দীনেশ কর্মকার তার পৈত্রিক জমি বিক্রি করে ভারতে চলে গেছেন। বর্তমানে সরকারি বালক বিদ্যালয়ের পেছনে ছোট একটি ডোবা দেখিয়ে স্থানীয় লোকজন গণকবর ও বধ্যভূমির কথা শুনেছেন বলে জানান। এই পুকুর ও ডোবার অংশটুকু দখলদারদের হাতে চলে গেছে।

সাতক্ষীরা-কালিগঞ্জ সড়কের বাঁকাল ব্রিজ ছিল হানাদার বাহিনীর আরেকটি হত্যাযজ্ঞের স্থান। মুক্তিকামী বাঙালিদের গুলি করে অথবা জবাই করে ব্রিজের নিচে ফেলে দেওয়া হতো। এটিও বর্তমানে প্রভাবশালীদের দখলে।

সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ভাড়খালী-মাহমুদপুর স্কুলের পেছনের পুকুর থেকে স্বাধীনতার পর উদ্ধার করা হয় কয়েকশ’ মানুষের কঙ্কাল ও মাথার খুলি। সাতক্ষীরায় দ্বিতীয় বৃহৎ গণকবর ছিল এটি। তবে এখন এর কোনও অস্তিত্ব নেই।

সাতক্ষীরা সদরের ঝাউডাঙ্গায় স্বাধীনতা লাভের কয়েকদিন আগে ভারতে যাওয়ার পথে গুলি করে হত্যা করা হয় শতশত বাঙালি নারী, পুরুষ ও শিশু শরণার্থীকে। পরে তাদের গোবিন্দকাটি খালপাড় ও রূপালী ব্যাংকের পেছনে গণকবর দেওয়া হয়। এসব গণকবরের কোনও চিহ্ন এখন নেই। শহরের সুলতানপুর পালপাড়া খালের ধারে হত্যা করা হতো বাঙালিদের। এখানেই হত্যা করা হয় সুরেন, নরেন ও কেষ্টপদ নামের তিন মুক্তিকামী যুবককে। অন্যদিকে তালার জালালপুর, পাটকেলঘাটার পারকুমিরার বধ্যভূমিগুলোও চলে গেছে দখলে।

স্থানীয় যুদ্ধাহত ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের স্বজনরা অনেকেই দাবি জানান অবিলম্বে সাতক্ষীরার সব গণকবর ও বধ্যভূমি সংরক্ষণ করতে হবে।

খুলনা গেজেট/ এস আই

 




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!