খুলনা, বাংলাদেশ | ২৭ আশ্বিন, ১৪৩১ | ১২ অক্টোবর, ২০২৪

Breaking News

  দেশে ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ৯ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৯১৫
  ময়মনসিংহে ভিমরুলের কামড়ে বাবা-মেয়ের মৃত্যু
  এমন রাষ্ট্র গঠন করতে চাই যা নিয়ে দুনিয়ার সামনে গর্ব করা যায়, ঢাকেশ্বরী মন্দিরে শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস
  আজ মধ্যরাত থেকে ইলিশ ধরা-বিপণনে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা

শেষ বয়সে একটু মাথা গোজার ঠাই চায় আমেনা

নিজস্ব প্রতিবেদক

সড়কে দুই পাশে সাই সাই করে যানবাহন চলছে। একপাশ দিয়ে ৬০ বছর বয়সী এক নারী কলস ও ড্রামে পানি ভর্তি একটি ভ্যান ঠেলছে। খাবার পানি একস্থান থেকে কলসে ভরে বিভিন্ন হোটেলে দিয়ে থাকেন তিনি। একটি চোখে দেখেন না, অন্য চোখও ঝাপসা দেখেন। তবুও ঝুঁকি নিয়ে এভাবেই দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছর পানি টেনে জীবিকা নির্বাহ করছেন ৬ কন্যার জননী আমেনা বেগম। তিনি বাড়ি নগরীর খালিশপুর দুর্বারসংঘ ক্লাব এলাকায় একটি বাড়ি ভাড়ায় থাকেন। স্বামী ফজলুর রহমান দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর ১০ বছর আগে মারা গেছেন। শেষ বয়সে এসে এখন তার পানি টানতে কষ্ট হয়। অর্থকষ্ট থাকা ভুমিহীন এই সংগ্রামী নারী সরকার ও বৃত্তবানদের কাছে একটু মাথা গোঁজার ঠাই চায়। শেষ বয়সে একটু ভালো থাকতে চায়।

সংগ্রামী নারী আমেনা বেগম বলেন, মেয়েদের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন উনি (স্বামী) তো কোন কাজ করতে পারতো না। তখন মেয়েরা ছোট ছোট ছিল। সংসারে অভাব দেখা দেয়। কি করবো? বাধ্য হয়ে হোটেলে পানি দেওয়ার কাজ শুরু করি। প্রথমদিকে হোটেলে পানি দেওয়ায় নুরু ১৫ টাকা দিত। খুব উপকার করতো। সবাইরে বলতো উনারে ভাত একটু বেশি দিস। ছোট ছোট মেয়ে নিয়ে থাকে। ওরা আমারে ভাত তরকারি বেশি দিতো। পেটের ছেলের চেয়ে বেশি উপকার করছে।

তিনি বলেন, দিনে ১৫ টাকা আয় দিয়ে শুরু করেছিলাম। এখন ৮ টা দোকানে পানি দিয়ে প্রতিদিন ২০০ টাকা থাকে। এই টাকা নিয়ে সন্তানদের বাজার করে খাওয়ায়, বাড়ি ভাড়া দেই। খুব কষ্ট হয়। সরকার যদি আমারে একটু জায়গার ব্যবস্থা করে দিতো, বাড়ি করে দিতো। আমারে একটু মাথা গোজার ঠাই করে দিতো এইটাই আমি চাই। সারাজীবন তো কষ্ট করলাম। তাতে আমি আমার পোলাপান কয়টারে নিয়ে থাকতে পারি।

তিনি বলেন, আমার ৫৮ বছর বয়স হইছে আইডি কার্ডে এই জন্য বয়স্ক ভাতাও পাই না। আমার এক চোখে তো কিছুই দেখি না। আরেক চোখ দিয়ে যা দেখি, কোন রকম চলি। তাও জাপসা দেখি, তোমার (প্রতিবেদকের) মুখ, চেহারা কিছু দেখতে পারছি না। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।

আমেনা বেগম বলেন, রাস্তা দিয়ে পানি টানার সময় অনেক সময় গাড়িতে লেগে যায়। অনেকে গালিও দেয়, বলে ওই চোখে দেখো না। আমি বলি চোখেই যদি দেখতাম তাহলে তোমার গাড়িতে তো লাগতো না। তাও বেশি কথা কয়। আমার মেয়েটার যদি একটা চাকরিও হইতো তাহলেও বাঁচতাম। তাও তো হইলো না।

এই কাজ করে খাওয়াইছি, চার জনের বিয়ে দিছি। আর এখন দুইজন অবিবাহিত আছে। ছোট মেয়ে বিএল কলেজে লেখাপড়া করে। আমি দোকানি পানি টেনে সংসার চালাই। ঘর নাই বাড়ি নাই, ভাড়া দিয়ে থাকতে হয়।

মাঝে তিন মাস অসুস্থ ছিলাম। নুরু কিছু দিতো, মেয়েরা কিছু দিতো। সেই দিয়ে চলতাম, খুব কষ্ট হতো। করোনার সময়ও কষ্টে চলেছে। আমার এমনই এক কপাল আমি কোন জায়গা থেকে একটু ত্রাণ পায়নি। আমার নাকি লাগে না। দুই একজন কিছু দিতো।

চোখের চিকিৎসার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেকে ফ্রি চোখের চিকিৎসার কথা বলেছে। কিন্তু আমি যে যাবো সেই সময়ই তো হয় না। চোখ ঠিক করতে গেলে কাজ বন্ধ থাকবে। তিন মাস ঘরে থাকা লাগবে। তিনমাস ঘরে থাকলে দোকানগুলো ছুটে যাবে। পরে আর কাজে নিবে না। কাজ বন্ধ থাকলে কে খাওয়াবে?

তিনি বলেন, অনেক কষ্ট করেছি। প্রথম দিকে কল চেপে কোমড়ে কলস নিয়ে পানি টানতাম। হাতে ঠেলা গাড়ি বানিয়েছি এই তিন-চার বছর হলো। এখন একটু সুবিধা হয়। এছাড়া এখন আর কল চাপা লাগছে না, মটর দিয়ে পানি তুলে নেই। কারেন্ট বিল (বিদ্যুৎ) দিয়ে দেই। এতে সুবিধা হয়, কষ্ট একটু কম হয়।

স্থানীয় একটি হোটেলের মালিক নুরুল হক বলেন, তিনি খুব অসহায় হয়ে ২৫-২৬ বছর আগে বললো বাবা আমি পানি দিবো, আমাকে কাজের সুযোগ দেন। তারপর পানি নেওয়া শুরু করি। কিন্তু সংসার তার চলতো না। বিভিন্ন হোটেলে পানি দেয়, প্রতিদিন ২০০-২৫০ টাকা আয় হয়। এই দিয়ে সংসার চলে তার। অনেক কষ্ট করেছে। তিনি গৃহহীন। ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় পানি টানে তিনি। তার কোন বাড়ি-ঘর নেই। শেষ বয়সে এসে যদি সরকারি সহযোগিতা পেতো তাহলে তার উপকার হতো।

হোটেল কর্মচারী মো. ইয়াসিন সরদার বলেন, আমি ছোট বেলা থেকে তাকে (আমেনা) পানি টানতে দেখছি। তিনি খুব ভালো। ঝুঁকি নিয়ে এই প্রধান সড়কে পানি দেয়। তেমন আয় নেই, ৬ মেয়ে তার। আমি চাই তার যেন বাসস্থান হয়, খাওয়া-দাওয়া ভালো পায়। আল্লাহ যেন তাকে ভালো রাখে। এই বুড়ো বয়সে তার যেন কষ্ট করে না খাওয়া লাগে।

হোটেলে আসা ক্রেতা নজরুল ইসলাম বলেন, ছোট বেলা থেকেই চাচীকে চিনি। অনেক আগেই তার স্বামী মারা গেছে। তার কোন ছেলে নেই। তার কয়টি মেয়ে রয়েছে। আমার দেখা মতে তিনি দীর্ঘ ২০ বছর পানি দিচ্ছে। চাচী ঠিকমতো চোখে দেখে না। এমন কি ঠিকমতো হাটতেও পারে না। কষ্ট করে এই মহিলা চলে। আসলে আমার যদি সামর্থ থাকতো তাহলে সহযোগিতা করতাম। তারপরও যতটুকু পারি করি। কিন্তু তার একটু ভালো কিছু হোক,ভালো জায়গাতে অবস্থান করুক। আগামী দিনগুলো তার সুখে কাটুক এটাই প্রত্যাশা করি। জানি না এই সমাজ তাকে কিভাবে গ্রহণ করবে। সমাজে অনেক বিত্তবান আছে, ভালো মনের মানুষ আছে। তারা হয়তো আজকে চাচীর দুঃখ দুর্দশা দেখে তাকে সহযোগিতা করবে। এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

খুলনা গেজেট / আ হ আ




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!