স্বজনদের কান্না ও আহাজারিতে যশোর সদরের দুটি গ্রামের মানুষ স্তব্ধ। স্বজন হারানো মানুষগুলোর চোখে এখন শুধুই শূণ্যতা আর শোকের কাতরতা। একইভাবে পার্শ্ববর্তী বাঘারপাড়ার তিনটি গ্রামে একই অবস্থা বিরাজ করছে। শুক্রবারের সড়ক দুর্ঘটনা পাঁচটি পরিবারের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। এসব পরিবারে যারা আছেন তাদের চোখে মুখে এখন শুধুই অন্ধকার। প্রতিবেশীরা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। স্বজনহারাদের সান্তনা দেয়ার মতো যেন কেউ নেই। শনিবার (৮ জুলাই) নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে নিহতদের দাফন করা হয়। শুক্রবার সন্ধ্যা রাতে যশোর-মাগুরা সড়কের লেবুতলা বাজারে বাস ইজিবাইক সংঘর্ষে ৮জন নিহত হন।
জানা যায়, যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার যাদবপুর গ্রামের হেলাল মুন্সির মেয়ে খাদিজার চিকিৎসার জন্য শুক্রবার বিকেলে বাড়ি থেকে বের হন তার স্ত্রী, তিন সন্তান খাদিজা, হাসান ও হোসেন, শাশুড়ি মাহিমা, খালা শাশুড়ি রাহিমা ও তার মেয়ে জেবা। ইজিবাইকে যশোরে যাওয়ার পথে যশোর-মাগুরা মহাসড়কের লেবুতলা এলাকায় পৌঁছলে বিপরীতমুখী রয়েল পরিবহনের একটি বাস বেপরোয়া গতিতে ইজিবাইকটিকে ধাক্কা দেয়।
এতে দুমড়ে-মুচড়ে যায় ইজিবাইকটি। এ সময় বাসটি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মোটরসাইকেল চালককেও ধাক্কা দেয়। এতে যমজ দুই শিশুসহ আটজন মারা যান। এ ছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছেন হাসান-হোসেনের মা সোনিয়া ও বোন খাদিজা।
যশোর হাসপাতাল থেকে গভীর রাতে একই পরিবারের পাঁচজনের মরদেহ আনা হয় বাঘারপাড়ার যাদবপুরের গ্রামের বাড়িতে। সকাল থেকে আত্মীয় স্বজন ও গ্রামবাসীর ঢল নামে নিহতদের বাড়িতে। মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় শোকে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে গোটা গ্রামের মানুষ।
নিহত হাসান ও হোসেনের বাবা হেলাল মুন্সি বলেন, মেয়ের চিকিৎসা করাতে গিয়ে দুই ছেলেকে হারাতে হবে কে জানতো। আমার মানিকরা বেপরোয়া গতির গাড়ির চালকদের কারণে মারা গেল। এর বিচার আমি কার কাছে চাইবো। আমার স্ত্রী ও কন্যা বাঁচবে কিনা, তাও জানি না। আমার সব শেষ হয়ে গেছে।
নিহত মাহিমার স্বামী বাবুল মুন্সী বলেন, দুর্ঘটনায় আমার স্ত্রী মাহিমা ও দুই নাতি হাসান-হোসেন মারা গেছে। আমার সব শেষ হয়ে গেছে। কিছুই নেই। এ শোক আমি কোথায় রাখব। এ হত্যাকান্ডের বিচার চাই। বাস চালকের ফাঁসি চাই।
এদিকে, বেপরোয়া গতির কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটায় চালককে আটক ও শাস্তির দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তারা জানান, সড়কে স্পিডব্রেকার থাকার পরও চালক গতি কমায়নি। এতে আটটি তাজা প্রাণ ঝরে গেছে। দেশে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। দোষী চালকদের বিচার হয় না। এ ঘটনার বিচার চাই। আসামিদের দ্রুত আটক করে বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানান তারা।
যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার জহুরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান মিন্টু বলেন, মৃত্যুর এ ঘটনায় পুরো ইউনিয়নবাসী শোকাহত। প্রত্যেকের চোখে পানি। এমন দুর্ঘটনার সাক্ষী এর আগে আমরা হইনি। আমরা ইউনিয়নবাসীর পক্ষ থেকে চালকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। দোষী চালকদের বিচার না হলে সড়ক কখনোই নিরাপদ হবে না।
এদিকে, শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে যাদবপুর ঈদগাহ ময়দানে নিহতদের নামাজের জানাজা সম্পন্ন হয়। এরপরে পারিবারিক কবরস্থানে তাদের দাফন করা হয়। বাকি দু’জনের নামাজে জানাজা সেকেন্দারপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত হয় ও তাদের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। এছাড়া, নিহত মোটরসাইকেল আরোহী মুন্নাকে সদর উপজেলার তালবাড়ীয়া গ্রামে দাফন করা হয়েছে।
দুর্ঘটনায় নিহত হাসান-হোসেনের নানা ছোটন মুন্সি বাদী হয়ে অজ্ঞাত বাস চালক ও তার সহকারীর বিরুদ্ধে যশোর কোতোয়ালি থানায় মামলা করেছেন। তবে এ ঘটনায় এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
এ বিষয়ে যশোর কোতোয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) তাজুল ইসলাম বলেন, শনিবার যশোরের বিভিন্ন সড়কে থানা পুলিশ অভিযান চালিয়েছে। বাসের চালক ও হেলপারকে আটকের চেষ্টা চলছে বলে তিনি জানান।
উল্লেখ্য, শুক্রবার (৭ জুলাই) সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে যশোর-মাগুরা সড়কের লেবুতলা ব্রিজের কাছে বাস ও ইজিবাইকের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে আট জনের মৃত্যু হয়।