অভয়নগরে মৎস্য ঘেরে পরিবেশ দূষণকারী পোলট্রি লিটার ব্যবহার করা হচ্ছে। এই পোলট্রি মুরগির বিষ্ঠা প্রয়োগ করায় নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ ও প্রতিবেশ। হুমকিতে পড়ছে জনস্বাস্থ্য। যে কারণে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উপজেলা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দিয়েছে।
এলাকাবাসির কাছ থেকে জানা যায়, উপজেলার ধোপাদী, সুন্দলী, ডুমুরতলা, সড়াডাঙ্গা , আড়পাড়া,আমডাঙ্গা, লক্ষীপুর, বারান্দি, ফকিরহাট,সরখোলা, প্রেমবাগ, চেঙ্গুটিয়া, ধলিগাতি, ধোপাপাড়াসহ আশপাশের গ্রামের অনেকেই এই পরিবেশ ধ্বংসকারী পোলট্রি মুরগির বিষ্ঠা মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহার করছে।
উল্লেখ্য, গত বছর উপজেলা মৎস্য অফিসের সহযোগিতায় ইউনিয়নের আমডাঙ্গা গ্রামের মৎস্য ঘেরে অভিযান চালানো হয়। অভিযানের এক পর্যায়ে রাজাপুর সড়ক থেকে অবৈধ পোলট্রি লিটার বহনের দায়ে একটি ট্রাক (ঢাকা মেট্রো ড- ১৪-৬৯৯৭) জব্দ করা হয়। পোলট্রি লিটার বহনের দায়ে যশোর রেল রোডের জয়নাল আবেদিনের ছেলে ট্রাক মালিক আশিক সিদ্দিকীকে মৎস্য ও পশুখাদ্য আইন ২০১০ এর ১২/১ (ক) ধারায় ৪৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে জরিমানা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট । পরে এলাকাবাসীর উপস্থিতিতে ঘটনাস্থলে ট্রাকভর্তি পোলট্রি লিটার বিনষ্ট করা হয়। তার কিছুদিন পর ওই চক্রটি আবার সক্রিয় ওঠে। দিন দিন এলাকায় পোলট্রি মুরগির বিষ্ঠার ব্যবহার বেড়েছে।
জানা গেছে, এখন এ উপজেলায় মৎস্য অফিসের এব্যপারে কোন প্রতিকার না থাকায় উপজেলা প্রতি ঘেরে পোলট্রি মুরগির বিষ্ঠা ব্যবহার করা হচ্ছে। যে কারণে হুমকিতে পড়ছে জনস্বাস্থ্য। মাছের খাদ্য হিসেবে মুরগির বিষ্ঠা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তার পরও উপজেলার বিভিন্ন খামারে মাছের খাবার হিসেবে অবাধে ব্যবহার করা হচ্ছে বিষ্ঠা। বিষয়টি জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় ছোট-বড় কমপক্ষে ৫/৭শ খামারে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের চাষ হয়। ওইসব খামারে বছরে উৎপাদন হয় প্রায় হাজার টন মাছ। স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে রপ্তানি হয়ে থাকে ওইসব খামারের মাছ। মাছ চাষে সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে পুরস্কারও পেয়েছে উপজেলার একাধিক মৎস্য চাষি। তবে মাছের খাদ্যমূল্য অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় এখন আর আগের মতো পুশিয়ে উঠতে পারছে না চাষিরা। ফলে মাছের খাদ্য হিসেবে মুরগির বিষ্ঠা ব্যবহার করছে স্থানীয় মৎস্য চাষিরা। এক শ্রেণির ব্যবসায়ীর মাধ্যমে উপজেলাসহ আশপাশ এলাকার মুরগির খামারগুলো থেকে বিষ্ঠা সংগ্রহ করে আনছে স্থানীয় মৎস্য চাষিরা। কম দামে পাওয়া ওই বিষ্ঠা জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর জেনেও মাছের খাদ্য হিসেবে খামারে তা ব্যবহার করছে তারা।
উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, মাছ চাষে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর মুরগির বিষ্ঠা ব্যবহার বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু তা মানছে না মৎস্য চাষিরা। পৌরসভাসহ উপজেলার ৮টি ইউনিয়নেই কমবেশি মাছের চাষ করা হয়। এর মধ্যে দুয়েকটি ইউনিয়ন ছাড়া অন্যান্য ইউনিয়নের খামারগুলোতে মাছের খাদ্য হিসেবে বিষ্ঠা ব্যবহার করা হচ্ছে।
নওয়াপাড়া বাজারে নিয়মিতই মাছ কেনেন শিরিনা বেগম তিনি জানান, নদীর মাছ ছাড়া অন্য কোন মাছ তিনি কেনেন না। কিন্তু কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নদীর মাছে যে স্বাদ, চাষের মাছে সেটা পাই না। চাষের মাছে সবসময়ই কেমন যেন একটা গন্ধ থাকে। অনেকটা ঘাসের মতো।
তবে চাষের মাছ কেনেন এ রকম ক্রেতারও অভাব নেই। এর বড় একটা কারণ চাষের মাছের দাম কম। একজন ক্রেতা খলিলুর রহমান বলছিলেন, অনেক সময় নদীর রুই বা কাতল মাছের যে দাম চায়, তার অর্ধেক দামে চাষের রুই বা কাতল মাছ কিনতে পারি। কিন্তু চাষের মাছ কিনলেও মনে সবসময়ই একটা সন্দেহ থাকে যে এই মাছ কিভাবে, কোথায় চাষ হচ্ছে, মাছকে কি খাওয়াচ্ছে, এসব মাছ খেলে আমাদের কোন ক্ষতি হবে কি না তা নিয়ে একটা ভয় থাকে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে খামারের একজন কর্মচারী জানান, ৭ বছর ধরেই তাদের মাছের খামারে মাছের খাদ্য হিসেবে মুরগির বিষ্ঠা ব্যবহার করেন তারা। এতে মাছের খাবারের পেছনে ব্যয় অনেকটাই কমে যায় তাদের। তবে এভাবে বিষ্ঠা ব্যবহার করে যে মাছ চাষ নিষিদ্ধ সেটা জানেন সবাই।
সুন্দলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিকাশ রায় কফিল বলেন, অল্প কিছু মৎস্য চাষি আছে, যারা খামারে বিষ্ঠার ব্যবহার করে না। তবে অধিকাংশ খামারেই বিষ্ঠা ব্যবহার করা হয়। মুরগির বিষ্ঠা ব্যবহারকারীদের সঙ্গে আমরা পেরে উঠছি না। অপরদিকে বিষ্ঠা ব্যবহারে মাছের উৎপাদন খরচ অনেক কম হয়। কিন্তু বাজার মূল্য সমান। এদিকে বিষ্ঠায় স্বাস্থ্যের ক্ষতিকর দিক বিবেচনায় বর্তমানে অনেকেই চাষের মাছ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে একসময় এ উপজেলায় মাছ চাষে ধস নামতে পারে।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. শংকর কুমার দে বলেন, মুরগির বিষ্ঠার অ্যান্টিবায়োটিক রেসিডিও, ড্রাগ রেজিস্টেন্স ব্যাকটেরিয়াসহ (এম এম আর) বিভিন্ন ধরনের ডিজি ইনফেকট্যান্ট থাকে। এটি বয়লার মুরগীতে ব্যবহার হয়। এবং উচ্চ মাত্রায় ব্যবহার করা হয় যাতে একটি মুরগী এক মাসের মধ্যে দেড় কেজিতে পরিণত হয়। তাই মাছের ক্ষতি হয় মাছের খাদ্য হিসেবে মুরগির বিষ্ঠা ব্যবহারের ফলে সেগুলো পরে মানবদেহে প্রবেশ করে, যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাছাড়া মুরগির বিষ্ঠায় থাকা অতিরিক্তি ক্যালসিয়াম,ফসফরাস পুকুরের পরিবেশ নষ্ট করে। অপরদিকে এই উপাদানগুলো পানিতে অক্সিজেনের স্বল্পতা ঘটানোর মাধ্যমে মাছের স্বাস্থ্যের ক্ষতি ও রোগব্যাধি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এ ছাড়াও অনেক খামারেই এখনো মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয় মুরগির বিষ্ঠা ও আবর্জনা। গত বছর কয়েক জায়গাতে অভিযান পরিচালনা করা হয়ে ছিল এবং জরিমানা করে আদায় করা হয়েছিল। অভিযান অব্যহত রাখলে চক্রটি আর এ কাজে জড়িত হবে না।
এ বিষয়ে সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ ফারুক হোসাইন সাগর বলেন, ‘মুরগি পালনে নানা রকম অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার হয়। যেগুলো মুরগির বিষ্ঠার মাধ্যমে মাছের শরীরে প্রবেশ করে। এগুলো ধ্বংস হয় না। তাই এগুলো মাছের মাধ্যমে পরে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে স্বাস্থ্যের ক্ষতি ঘটাতে পারে। এ জন্য কয়েক বছর আগেই মাছের খাবার হিসেবে মুরগির বিষ্ঠা নিষিদ্ধ করেছে সরকার। অনেকে এখনো গোপনে এটা করছে। আমরা জানতে পারলে সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। আমি গত বছর কয়েক জনকে ২ লাখ ১৬ হাজার টাকা জরিমানা করে আদায় করেছি। ঘের সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা যদি অভিযোগ দেয়। তাহলে আমরা পরিবেশ আইনের তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারি। তাছাড়া ও উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তর, নিবার্হী অফিসার, অভয়নগর থানা, নওয়াপাড়া হাইওয়ে থানা যৌথ ভাবে কাজ করলে এটা র্নিমুল করতে সম্ভব হবে। রাতে যদি অভয়নগর থানা, নওয়াপাড়া হাইওয়ে থানা যৌথ ভাবে আমডাঙ্গা ও ধোপাদী এলাকায় ডিউটি দেয় তাহলে ওই চক্রটিকে হাতেনাতে ধরা সম্ভব হবে।
এ ব্যাপারে উপজেলা নিবার্হী অফিসার বলেন, অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। পরিবেশ আইনের তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারি। মুরগির বিষ্ঠার মাধ্যমে মাছের শরীরে প্রবেশ করে আমাদের শরীরের ক্ষতি করে থাকে। তাই ওয়ার্ডে ও ইউনিয়নের বিভিন্ন জায়গাতে এ ব্যাপারে সচেতন করা হচ্ছে।
খুলনা গেজেট/ এস আই