যশোরের অভয়নগর থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে বাঁশ-বেত শিল্প। অলস সময় পার করছে বেত ও বাঁশের তৈরি সামগ্রী বিক্রেতারা। শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি ও উপকরণের মূল্য বৃদ্ধিসহ প্লাস্টিক পণ্যের সহজলভ্যতায় এ অঞ্চল থেকেও বাঁশ শিল্প বিলুপ্তির পথে।
বাঁশ শিল্প বাঙালি সংস্কৃতির একটি বড় অংশ। আদিকাল থেকেই বাঁশ দিয়ে তৈরি ঘরের কাজের যোগ্য বিভিন্ন জিনিসপত্র ব্যবহার করে আসছে মানুষ। একটা সময় বেত, বাঁশ ও চাটাইয়ের তৈরিকৃত জিনিসপত্রের বেশ কদর ছিল। একসময় পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এ কাজে সামিল হতো কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। প্রতি সপ্তাহের হাটবাজার গুলোতে আশপাশের অঞ্চলের স্থানীয় বাজারে পশরা সাজিয়ে চলতো বেঁচাকেনা। অনেকেই আবার বিভিন্ন অঞ্চলের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফেরি করে বিক্রয় করতো নিজেদের তৈরি বাঁশ-বেতের এসব পণ্য।
উপজেলার প্রেমবাগ, ধোপাদী, সুন্দলী, চলিশিয়া, মালোপাড়া, বনগ্রাম,পায়রা, শ্রীধরপুর, বাঘুটিয়া, শুভরাড়া, সিদ্ধিপাশা ইউনিয়নের, ঋষিপল্লীতে প্রতিটা ঘরেই এক সময় বাঁশ শিল্পের দেখা মিললেও এখন আর নেই বললেই চলে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বর্তমানে অল্প কয়েকজন কাজ করছে এই বাশঁ ও বেত নিয়ে। কেউ বাশঁ দিয়ে ঝুঁড়ি বানাচ্ছেন, অন্য সদস্যরা মাছ ধরার ঘুনি বুনছেন। পাচঁ বছর আগে অনেক বেশি কাজ হত। ঝুড়ি, ঘুনি, কুলা, ডালা, চাঙারি, টুকরির ব্যবহার কমে যাওয়ায় এখন তাদের হাতে কাজ কম।
দীর্ঘ সময়ের মহামারিতে দেখা দিয়েছে প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাব। শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি ও উপকরণের মুল্য বৃদ্ধিসহ প্লাস্টিক পণ্যের সহজলভ্যতায় এ অঞ্চল থেকেও বাঁশ শিল্প বিলুপ্তির পথে। বলা চলে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে গ্রামবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য বাঁশ শিল্পের ঠিকানা এখন জাদুঘরে। একটা সময় ঋষিপল্লীর বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকার একমাত্র উপায় ছিলো বাঁশ-বেতের হস্তশিল্প। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রতিদিনই চলতো গ্রামীণ পল্লী জুড়ে বাঁশের চটা দিয়ে চাটাই বা চাঁচ, ধান ঝাড়া কুলা, ডালা, চাঙারি, টুকরি বা ঝুঁড়ি, চালন, মাছ রাখার খালই, ও হাঁস-মুরগির খাঁচাসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরির প্রতিযোগিতা। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এ শিল্পের মূল উপকরণ বাঁশের মূল্য বৃদ্ধিতে বাঁশ-বেতের কারিগররা তাদের পেশা ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। ফলে বেকার হয়ে পড়েছে গ্রামীণ এ বাঁশ-বেতের কারিগররা। অনেকেই আবার এ পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছে অন্য পেশায়। কেউ ভ্যান চালাচ্ছে, কেউ দিন মজুরের কাজে জড়িয়ে পড়েছে। এক সময় এসব এলাকার বিভিন্ন জনপদে বড় বড় বাঁশ বাগান দেখা গেলেও এখন আর চোখে পড়ে না। এ বাঁশ দিয়েই বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতো তারা। নির্বিচারে বাঁশও বেত ধ্বংসের কারণে বাঁশের বংশবিস্তার কমেছে বহু গুণ।
‘কারিগরেরা বলছেন, মহামারির করোনার আগ্রাসন সহ বিভিন্ন কারণে এ অঞ্চলের পাঁচ শতাধিক হস্তশিল্পীর অধিকাংশই পেশা পাল্টাতে বাধ্য হচ্ছেন। কালের বিবর্তনে বাঁশ-বেতের তৈরি চাটাই, কুলা, ডালা, চাঙারি, টুকরি বা ঝুঁড়ি, পোলো, ডোল (ধান রাখা পাত্র), চালুনি, মাছ রাখার খালই, হাঁস-মুরগি রাখা খাঁচা, টেপারিসহ বিভিন্ন জিনিসপত্রের বিকল্প হিসাবে জায়গা করে নিয়েছে প্লাস্টিক ও আধুনিক পণ্য সমগ্রী। এমনিতে মানব সভ্যতার পরিবর্তন তার উপর মহামারীর অগ্রাসন সব মিলিয়ে কোনো মতে টিকে থাকার লড়াইয়ে চালিয়ে যাচ্ছে এসব অঞ্চলের হস্তশিল্পের সাথে জড়িতরা।’
চলিশিয়া, ধোপাদী, মালোপাড়ার বাঁশ শিল্প কারিগরা বলেন, বাঁশের তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্র মানুষ এখন আর আগের মতো ব্যবহার করছে না। কারণ বর্তমানে প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি পণ্যের উপর ঝুঁকছে মানুষ। ফলে এ শিল্পটি চিরতরে হারিয়ে যেতে বসেছে। বাঁশ-বেত শিল্পের দুর্দিন কাটিয়ে সুদিন ফিরিয়ে আনতে সরকারি উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।
বাঁশ-বেতে তৈরি জিনিসের পাইকারী ক্রেতারা বলেন, একসময় প্রত্যেক বাড়িতেই বাঁশের তৈরি জিনিসপত্রের ব্যবহার ছিল। চাহিদাও ছিল ব্যাপক। বর্তমান প্লাস্টিক পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে মুখ থুবড়ে পড়ছে বাংলার ঐতিহ্যবাহী শিল্পটি।
উপজেলার গ্রামতলা এলাকার বাঁশ শিল্পের কারিগর সুধান্য দাস বলেন, কর্মসংস্থান সংকুচিত হওয়ায় আমরা এখন অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করছি। শত প্রতিকূলতার মধ্যে পুরোনো পেশা ধরে রাখতে সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করছি। কিন্তু প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাবে সে প্রচেষ্টা থমকে গেছে। আমরা সরকারি বা বেসরকারি সংস্থার ঋণ সহায়তা ব্যবস্থা কামনা করছি।
এ ব্যপারে সোনালী ব্যাংক লিঃ নওয়াপাড়া শাখার ম্যানেজার এ এস এম শামীম আহমেদ জানান, আমি দ্বায়িত্ব পাওয়ার পর এ বিষয়ে বাঁশ-বেত শিল্প কারিগররা কেউ ঋণ সহায়তা নিতে আসেনি। কোন শিক্ষক বা সরকারি চাকুরী করে এমন ব্যক্তি যদি ঋণ জামিন থাকে তাহলে আমরা ঋণ সহায়তা দেব। একটা ঋণ খেলাপী হলে আমাদের অনেক জবাব দিতে হয়। যার কারণে সিকিউরিটির মাধ্যমে ঋণ সহায়তা দেওয়া সম্ভব।
এ বিষয়ে উপজেলা নিবার্হী অফিসার মেজবাহ উদ্দীন বলেন, উপজেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর এর কর্মকর্তার কাছে যোগাযোগ করতে হবে। তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। এই শিল্পকে বাচিঁয়ে রাখতে প্রশিক্ষণ গ্রহন করে পল্লী ব্যাংকের সমিতির মাধ্যমে তারা ঋণ সহায়তা নিতে পারেন।
খুলনা গেজেট/ এস আই