২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩টি জেলায় একযোগে সিরিজ বোমা হামলা চালিয়েছিল জেএমবি। দেশব্যাপী এ বোমা হামলার ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শী একজন পকেটমারের দেওয়া বয়ান অনুসারে সর্বপ্রথম সাতক্ষীরায় ধরা পড়ে জেএমবি সদস্য নাসির উদ্দীন দফাদার। সাতক্ষীরায় প্রথম জেএমবি ধরা পড়ার পর দেশব্যাপী সাড়া পড়ে যায়। তখনই দেশবাসী জানতে পারেন এই সিরিজ বোমা হামলার নেপথ্য কাহিনী এবং কারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী সাতক্ষীরার পকেটমার শেখ রওশন আলী সেদিন দাঁড়িয়েছিলেন সাতক্ষীরা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সামনে। এমন সময় সেখানে শহরতলীর বাঁকাল ইসলামপুর এলাকার দলিলউদ্দিন দফাদারের ছেলে নাসিরুদ্দিন দফাদার বাজার করা থলে নিয়ে হাজির হয়। থলেটি নারী ও শিশু আদালতের পাশে রেখে গা-ঢাকা দেয় নাসির উদ্দীন। এর কিছুক্ষণ পর বিকট আওয়াজে বিস্ফোরিত হয় থলের ভিতরে রাখা বোমা। বিস্ফোরণের পর থলে দেখে চিনতে পারেন রওশন আলী। এরপর রওশন আলী চলে আসেন তৎকালীন দৈনিক সাতক্ষীরা চিত্রের সম্পাদক আনিসুর রহিমের কাছে।
রওশন আলীর কাছে সবিস্তারে শোনার পর সাংবাদিক আনিসুর রহিম বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন এনএসআই এর এডি বদরুল আলম চৌধুরী ও সহকারি পুলিশ সুপার দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে আলোচনা করেন। তিনজন মিলে অপারেশনের পরিকল্পনা করেন। বিষয়টি আর কাউকে না জানিয়ে ওই দুপুরে মাথায় গামছা বেঁধে সাধারণ পোশাকে ছদ্মবেশ ধারণ করে শুরু করেন অপারেশন। ভ্যানের মাদুরের নিচে অস্ত্র রেখে নাসির উদ্দীনের বাড়ির পাশে পুকুর পাড়ে অবস্থান নেওয়ার কিছুক্ষণ পর নাসির উদ্দীন ওই পুকুরে গোসল করতে আসলে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। এভাবেই সেদিন ধরা পড়েছিল দেশ কাঁপানো সিরিজ বোমা হামলার প্রথম আসামী জেএমবির নাসির উদ্দীন দফাদার।
সেদিনের সেই লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরে সাংবাদিক আনিসুর রহিম বলেন, সাতক্ষীরা শহরের শহীদ রাজ্জাক পার্ক, জেলা জজ আদালত চত্ত্বর, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালত চত্ত্বর, বাস টার্মিনাল ও খুলনা মোড়সহ পাঁচটি স্থানে একযোগে এই বোমা হামলা ও নিষিদ্ধ লিফলেট ছড়িয়েছিল জেএমবি। শহরতলীর বাঁকালের দলিলউদ্দিন দফাদারের ছেলে নাসিরুদ্দিন দফাদার প্রত্যক্ষদর্শী বাঁকাল ইসলামপুর চরের পকেটমার রওশন আলীর বিবরণ মতে ধরা পড়ে। নাসির উদ্দীনের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী সাতক্ষীরার রসুলপুরে জেএমবির ঘাঁটি চিহ্নিত করা হয়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদি হয়ে ২০০৫ সালে পাঁচটি মামলা দায়ের করে।
পরবর্তীতে ২০০৭ সালে সাতক্ষীরা সদর থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গোলাম মোহাম্মদ বাদি হয়ে আরও একটি মামলা দায়ের করেন। এসব মামলায় কমপক্ষে ১৯জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদেরকে ঢাকায় জেআইসিতে (জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল) এ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঠানো হয়। সেখানে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেওয়া ছাড়াও জেএমবির বহু গোপন তথ্য জানায় তারা। পরে তাদের ফিরিয়ে আনা হয় সাতক্ষীরায়। গ্রেপ্তারকৃত মনোয়ার হোসেন উজ্জ্বল ২০১১ সালের জুনে উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়ে পালিয়ে যায়। গ্রেপ্তার হওয়া সব আসামী সাতক্ষীরার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দী দেয়। ২০১১ সালের জুন মাসে আনিসুর রহমান খোকন জামিন পেলেও পরে তাদের জামিন বাতিল করা হয়। তিনি পরে আবারো জামিন পান। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে বাঁকাল ইসলামপুরের নাসিরুদ্দিন দফাদার ২০১৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর মস্তিস্কের রক্ষক্ষরণজনিত কারণে সাতক্ষীরা কারাগারে মারা যান।
আসামীরা দেশের বিভিন্ন কারাগারে অবস্থান করায় মামলার রায় হতে দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর লেগে যায়। আসামিদের মধ্যে শায়খ রহমান, বাংলা ভাই ও আতাউর রহমান সানির মৃত্যুদন্ড কার্যকর হওয়ায় তাদেরকে এসব মামলার আসামির তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। ২০০৬ সালের ১৩ মার্চ সিআইডি সবগুলি মামলায় ১৯ আসামির বিরুদ্ধে চার্জশীট দেয়। ২০০৭ সালে দায়েরকৃত মামলাটিতে ২৩ জনের নাম উল্লেখ করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। মামলাগুলি খুলনার দ্রুত বিচার আদালতে পাঠানো হয়। যথাসময়ে নিষ্পত্তি না হওয়ায় ২০০৭ এর ২৫ জুন মামলাগুলি খুলনা থেকে ফেরত আসে সাতক্ষীরায়। ২০০৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ১ম আদালতে মামলাগুলির বিচার কাজ শুরু করেন।
বুধবার রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে বহুল আলোচিত এই সিরিজ বোমা হামলার সাতক্ষীরার মামলা গুলোর বিচার কার্যক্রম শেষ হলো।
খুলনা গেজেট/এনএম