খুলনা, বাংলাদেশ | ২৬ আশ্বিন, ১৪৩১ | ১১ অক্টোবর, ২০২৪

Breaking News

  টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে ট্রাক-কাভার্ডভ্যানের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ২
  হিযবুত তাহরীরকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করল ভারত

দিঘলিয়ায় আ’লীগ প্রার্থীদের পরাজয়ের নেপথ্যে

একরামুল হোসেন লিপু, দিঘলিয়া

ইউপি নির্বাচনে খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার ৬ টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫ টিতে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন। একমাত্র বারাকপুর ইউনিয়নে শক্ত কোন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকায় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী জয়ী হয়েছেন।

তৃণমূল পর্যায়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এ উপজেলার ৫ টি ইউনিয়নে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ফল বিপর্যের কারণ অনুসন্ধানে নানা তথ্য উঠে এসেছে। উপজেলার তৃণমূল পর্যায়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী এবং সমর্থকদের সাথে কথা বলে পরাজয়ের নেপথ্যে এ সব তথ্য জানা গেছে।

প্রথমত : দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল ছিলো।

দ্বিতীয়ত : গত নির্বাচনে প্রথমবারের মতো নৌকা প্রতীক নিয়ে যারা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন তাঁদের সামগ্রিক কর্মকান্ডে এলাকার সাধারণ জনগণ অসন্তুষ্ট ছিলেন।

তৃতীয়ত : দীর্ঘদিন দল  ক্ষমতায় থাকায়  দলের ভেতর শৃঙ্খলার অভাবসহ চেইন অব কমান্ডের ঘাটতি ছিলো।

চতুর্থত : দলের ওয়ার্ড, ইউনিয়ন এবং উপজেলা পর্যায়ে নেতা নির্বাচনে স্বচ্ছতা না থাকার কারণে তৃণমূলের অনেক কর্মী/ সমর্থক হতাশা এবং ক্ষোভ থেকে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন।

পঞ্চমত : বিএনপি জামায়াত এবং তাদের সমমনা দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলেও তারা ভোটে অংশ নিয়ে নৌকার প্রার্থীকে পরাজিত করতে সহায়তা করেছে।

দলীয় প্রার্থীদের পরাজয়ের কারণ জানতে চাইলে দিঘলিয়া উপজেলা আ’লীগের সভাপতি খান নজরুল ইসলাম খুলনা গেজেটকে বলেন, ‘কোন কোন দলীয় প্রার্থীর ইমেজ সংকট ছিল। প্রার্থী বাছাই সঠিক ছিল না। দলের ভিতরে বিরোধ ছিল। নেতাদের মধ্যে মতবিরোধ দৃশ্যমান। দলের ভেতরে শৃঙ্খলার অভাব ছিল। বিএনপি জামায়াতের ভোটগুলো নৌকার বিপক্ষে পড়েছে। এছাড়া গত উপজেলা নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী এবং দলীয় পদধারী নেতাদের বিরুদ্ধে দল কোন সাংগাঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। যার প্রভাব এ নির্বাচনে পড়েছে। কারণগুলো একত্রিত হয়ে এ বিপর্যয় হয়েছে বলে আমার ধারণা।’

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় উপজেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক মোল্যা আকরাম হোসেনের সাথে। তিনি খুলনা গেজেটকে বলেন, ‘দিঘলিয়া উপজেলা মূলত বিএনপি জামায়াত অধ্যুষিত এলাকা। ১৯৯১ সালে খুলনা জেলা আ’লীগের সাংগাঠনিক সম্পাদক এস এম মোস্তফা রশিদী সুজা এই এলাকা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে দিঘলিয়া উপজেলায় আ’লীগের সাংগঠনিক গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। কিন্ত তাঁর মৃত্যুর পর সাংগঠনিক বিপর্যয় দেখা দেয়। যা কাঁটিয়ে উঠার আগেই এ নির্বাচন। দলীয় প্রার্থীর পক্ষে আমরা একট্টা হয়ে কাজ করেছি। বিএনপি জামায়াত নির্বাচনে অংশ না নিলেও ভোটে অংশ নিয়েছে। নৌকা প্রতীক হারানোই ছিল তাঁদের মূল টার্গেট। ফল বিপর্যের অন্যতম কারণ এটা বলে আমি মনে করি।’

এ ব্যাপারে কথা হয় দিঘলিয়া উপজেলা আ’লীগের জন্মলগ্ন থেকে যারা দল করছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন খুলনা জেলা কৃষকলীগের প্রাক্তন সিনিয়র সহ- সভাপতি মোঃ মোসলেমউদ্দিন হাওলাদারের সাথে। তিনি খুলনা গেজেটকে বলেন, ‘দলের মনোনয়ন কোন ক্রমেই সঠিক ছিল না। দলের তৃণমূল কর্মীদের কোন মূল্যায়ন হয়নি। প্রার্থীরা তাঁদের নিজস্ব বলয় তৈরী করে চলেন। বিগত দিনে যাঁরা দলীয় চেয়ারম্যান ছিলেন তাঁদের সাথে দলের তৃণমূল কর্মীদের সুসম্পর্ক ছিল না। তাঁদের সাঙ্গ-পাঙ্গদের নানা ধরণের অপকর্ম নির্বাচনে প্রভাব পড়েছে।’

গাজীরহাট ইউনিয়নের সভাপতি মোল্যা আব্দুস সালাম বলেন, ‘গাজীরহাট ইউনিয়নে আ’লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী বিএনপি জামায়াতের উপর ভর করে এবং তাঁদের ভোটের ভরসা করে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। আরেক বিদ্রোহী প্রার্থীর বক্তব্য ছিল আমি নিজেও হবো না নৌকার প্রার্থীকেও বিজয়ী হতে দিবো না। সম্পর্কে তাঁরা চাচা ভাতিজা।’

নগরীর খানজাহানআলী থানা সাংগঠনিক ইউনিটের অন্তর্গত যোগীপোল ইউনিয়ন। এ ইউনিয়নে দলীয় প্রার্থীর পরাজয়ের কারণ জানতে চাওয়া হয় খানজাহানআলী থানা আ’লীগের সভাপতি শেখ আবিদ হোসেনের কাছে। তিনি খুলনা গেজেটকে বলেন, ‘আমাদের সাংগঠনিক কোন দূর্বলতা ছিল না। দলীয় প্রার্থীর পক্ষে সবাই একত্রিত হয়ে কাজ করেছি। বিদ্রোহী প্রার্থী যিনি বিজয়ী হয়েছেন আল্টিমেটলি তিনিও আমাদের দলীয় লোক। খানজাহানআলী থানা যুবলীগের আহবায়ক ছিলেন। দল থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দলে তারও কর্মী সমর্থক ছিল। তাছাড়া বিএনপি জামায়াতের ভোট নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।’

আড়ংঘাটা সাংগঠনিক ইউনিয়ন নগরীর দৌলতপুর থানার ৩২ নং ওয়ার্ডের অন্তর্গত। এ ওয়ার্ডের কার্যকরী কমিটির সদস্য ও প্রাক্তন সভাপতি মোড়ল জাহাঙ্গীর হোসেন খুলনা গেজেটকে বলেন, ‘আড়ংঘাটা ইউনিয়নে একক দলীয় প্রার্থী ছিলেন। নির্বাচনের ২ দিন পূর্বে এ ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক ও ইউপি সদস্য মোঃ রেজাউল ইসলামকে দল থেকে বহিষ্কারের প্রভাব নির্বাচনে কিছুটা হলেও পড়েছে।’

তৃণমূলের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে খুলনা গেজেটকে বলেন, দলীয় প্রার্থীর ব্যক্তিগত আচরণ, চেয়ারম্যান থাকাকালীন স্বজনপ্রীতি, অহংকার, দাম্ভিকতা, তৃণমূল কর্মীদের সাথে দূরত্ব এসব কারণের পাশাপাশি প্রতিপক্ষ প্রার্থীর ক্লিন ইমেজ তাঁর পরাজয়কে ত্বরান্বিত করেছে।

এ উপজেলার ৫ টি ইউনিয়নে আ’লীগ মনোনীত প্রার্থী যাঁরা পরাজিত হয়েছেন :

দিঘলিয়া সদর ইউনিয়ন : এ ইউনিয়নে আ’লীগ মনোনীত প্রার্থী মোল্যা ফিরোজ হোসেন তৃতীয় হয়েছেন। তিনি নৌকা প্রতীকে ভোট পেয়েছেন ৩ হাজার ৯৬৫ টি। মোটরসাইকেল প্রতীক নিয়ে এ ইউনিয়নে বিজয়ী হয়েছেন আ’লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী, জেলা আ’লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য (বহিস্কৃত) ও প্রাক্তন তিনবার নির্বাচিত চেয়ারম্যান মোঃ হায়দার আলী মোড়ল। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন উপজেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ আতিকুল ইসলাম আতিক। তিনি চশমা প্রতীকে পেয়েছেন ৪ হাজার ৮৪৯ ভোট।

সেনহাটী ইউনিয়ন : এ ইউনিয়নে আ’লীগের মনোনীত প্রার্থী প্রয়াত জেলা আ’লীগনেতা ও সেনহাটী ইউপি চেয়ারম্যান গাজী আঃ হালিমের সহধর্মিনী, জেলা আ’লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য ও প্রাক্তন ইউপি চেয়ারম্যান ফারহানা হালিম। তিনি ভোট পেয়েছেন ৬ হাজার ৩৯৫ টি। এ ইউনিয়নে বিজয়ী হয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যান ও আ’লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী গাজী জিয়াউর রহমান ওরফে জিয়া গাজী। তিনি আনারস প্রতীকে ভোট পেয়েছেন ১১ হাজার ৮৭৪ টি।

গাজীরহাট ইউনিয়ন : এ ইউনিয়নে আ’লীগের মনোনীত প্রার্থী ছিলেন উপজেলা আ’লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি বর্তমান চেয়ারম্যান মোঃ কামালউদ্দিন সিদ্দিকী হেলাল। তিনি পেয়েছেন ৪ হাজার ৭৪৫ ভোট। এ ইউনিয়নে বিজয়ী হয়েছেন উপজেলা আ’লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (বহিস্কৃত) মোল্যা মফিজুল ইসলাম ঠান্ডু। তিনি পেয়েছেন ৪ হাজার ৯০০ ভোট।

বারাকপুর ইউনিয়ন : এ ইউনিয়ন থেকে নৌকা প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হয়েছেন আঃলীগ মনোনীত প্রার্থী ও উপজেলা আঃলীগের সহ-সভাপতি বর্তমান চেয়াম্যান গাজী জাকির হোসেন। তিনি পেয়েছেন ৬ হাজার ৯৯৩ ভোট। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন বারাকপুর বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক শেখ আনছারউদ্দিন। মোটরসাইকেল প্রতীকে তিনি পেয়েছেন ৫ হাজার ৯১৫। অভিযোগ রয়েছে আ’লীগ মনোনীত প্রার্থীর ক্যাডার বাহিনী ভোটের আগের দিন-রাত আনছারউদ্দিনের সমর্থকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট কেন্দ্রে না আসার হুমকি দিয়ে আসে।

যোগীপোল ইউনিয়ন : এ ইউনিয়নে আ’লীগ মনোনীত প্রার্থী ছিলেন খানজাহানআলী থানা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান চেয়ারম্যান শেখ আনিছুর রহমান। তিনি পেয়েছেন ৩ হাজার ৩৯ ভোট। বিজয়ী হয়েছেন খানজানআলী থানা যুবলীগের আহবায়ক (বহিস্কৃত) মোঃ সাজ্জাদুর রহমান লিঙ্কন। তিনি পেয়েছেন ৭ হাজার ৬২৬ ভোট।

আড়ংঘাটা ইউনিয়ন : এ ইউনিয়নে আ’লীগের মনোনীত প্রার্থী ছিলেন (আড়ংঘাটা ইউনিয়ন) দৌলতপুর থানার ৩২ নং ওয়ার্ড আ’লীগের সভাপতি ও বর্তমান চেয়ারম্যান মোঃ মফিজুর রহমান জিবলু। তিনি পেয়েছেন ২ হাজার ৮৯৬ ভোট। এ ইউনিয়নে আনারস প্রতীকে বিজয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রাক্তন চেয়ারম্যান এস এম ফরিদ আক্তার। তিনি পেয়েছেন ৩ হাজার ৪৫৩ ভোট।

খুলনা গেজেট/ এস আই




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!