খুলনা, বাংলাদেশ | ২৪ বৈশাখ, ১৪৩১ | ৭ মে, ২০২৪

Breaking News

  চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরে ট্রাকের সঙ্গে ভটভটির মুখোমুখি সংঘর্ষে যুবক নিহত
  রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে বাস-পিকআপ সংঘর্ষে নিহত ২

দালাল চক্রে জিম্মি বাগেরহাট পাসপোর্ট অফিস, ভোগান্তিতে সেবা গ্রহীতারা

মাসুদুল হক, বাগেরহাট

দালাল চক্রের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে বাগেরহাট আঞ্চলিক পার্সপোর্ট অফিস। অনিয়ম আর দালালদের দৌরাত্মে ভোগন্তির শেষ নেই সেবা গ্রহীতাদের। অতিরিক্ত টাকা গ্রহণ, হয়রানি, সামান্য ভুলে গ্রহিতাদের ফেরত দেওয়া, সেবা গ্রহিতাদের সাথে খারাপ ব্যবহার, দালালদের সাথে সখ্যতাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে পার্সপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে। খারাপ ব্যবহারের কারণে পার্সপোর্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুগ্মজেলা জর্জ আদালতে মামলাও করেছেন এক সেবা গ্রহিতা।

পার্সপোর্ট অফিস ঘুরে সেবা গ্রহিতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বাগেরহাট পার্সপোর্ট অফিসে নিয়ম মেনে এলে, পার্সপোর্টের ফরম জমা দেওয়া যায় না। সময় মত পাসপোর্ট পাওয়া যায় না। দালালের হাতে টাকা তুলে দিলেই পাসপোর্ট পাওয়া যায়। পার্সপোর্টে জন্মতারিখ, নাম বা নামের অংশ সংশোধনের জন্যও নেওয়া হয় অতিরিক্ত টাকা।

প্রতিটি সংশোধন বা সংযোজনের জন্য দিতে হয় ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। পার্সপোর্ট অফিসের এই দালালির সাথে অফিসের আশপাশে এবং বিভিন্ন উপজেলায় অন্তত ৩০ জন যুক্ত রয়েছে। এসব দালালরা প্রতি পার্সপোর্টে সরকারি ফি‘র অতিরিক্ত ৫‘শ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দালালদের অভিযোগ এই টাকার একটা বড় অংশ দিতে হয় আঞ্চলিক পার্সপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। এই টাকা পার্সপোর্ট অফিসের সহকারি পরিচালক, অফিসসহকারী, কম্পিউটার অপারেটর, অফিস সহায়ক,আনসার সদস্যের মাঝে বিভিন্ন হারে ভাগাভাগি হয়।

সোমবার দুপুরে পার্সপোর্ট অফিসে কথা হয় ফকিরহাট উপজেলার শ্যামলসাহা নামের এক ব্যক্তির সাথে। তিনি বলেন, স্থানীয় একটি কম্পিউটারের দোকনদারকে ৮ হাজার ৫‘শ টাকা দিয়েছেন পার্সপোর্ট করার জন্য। যার কারণে তার পার্সপোর্ট করা অনেক সহজ হয়েছে। কিন্তু দোকানদারের নাম পরিচয় জানাতে রাজি হননি এই বৃদ্ধ।

আল মামুন নামের শরণখোলা উপজেলার এক যুবক বলেন, পার্সপোর্টে ফরম জমা দিলেই আগে জানতে চায় কোথা থেকে পূরণ করেছেন। তাদের পছন্দমত কম্পিউটারের দোকান বা লোকদের মাধ্যমে ফরম পূরণ করলে সাথে সাথে জমা নেয়। তিনদিন ঘুরে অনেক কষ্টে পার্সপোর্টের ফরম জমা দিয়েছি।

রামপাল উপজেলার উকিল উদ্দিন শেখ বলেন,সামনের দোকানদার আমার ফরম পূরণ করে ৬ হাজার ৪০০ টাকা নিয়েছিল ।আজ সোমার আমি পার্সপোট নিতে আসছি।

এমডি মুজাহিদ নামের এক ব্যক্তি বলেন, আবেদন করার সময় এপ্লিকেশন তৈরিতে আমাকে সারাসরি প্রশ্নে করেছে দুই হাজার টাকা দিলে কোন দৌড়াদৌড়ি করতে হবে না। আমি টাকা না দিয়ে এপ্লিকেশন ও প্রয়োজনীয় কাগজ পাত্র জমা দিতে গেলাম। তারা নিল না, আমার পেশার স্থানে লাল কালি দিয়ে গোল দিয়ে পাঠিয়ে দিল। পরে আবার সেই দোকানে গেলাম সে বলে ২হাজার টাকা হলে হবে, না হলে হবে না,,,তারপর ২হাজার টাকা দিলাম সেই একই কাগজ পত্র জমা নিল,পরে দেখলাম সেই দোকানদার WhatsApp-এ আমার কাগজ পত্রের ছবিতুলে অফিসের একজনের কাছে পাঠিয়ে দিল তারপর আমার কাগজে আর কোন সমস্যা নাই।

শুধু এরা নয়, প্রতিনিয়ত এমন হয়রানির শিকার হতে হয় পার্সপোর্ট অফিসে সেবা নিতে আসা সাধারণ মানুষের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দালাল বলেন, পার্সপোর্ট অফিসের আনসার আশিক ও জহির গেট থেকে পয়সার বিনিময়ে আবেদন ফরম জমা নিয়ে থাকে। আর অফিসের ভেতরে মোস্তাফিজ ও সাইফুল সরাসরি আমাদের কাছ থেকে টাকা নেয়। এই টাকা অফিস সহকারি থেকে শুরু করে সহকারি পরিচালক পর্যন্ত অফিসের সব কর্মকর্তা পায়।

আনসার সদস্য আশিক তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিষয়ে বলেন,আমরা ছোট চাকরি করি তাই অভিযোগের তির আমাদের দিকে। আমি একাজের সাথে জড়িত নই।

অফিস সহকারী মুস্তাফিজ ও সাইফুল তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেন।

বাগেরহাট আঞ্চলিক পার্সপোর্ট অফিসে প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকার শতাধিক লোক পার্সপোর্ট করতে আসেন। অর্ধশতাধিক মানুষ আসেন তাদের পার্সপোর্ট ডেলিভারী নিতে। টাকার হিসাবে প্রতিপার্সপোর্ট ১৫’ শত থেকে ২ হাজার টাকা গ্রহণ করলে প্রতিমাসে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকার দুর্নীতি হয় এই অফিসে ।

এদিকে পার্সপোর্টের ফরম জমা দিতে এসে হয়রানি ও গালিগালাজ করায় বাগেরহাট আঞ্চলিক পার্সপোর্ট অফিসের সহকারি পরিচালক এস এম এ সানিসহ তিনজনের বিরুদ্ধে এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে জেলা যুগ্ম জজ আদালতে মামলা করেছেন ফিরোজ হোসেন নামের এক ইটালি প্রবাসী।

তিনি বলেন, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে পার্সপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায়, দশ বছর মেয়াদ বৃদ্ধির আবেদন করি। নিয়ম অনুযায়ী আঙ্গুলের ছাপ প্রদানের নির্ধারিত তারিখে পার্সপোর্ট অফিসে উপস্থিত হয়ে লাইনে দাড়াই। দালাল ও কর্মচারীদের যোগসাজশে লাইনে না দাঁড়িয়েই বেশ কয়েকজন ভিতরে প্রবেশ করেন। বিষয়টির প্রতিবাদ করলে ভেতরে থাকা অফিস সহকারী আমার সাথে দূর্ব্যবহার করেন। খারাপ আচারণের প্রতিকার চেয়ে সহকারি পরিচালকের নিকট অভিযোগ করলে, জানালে তিনিও খারাপ ব্যবহার করেন। পরে দশ বছরের জন্য করা পার্সপোর্টের আবেদনে সময়সীমা কমিয়ে ৫ বছর করে দেয় পার্সপোর্ট অফিস। পরবর্তীতে পুনরায় দশ বছরের আবেদন করে পার্সপোর্ট নিই আমি। পার্সপোর্ট অফিসের এই খামখেয়ালির জন্য দুই মাসের বেশি সময় বাংলাদেশে অবস্থান করতে হয় আমাকে। এজন্য আর্থিক ভাবে বড় ক্ষতির মুখে পড়ে আমার প্রতিষ্ঠান। এই ক্ষতিপূরণ চেয়ে আমি আদালতের কাছে আদালতে মামলা করেছি। আশাকরি ন্যায় বিচার পাব।

জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর হোসেন বলেন, জেলা পাসপোর্ট অফিসের অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়ে প্রশাসনের কঠোর নজরদারি আওতায় আনা দরকার । এবং অফিসে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জনগণের সেবক মনে করা কাজ করতে হবে। তহলেই জনসাধারণ সহজে সেবা পাবে।

বাগেরহাট আঞ্চলিক পার্সপোর্ট অফিসের সহকারি পরিচালক এসএমএ সানি বলেন, আমার অফিসে কর্মরতদের মধ্যে কোন দালাল নেই। বাইরে যেসব দালাল রয়েছে, তাদের বিষয়ে জেলা প্রশাসনের সহযোগীতায় পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এছাড়া যেসব সেবা গ্রহিতা পার্সপোর্ট করতে এসে হয়রানির শিকার হন, তাদেরকে সরাসরি অভিযোগ দেওয়ার অনুরোধ করেন তিনি।

 




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!