খুলনা, বাংলাদেশ | ১৩ বৈশাখ, ১৪৩১ | ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

Breaking News

  জামালপুরে ধান মাড়াই করতে গিয়ে তাঁতী লীগ নেতার মৃত্যু
  দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ২
  মানিকগঞ্জের গোলড়া বাসস্ট্যান্ড এলাকায় গাড়িচাপায় দুই সবজি বিক্রেতা নিহত
  গাজীপুরের শ্রীপুরের একটি বহুতল ভবনের ফ্ল্যাট থেকে স্বামী-স্ত্রীর মরদেহ উদ্ধার

জ্ঞান রাজ্যের ক্ষুদে সম্রাট

মুফতি সাআদ আহমাদ

হজরত উমরের খেলাফত কাল। সমতা ও ন্যায়পরায়নতার শাসন কাল। ইসলামের বিজয় ও উন্নয়নের স্বর্ণযুগ। রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিটি সেক্টর নতুন আঙ্গিকে ঢেলে সাজিয়েছেন নবাগত আমিরুল মুমিনিন। যায়গায় যায়গায় সেনাক্যাম্প স্থাপন, বিজিত এলাকাসমূহের দায়ীত্বশীল নির্ধারণ এবং রাজস্ব আদায় ও বন্টনসহ একটি সুসংগঠিত দেশের সকল ব্যবস্থাপনা এখানে মজুদ।

তবে এই সকল কৃতিত্বের ভার কেবলই হজরত উমরের একার নয়। বরং তার পাশের কিছু যোগ্য লোক ছাড়া হয়তো তা সম্ভবও ছিল না। মুসলমানদের সার্বিক বিষয়গুলি নিয়ে তিনি যাদের সাথে পরামর্শ করতেন। যাদের অভিজ্ঞতা থেকে সর্বদা উপকৃত হতেন।

এর মাঝে প্রথম সারির ইসলাম গ্রহণকারী মুহাজির ও আনসার সাহাবীগন। আরো আছেন বদরে অংশগ্রহনকারী বিশিষ্টবর্গ। এরাই মূলত আমিরুল মুমিনিনের মজলিসে শুরা। যাদের পরামর্শ ছাড়া তিনি সহসা কদম বাড়ান না।

অন্যান্য দিনের ন্যায় আজকেও হজরত উমরের মজলিসে শুরার সদস্যরা একত্রিত হয়েছেন। মুসলমাদের কিছু জরুরী বিষয় নিয়ে আজকের এই বৈঠক। তবে আজকের মজলিসের চিত্র একটু ভিন্নরুপ। উপস্থিত সদস্যদের মাঝে এক নতুন মুখ। একেবারে টগবগে নওজোয়ান। বয়স এখনো বিশের কোটা পেরোয় নি। সে বদরের অংশগ্রহনকারীও নয় আবার সাহাবীদের মাঝে প্রথম সারীরও কেউ নয়। এতো অল্প বয়স্ক কোন ছেলে এই মসলিসে আজকেই প্রথম।

বিষয়টি দৃষ্টি কেড়েছে উপস্থিত অনেকের। সিনিয়র সাহাবীদের মজলিসে ছেলের বয়সি এই বালকের উপস্থিতি অনেকের কাছেই বিবৃতকর মনে হল। তবে হজরত উমরের সামনে কেউ মুখ খুললো না। সেদিনের মত কেবল মুখ বুজেই মজলিস শেষ করলেন।

কিন্তু একই ঘটনা পরপর কয়েক বৈঠকেই ঘটলো। ছেলেটি এখন এই মজলিসের নিয়মিত সদস্য হতে চলেছে। এক্ষেত্রে নিশ্চয় আামিরুল মুমিনিনের কোন ইঙ্গিত আছে। তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রশ্রয় ছাড়া এই ছেলে এমনটা করতে পারে না। বিষয়টি নিয়ে আজকে উপস্থিত মসলিসে কথা উঠালেন বিশিষ্ট বয়োবৃদ্ধ ও জ্ঞানবৃদ্ধ সাহাবী আবদুর রহমান বিন আউফ রা.।

বেশ স্পষ্ট ভাবেই তিনি বিষয়টির প্রতি আমিরুল মুমিনিনের দৃষ্টি আকর্শন করলেন। “সে তো আমাদের ছেলের বয়সী। অল্প বয়স্ক এই ছেলেটিকে সব সময় বড়দের মজলিসে রাখার অর্থ কি?” উপস্থিত আরো কয়েকজন একই সুরে সুর মেলাল। বোঝাই যাচ্ছে ছেলেরটির উপস্থিতিতে অনেকেই তুষ্ট নয়।

কিন্তু হজরত উমর অত্যন্ত বিচক্ষণ লোক। মানুষ চিনতে ভূল করার নন। তিনি মুঝে শুনেই ছেলেটিকে মজলিসে ডেকে নিয়েছেন। তাকে নিজের পাশে স্থান দিয়েছেন। তবে অভিযোগকারীদের দাবিও যুক্তিসংগত। উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের সাথে এতো অল্প বয়সী ছেলেটি সত্যিই বেমানান। তাই খুব বুঝে শুনেই এই ধাপ অতিক্রম করতে হবে। কথা নয় জবাব হবে কাজে। তার যোগ্যতার বহিপ্রকাশের মাধ্যমে। তার দক্ষতাই বলে দিবে সে এই মজলিসের যোগ্য কি না?

সেদিনের মত মসলিস সমাপ্ত ঘোষনা হল। অমিমাংশিত বিষয়টির অতৃপ্তি রয়ে গেল সকলের। হজরত উমর কেবল এতটুকু বললেন, সেও আপনাদের মতই কিছুটা জ্ঞান রাখে। তবে এতটুকুতে তিনি ক্ষান্ত হলেন না। কার্যত জবাব দানের সুযোগের অপেক্ষায় থাকলেন।

কিছু দিন বাদেই আবার মজলিসে শুরার জরুরী বৈঠক। নিয়মিত সদস্যরা ততক্ষনে উপস্থিত হয়ে গেছেন। এমন সময় আমিরুল মুমিনিন কক্ষে প্রবেশ করলেন। সাথে সেই নওজোয়ান ছেলেটিও আছে। ছেলেটিকে একেবারে নিজের পাশে বসালেন। আজকে তিনি বেশ উচ্ছাসিত।

যথারীতি মজলিস শুরু হল। প্রথমে হজরত উমর নিজেই মুখ খুললেন। সকলকে উদ্দেশ্য করে পবিত্র কুরআনের একটি সুরা পাঠ করলেন। সুরা নাসর। তারপর এক এক করে উপস্থিত সবাই কে জিজ্ঞাসা করলেন, এই সুরার বিষয়বস্তুর প্রতি লক্ষ করে আপনারা উত্তর দিন যে, এই সুরাটি কেন নাজিল হয়েছিল? অর্থাৎ সুরাটি নাজিল হওয়ার প্রেক্ষাপট কি?

ক্ষনিকের জন্য সুরা নাসরের বিষয়বস্তুর মাঝে হারিয়ে গেল গোটা মজলিস। মাত্র তিনটি আয়াতই তো। এখানে বলা হয়েছে, যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে এবং আপনি দেখবেন লোকেরা দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করছে। তখন আপনি আপনার প্রভূর শুকরিয়ার মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা আদায় করুন। নিশ্চয় তিনি অত্যান্ত ক্ষমাশীল।

নাহ! তেমন কোন সুক্ষ্ণ বিষয় কারো নজরে পড়ছে না। এই মজলিসের সদস্যদের কাছে নতুন করে জানতে চাওয়ার মত কিছু এখানে কোথায়? মক্কা বিজয়ের মূহুর্তের বর্ণনা। মহান আল্লাহ তার প্রিয় হাবীব সা. কে সাহায্য ও বিজয়ের মূহুর্তে তাকে ভুলে না যাওয়ার কথা বলেছেন। বরং শুকরিয়া ও ইস্তিগফারের নির্দেশ দিয়েছেন। এই তো! আর কি?

এক এক করে সকলের বলা শেষ। তবে ঘুরে ফিরে সবার একই জবাব। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে তাদের জবাবে আমিরুল মুমিনীন তৃপ্ত নন। তিনি নতুন কিছু শুনতে চাচ্ছেন। কেবল সেই নওজোয়ান বাকি। সে কি পারবে আমিরুল মুমিনীনের কাঙ্খিত উত্তর দিয়ে তাকে পরিতৃপ্ত করতে!

হজরত উমর ছেলেটির দিকে তাকালেন। আশা ভরসার সম্পূর্ণটা ওর প্রতি উজাড় করে তার মনযোগ আকর্শন করলেন। বললেন, আচ্ছা বলো দেখি, এই সুরার ব্যপারে তোমার কি অভিমত?

উত্তর যেন ওর মুখেই ছিল। কেবল জিজ্ঞাসা করার অপেক্ষা ছিল। বলল, এই সুরাতে তো প্রিয় নবীজি সা. এর পরলোক গমনের ঘোষনা দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ যখন মক্কা বিজয় হবে এবং মানুষ দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করতে থাকবে তখন আপনাকে যে উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা হয়েছিল তা পূর্ণ হয়ে গেছে। সুতরাং এখন আপনি তাসবীহ ও ইস্তিগফারে মগ্ন হোন। আপনার বিদায়ের ক্ষণ আসন্ন। একদমে কথাগুলো বলে তবেই থামলো ছেলেটি।

হজরত উমর এক মুখ হাসি দিয়ে নওজোয়ানের উত্তরের সমর্থন জানালেন। আরো বললেন, তুমি যা বলেছ আমারও এই ব্যপারে তাই জানা ছিল।

উপস্থিত সকলের বিস্মিত চোখগুলি তখনও বালকের চেহারার প্রতি আটকে আছে। এমন কথা তো আগে শুনিনি। কতবার সুরাটি পড়েছি ঠিক নেই কিন্তু এভাবে তো কখনো ভেবে দেখা হয়নি। ততক্ষনে আর কারো বুঝতে বাকি নেই যে, কেন তাকে এই মজলিসে স্থান দেওয়া হয়েছে? কী যিনিষ তাকে আমিরুল মুমিনীনের প্রিয় পাত্র করে তুলেছে।

আর এমনটা খুব আশ্চর্যের কিছু ছিল না। কারণ ছেলেটির জন্য স্বয়ং প্রিয় নবীজি সা. দুয়া করেছিলেন- হে আল্লাহ! আপনি তাকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন এবং পবিত্র কুরআনের মর্মকথা অনুধাবন করার তৌফিক দিন।

প্রিয় নবীজি সা. এর এই দুয়া তার জন্য এমন ফলপ্রসূ হয়েছিল যে, অনুর্ধ বিশ বছর বয়সেই তিনি ছোট বড় সকল সাহাবায়ে কেরামের মধ্যমনিতে পরিণত হন। এমনকি এই বয়সেই আমিরুল মুমিনীন হজরত উমরের পরামর্শ সভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসাবে মনোনীত হয়েছিলেন তিনি।

পরবর্তীতে এই অল্পবয়স্ক বালকই হয়েছিলেন ইসলামী ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মুফাস্সিরে কুরআন। কেবল তাফসীরই নয় বরং হাদিস, ফেকাহ, আরবী সাহিত্যসহ অন্যান্য বিষয়েও তার প্রতিভা ছিল ঈর্ষানীয়।

জ্ঞান রাজ্যের এই ক্ষদে সম্রাটের নাম হলো আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা.। নবীজি সা. এর চাচাত ভাই তিনি। জনৈক তাবেয়ী বলেন, আমি আব্দুল্লাহ বিন আব্বাসের এক ইলমের মসলিসে উপস্থিত ছিলাম। আল্লাহর কসম, গোটা আরবের উপর কুরাইশ বংশের গৌরভের জন্য এই ছেলেটির কৃতিত্বই তাদের পক্ষে যথেষ্ট। বুখারী-৪৯৭০ নং হাদিস অবলম্বনে।

খুলনা গেজেট/কেএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!