খুলনা, বাংলাদেশ | ২০ বৈশাখ, ১৪৩১ | ৩ মে, ২০২৪

Breaking News

  বাস-ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে আহত ৮
  গাজীপুরে দুই ট্রেনের সংঘর্ষ, স্টেশন মস্টারসহ সাময়িক বরখাস্ত ৩
  এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে : শিক্ষা মন্ত্রণালয়
পাউবো’র গাফিলতিতে বাড়ছে ক্ষতির পরিমাণ

জোয়ারের পানিতে ভাসছে দক্ষিণ উপকূল, একই স্থান ভাঙছে বার বার (ভিডিও)

তরিকুল ইসলাম

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের নদীগুলোর পানি অস্বাভাবিক বাড়ছে। বাঁধ ভেঙে কিংবা উপচেপড়ে প্রতিনিয়ত প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। প্রতিকূলতার টিকে থাকতে দল-মত নির্বিশেষে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করতে পূর্বে থেকেই অভ্যস্ত উপকূলের অবহেলিত মানুষ। এবারও তার ব্যতিক্রম নেই। তবে এবার স্বেচ্ছাশ্রমও যেন হার মানছে কপোতাক্ষ-শিবসার নোনা পানির কাছে। একদিকের পানি আটকাতে সক্ষম হলে অন্যদিক দিয়ে উপচে আসছে পানি। কোথাও আবার পুনরায় ভেঙে প্লাবিত হচ্ছে জনপদ। ভেসে যাচ্ছে ছোট-বড় বহু মৎস্য ঘের। পানির তোড়ে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বসতঘর-অভ্যন্তরিণ রাস্তাঘাট।

সোমবার (১৫ আগস্ট) ভোর থেকে বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত খুলনার কয়রার প্রায় আড়াই হাজার মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে চরামুখা গ্রামের কপোতাক্ষ নদের প্রায় ৩০০ মিটার ভাঙা রিংবাঁধ নির্মাণ শেষ করেন। আনুষাঙ্গিক সারঞ্জমাদির অভাবে ও জোয়ারের পানি এসে পড়ায় একশ’ মিটারের মত বাঁধ বাকী রেখে কাজ শেষ করতে হয়। বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই হাজারো মানুষের পরিশ্রমে নির্মাণ করা বাঁধ জোয়ারের পানিতে ভেসে যায়। ডুবে যায় ১০টিরও বেশি গ্রাম। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ১৫ হাজারের বেশি মানুষ।

সেখানকার মো. মাসুদ রানা নামের এক ইউপি সদস্য জানান, কপোতাক্ষ নদের প্রায় ২০ মিটার বাঁধ ১৭ জুলাই ভোরে ধসে নদীতে চলে যায়। সেসময় ভাঙা স্থানে স্বেচ্ছাশ্রমে প্রায় ১১শ’মিটার রিংবাঁধ দিয়ে পানি আটকানো সম্ভব হয়। এরপর ১৩ আগস্ট দুপুরে উচ্চ জোয়ারে ওই রিংবাঁধের ৫০ ফুটের মতো ভেঙে গিয়েছিল। তাৎক্ষণিকভাবে স্থানীয় কয়েকশ’ মানুষের চেষ্টায় তা মেরামত করা হয়। সেই বাঁধটির ৪শ’ মিটারের মত ১৪ আগস্ট ফের ভেঙে যায়। ১৫ আগস্টও আড়াই হাজারের মত লোক একত্রে কাজ করেও সফল হতে পারিনি। তিনি আরও বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের চরম গাফিলতিতে আজ আমাদের এই বড় ক্ষতি হয়ে গেলে। বাঁধ ভাঙার পরে ২৬ দিন সময় পেলেও তারা রিংবাঁধে একচাপ মাটিও ফেলেননি। শুধু পরিদর্শন ও সমস্যা হবে না এমন আশ্বস্ত করেই আমাদের বিপদে ফেলেছে।

সোমবার (১৫ আগস্ট) বাঁধে সকলের সাথে কাজ করেন জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ইঞ্জিনিয়ার জিএম মাহবুবুল আলম। কাজের শেষে তিনি বলেন, বাঁশ ও ব্যাগ স্বল্পতায় কাজে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড যে সরঞ্জামাদি দিয়েছিল সেটা যথেষ্ট ছিল না। যথেষ্ট মানুষ থাকার পরেও বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন করতে পারিনি। জোয়ার এসে পড়ে। তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।

একই উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোস্তফা কামাল বলেন, দোশহালিয়া, গোবিন্দপুর স্লুইস গেটসহ বেশ কয়েকটি স্থানে দিয়ে নদীর পানি উপচে লোকালয়ে এসেছে। স্থানীয়রা মেরামত করলেও বাঁধের দূরাবস্থা থাকায় চরম ঝুঁকিতে রয়েছেন তারা। তিনি অভিযোগ করে বলেন, দোশহালিয়ার মাহবুব মোল্লার বাড়ি সংলগ্ন স্থানে পাউবো ৫/৬ বার ডিপিএম এর মাধ্যমে কাজ করেছেন। তারপরেও সেখানে যথাযথ কাজ হয়নি। ঠিকাদারের সাথে পাউবো কর্মকর্তার গোপন আতাঁত থাকায় মান ঠিক থাকে না বলেও অভিযোগ তার।

তবে পাউবো’র বিরুদ্ধে সব অভিযোগ অস্বীকার করে উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. মশিউল আবেদীন বলেছেন, আমরা পর্যাপ্ত পরিমাণে বাঁশ, সিনথেটিক ব্যাগ দিয়ে তাৎক্ষণিক সহযোগীতা করছি। আমরা কোন অনিয়ম করি না, প্রশ্রয়ও দেই না।

এছাড়া কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশী, মহারাজপুর, কয়রা সদর ইউনিয়নের বেশ কিছু স্থান দিয়ে নদীর পানি উপচে প্রবেশ করেছে। সেসব স্থানে রাত-দিন স্বেচ্ছাশ্রমে মানুষ কাজ করছেন।

এদিকে ১৪ আগস্ট দুপুরে বৈরী আবহাওয়ায় জোয়ারের প্রবল পানির চাপে শিবসার সোলাদানা ইউনিয়নের পাউবোর ২৩নং পোল্ডারের বয়ারঝাঁপা এলাকার ভাঙ্গাহাড়িয়া নামক স্থানে প্রায় ৩০ ফুট ওয়াপদার বাঁধ ভেঙ্গে ও কপোতাক্ষের মাহমুদকাটি ও রামনাথপুরে উপচে পড়া পানিতে লোকালয়ে পানি ঢুকে বিস্তির্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। তবে সোমবার স্থানীয়রা সেখানকার বাঁধ নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছে বলে জানান ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান। তিনি আরও জানান, তার ইউনিয়নে প্রায় ১৫শ’ ফুট বাঁধ খুবই দুর্বল রয়েছে।

হরিঢালী ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য শংকর বিশ্বাস জানান, রোববার জোয়ারের লোনা পানিতে মাহমুদকাটির জেলে পল্লীসহ রামনাথপুর এলাকার বহু ঘর-বাড়ি প্লাবিত হয়ে মারাত্মক ক্ষতি হয়।

রবিবার (১৪ আগস্ট) দুপুরের জোয়ারে স্বাভাবিকের চেয়ে তিন থেকে চার ফুট পানি বৃদ্ধি পেয়ে বাগেরহাটের কচুয়া, বাগেরহাট সদর, মোরেলগঞ্জ, রামপাল, মোংলা ও শরণখোলা উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। শুধু নিম্নাঞ্চল নয়, জোয়ারের পানিতে বাগেরহাট শহরের খানজাহান আলী সড়ক, রাহাতের মোড়, বাসাবাটি, মুনিগঞ্জ, মেইনরোড, প্রধান ডাকঘর সড়কসহ বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে গেছে। তলিয়ে গেছে মোরেলগঞ্জ ও মোংলা পৌরসভার বিভিন্ন এলাকা। জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, পরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থার অভাব ও নদী খাল দিয়ে পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

মোরেলগঞ্জে জোয়ারের পানিতে দিনে দু’বার প্লাবিত হচ্ছে মোরেলগঞ্জ পৌর বাজারসহ নিম্নাঞ্চলের ২০টি গ্রাম। রবিবার বেলা ১১ টার দিকে শহরের কাপুডিয়াপট্টি সড়ক, কাঁচা বাজার, কেজি স্কুল সড়ক, ফেরীঘাট সংলগ্ন কালাচাঁদ মাজার এলাকা, সানকিভাঙ্গা, বারইখালী, গ্রাম প্লাবিত হয়ে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৩/৪ ফুট পানি বৃদ্ধি পেয়েছে গত ৪ দিনে। দুপুরের রান্না হচ্ছে না বারইখালী ফেরিঘাট এলাকা ও খাউলিয়া ইউনিয়নের নিশানবাড়ীয়া গ্রামে। পানিতে তলিয়ে গেছে ওই সব এলাকার ঘরবাড়িও।

সাতক্ষীরার শ্যামনগরের উপকূলীয় অঞ্চলের কৈখালী, গাবুরা, পদ্মপুকুর, বুড়িগোয়ালিনী, রমজাননগরসহ বিভিন্ন এলাকায় বেড়িবাঁধে ছাপিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নে। এই ইউনিয়নের কুড়িকাউনিয়া ও হরিষখালী এলাকায় পাউবো’র বেড়িবাঁধে নতুন করে ভাঙন দেখা দিয়েছে।

গাবুরা ইউপি চেয়ারম্যান জি.এম মাসুদুল আলম বলেন,  গাবুরা ইউনিয়নের ৯নং সোরা, লেবুবুনিয়া, নাপিতখালী গ্রামসহ বেশ কিছু এলাকায় পাউবো’র বেড়িবাঁধ ছাপিয়ে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করছে। এতে নদ-নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষ আতঙ্কে রয়েছে।

কৈখালী ইউপি চেয়ারম্যান শেখ আব্দুর রহিম বলেন, সীমান্তের কালিন্দী নদীর পানি কৈখালী বিজিবি ক্যাম্প ও ফরেস্ট অফিস সংলগ্ন বেড়ীবাঁধ ছাপিয়ে লোকালয়ে ঢুকেছে। এছাড়াও পূর্ব কৈখালী আশ্রয়ণ প্রকল্প সংলগ্ন স্লুইচগেটের দুই পাশ দিয়ে, নিদয়া, কাঠামারী, নৈকাটি এলাকায় বেড়িবাঁধ ছাপিয়ে পানি প্রবেশ করছে। কিছু কিছু জায়গায় এলাকার মানুষ নিজে উদ্যোগে সেগুলো মেরামত করার চেষ্টা করছে।

শ্যামনগরের পদ্মপুকুর ইউপি চেয়ারম্যান আমজাদুল ইসলাম বলেন, নদীতে পানি বৃদ্ধির কারণে ঝাঁপা, পাখিমারা, কামালকাটি, চন্ডিপুর, চাউলখোলা, বন্যতলা এলাকার কিছু অংশের বেড়িবাঁধের অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা স্বেচ্ছাশ্রমে সেগুলো সংস্কার করেছি।

খুলনার কয়রা পাউবো’র সাতক্ষীরা বিভাগ-২–এর আওতায়। জানতে চাইলে বিভাগের পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহনেওয়াজ তালুকদার বলেন, কয়রায় প্রথম বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর রিং বাঁধ দেওয়া হয়। কিন্তু সেটি মজবুত করা যায়নি। সেখানে মাটির মান খুব বেশি ভালো নয়। তাছাড়া জোয়ার-ভাটার কারণে বেশি সময় কাজ করা যায় না। এ কারণেই মূলত বাঁধটি বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সাতক্ষীরা সম্পর্কে তিনি জানান, সাতক্ষীরা জেলার কয়েকটি পোল্ডারে প্রায় ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুকিপূর্ণ রয়েছে। তবে ঝুঁকিপূর্ণ এসব বাঁধের উপর আমাদের নজরদারি রয়েছে।

 

 

 




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!