যশোরের চৌগাছায় সরকারি বাওড় মৎস্য প্রকল্পের অধীন মর্জাদ বাওড়ের জমি ব্যক্তিমালিকানায় ইজারা দিয়ে লাখ লাখ টাকা বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। বাওড়টির ব্যবস্থাপক মাহবুবুর রহমান এবং নৈশ প্রহরী লাল্টুর বিরুদ্ধে এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রী, সচিব, মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন বাওড়ের হ্যাচারি অংশ লিজ নিয়ে মাছ চাষকারী মোঃ ভুট্টো মিয়া।
ওই মাছ চাষীর অভিযোগ সম্প্রতি বাওড় ব্যবস্থাপক বাওড়ের প্রায় ৫ হাজার ট্রাক মাটি বিভিন্ন ইটভাটায় বিক্রি করে দেন। এতে তিনি বাঁধা দেয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে বাওড় ব্যবস্থাপক তাকে মৌখিক চার লাখ টাকা চুক্তিতে চাষ করতে দেয়া বাওড়ের হ্যাচারি অংশের প্রায় চল্লিশ বিঘার ভেড়ি ছেড়ে দিতে নোটিশ দেন। তিনি ছেড়ে দেয়ার প্রস্তুতি হিসেবে পানি সেচ করে কমিয়ে আনেন। এরপরও ব্যবস্থাপক তার অনুগত কিছু ব্যক্তিকে দিয়ে কিটনাশক প্রয়োগ করে তাঁর মাছ মেরে ফেলেছেন।
এরইমধ্যে ওই মাছ চাষী লিখিত অভিযোগের অনুলিপি যশোরের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, বাওড় মৎস্য প্রকল্পের যশোর কার্যালয়, চৌগাছা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও চৌগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে জমা দিয়েছেন। কিটনাশক প্রয়োগে মাছ মারার বিষয়ে চৌগাছা থানায় লিখিত অভিযোগও করেছেন তিনি।
মন্ত্রী বরাবর লিখিত অভিযোগে ভুট্টো মিয়া বলেন, গত তিন/চার বছর আগে চৌগাছা উপজেলার হাকিমপুর ইউনিয়নের হাজীপুরে অবস্থিত মর্জাদ বাওড়ের তৎকালীন ব্যবস্থাপক আশরাফ হোসেন আমাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে মর্জাদ বাওড়ের পড়ে থাকা হ্যাচারী অংশের ৪০ বিঘা ভেড়িতে মাছ চাষ করতে বলেন। দেন দরবারের পর তার সাথে প্রতিবছর চার লক্ষ টাকা মৌখিক চুক্তিতে আমি বাওড়ের হ্যাচারী অংশের ৪০ বিঘা জমিতে মাছ চাষ করতে সম্মত হই। সে হিসেবে তখনকার ব্যবস্থাপক আশরাফ হোসেনের কাছে দুই বছরে আট লক্ষ টাকা পরিশোধ করি। এরপর তিনি বদলী হয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার সময় নতুন ব্যবস্থাপক মাহবুবুর রহমানের সাথে তিনি নিজে একই মৌখিক চুক্তিতে (বছরে চার লক্ষ টাকা) আমি মাছ চাষ করবো বলে মুখোমুখি করে দিয়ে যান। বর্তমান বাওড় ব্যবস্থাপক মাহবুবুর রহমান আমার কাছ থেকে চার লক্ষ টাকা মূল্যের টেন্ডার সাইজের ১৩৭ (একশত সাইত্রিশ) মন মাছ গত আশি্বন/কার্তিক মাসে বুঝে নিয়েছেন। যা আমার মাছের ভেড়িতে কাজ করা জেলেরা স্বাক্ষী আছেন। আমি চাষ করার আগে কালিগঞ্জের মাহবুব নামে একজন চাষী সেখানে তিন বছর মাছ চাষ করেছেন।
একইভাবে তিনি বাওড়ের কালিগঞ্জের নিত্যানন্দি গ্রামের অংশের ৩০ বিঘা, ১৪ বিঘা ও ২০ বিঘা জমির ৩টি ভেড়ি কালীগঞ্জের কাস্টভাঙা ইউপি চেয়ারম্যান আইয়ূব হোসেনের কাছে ৮০ হাজার টাকা বাৎসরিক লিজ চুক্তিতে, চৌগাছার পাতিবিলা গ্রামের বিদ্যুৎ হোসেনের কাছে পাতিবিলা ইউনিয়ন অংশের মুক্তদাহ গ্রামের ১৩ বিঘার দুটি ভেড়ি বাৎসরিক এক লক্ষ টাকা লিজ চুক্তিতে মাছ চাষ করতে দিয়েছেন।
এছাড়া বাওড়ের পাতিবিলা ইউনিয়নের মুক্তদহে অংশের সাতটি পুকুরের মধ্যে ৫ বিঘার এক নম্বর পুকুর মুক্তদহ গ্রামের ফুলু ঠাকুরকে ২৫ হাজার টাকা, ৪ বিঘার দুই নম্বর পুকুর তেঘরী গ্রামের ইসমাইলকে ৩০ হাজার টাকা, ৬ বিঘার তিন নম্বর পুকুর তেঘরি গ্রামের আশাদুলকে ৩০ হাজার টাকা, ৭ বিঘার চার নম্বর পুকুর তেঘরী গ্রামের আলমগীরকে ৩৫ হাজার টাকা, ৭ বিঘার পাঁচ নম্বর পুকুর মুক্তদহ গ্রামের ইলাহিকে ৩৫ হাজার টাকা, ৮ বিঘার ছয় নম্বর পুকুর পৌরসভার পাঁচনমনা গ্রামের নূর মোহাম্মদকে ৪০ হাজার টাকা এবং ৮ বিঘার সাত নম্বর পুকুর তেঘরী গ্রামের রেজাকে ৪০ হাজার টাকা বাৎসরিক চুক্তিতে লিজ দিয়েছেন। গত ছয়/সাত বছর ধরে এসব চাষীরা মাছ চাষ করে আসছেন। প্রতি বাংলা সনের জৈষ্ঠ মাসে বাওড়ের নৈশ প্রহরী সিংহঝুলী গ্রামের লাল্টু এসব মাছ চাষীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে থাকেন।
মৌখিক চুক্তিতে লিজগ্রহণ করে মাছ চাষকারী চাষীরা তাদের সাথে একান্ত আলাপে লিজ নিয়ে মাছ চাষের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তাদের কেউ সাত বছর, কেউ পাঁচ বছর কেউবা তিন বছর ধরে এভাবে লিজ নিয়ে চাষ করছেন বলে জানান। তাঁরা জানান, প্রতি বাংলা সনের জৈষ্ঠ মাসে আমাদের কাছ থেকে নৈশপ্রহরী লাল্টু আমাদের কাছ থেকে ইজারার টাকা বুঝ করে নিয়ে যান।
এদিকে বাওড়ের মাটি ইটভাটায় বিক্রি করে দেয়ার মৌখিক অভিযোগ পেয়ে গত শুক্রবার চৌগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানা হাকিমপুর ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তাকে ঘটনাস্থলে পাঠান। তিনি ঘটনাস্থলে যেয়ে মাটি চুরি করে বিক্রি করার বিষয়টির প্রমাণ পেয়েছেন।
হাকিমপুর ইউনিয়ন ভুমি সহকারী কর্মকর্তা দলীল উদ্দিন মোবাইলে বলেন, ইউএনও স্যারের নির্দেশে ঘটনাস্থলে যেয়ে মাটি বিক্রির ঘটনার প্রমাণ পেয়েছি। আমি যাবার আগেই এই মাটি বিক্রি করেছে। তিনি বলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহোদয় নির্দেশ দিলে এ বিষয়ে পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেব।
মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও অভিযুক্ত বাওড় ব্যবস্থাপক মাহবুবুর রহমানের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানা বলেন, এবিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। মৌখিক অভিযোগ পেয়েই ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তাকে ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়। তিনি মাটি বিক্রির সত্যতা পেয়েছেন। তিনি আরও বলেন আমি নিজে বাওড় ব্যবস্থাপককে একাধিকবার কল করলেও তিনি মোবাইল সংযোগ বন্ধ রেখেছেন। তাঁকে সংবাদ পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রয়োজনে নিয়মিত মামলা করা হবে।
খুলনা গেজেট/ টি আই