যশোরের চৌগাছা উপজেলার হাজরাখানা গ্রামে আজও কোন গরু জবাই হয়নি। এমনকি কোরবানিতেও কেউ গ্রামের মৌজায় গরু জবাই করেন না। গ্রামের যারা কোরবানি করেন তারা গ্রামের পাশের মৌজায় গিয়ে গরু জবাই করে গোশত বাড়িতে আনেন।
এলাকাবাসী সৃএে জানা গেছে, উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের বৃহৎ গ্রাম হাজরাখানা। একটি গ্রাম নিয়েই ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড গঠিত। গ্রামে ‘হাজরাখানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ ও ‘হাজরাখানা পীর বলুহ দেওয়ান দাখিল মাদরাসা’ রয়েছে। গ্রামের পূর্বপ্রান্তে কপোতাক্ষ নদের পাড়ে রয়েছে এ অঞ্চলের পীর বলুহ দেওয়ানের মাজার। যে মাজার ঘিরে প্রতি বছর বাংলা সনের ভাদ্র মাসের শেষ মঙ্গলবার থেকে হয় ‘বলুহ মেলা’। মেলায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লাখ লাখ মানুষের আগমন ঘটে। তিনদিন ধরে পীরের মাজারকে কেন্দ্র করে ঔরস অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। গ্রামের মানুষ পীর বলুহ দেওয়ানের প্রতি সম্মান দেখিয়ে কেউ গ্রামে গরু জবাই করে না। এমনকি গরু কোরবানি দিলেও গ্রামের মৌজায় না দিয়ে পাশের মৌজায় কোরবানি করে গোশত প্রস্তু করে তবেই বাড়িতে আনেন।
জনশ্রুতি আছে গ্রামে গরু জবাই করলে তার বা তাদের শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এই ভয়ে কেউ গ্রামে আর গরু জবাই করেন না।
এ বিষয়ে মাজারের পাশের কিটনাশক ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম (৫৫) জানান, আমরা জন্মের পর থেকে দেখে আসছি গ্রামে কোন গরু জবাই হয় না। এমনকি কোরবানিতেও কেউ গ্রামের মধ্যে গরু জবাই করে না। তবে গ্রামের অনেকেই গরুর গোশত খান। তারা গোশত কিনে এনে বাড়িতে রান্না করে খেয়ে থাকেন। আর যারা গরু কোরবানি করেন তারা গ্রামের পাশের বাটিকামারি মৌজায় গিয়ে কোরবানি করে গোশত বাড়িতে নিয়ে আসেন।
গ্রামে গরু জবাই করে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়া গরু ও গোশত ব্যবসায়ী (কশাই) পার্শ্ববর্তী পেটভরা গ্রামের আনোয়ার হোসেন বলেন, কয়েক বছর আগে হাজরাখানার রেজাউল নামে একজনের বাড়িতে মৃত ব্যক্তির খানা ছিলো। সেখানে আমি, বাবু (পরে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন) এবং রেজাউল নামে তিনজনকে একটি গরু জবাই ও ঝুড়ে-কুটে (গোশত প্রস্তুত করা) দিতে বলে। যার খানা ছিল তিনিসহ আমরা তিনজন পরস্পর আত্মীয়। রাত ১২টার পরে আমরা গরু জবাই করি। এর ১০ মিনিট পরেই খুব জোরে বাতাস হতে থাকে, চারিদিক থেকে জোরে বাতাস এবং বাঁশ ঝাড়ে আমাদের ঝুপে (জাপটে) ধরে। পাশেই খুব বিশ্রি (শুকুরে কচু খাওয়ার মতো) শব্দ হতে থাকে। আমি ভয় পেয়ে যাই। বাবুকে বলি এসব কি হচ্ছে। বাবুর স্ত্রী ভয়ে ঘরে থাকতে পারছিলো না। বাবু কিচ্ছু হবে না বলে সেখানে খড়-কুটোতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। আমরা পাশে আগুন জ্বালিয়ে গোশত কোটা-বাছার কাজ করি। ওই গোশত কাটার সময়ই আমার পায়ে ছুরিতে লেগে একটা শির কেটে যায়। এরপর আমি দীর্ঘদিন রোগ ভোগ করি। আমার পায়ে তিনবার অপারেশন করা লেগেছে। জমি বিক্রি করে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে চিকিৎসা করে এখন কিছুটা সুস্থ আছি। বাবু ওই গোশত কাটার কিছুদিন পরেই অল্প বয়সে অপঘাতে (সড়ক দুর্ঘটনায়) মারা যায়। আর রেজাউল পড়ে গিয়ে মাজা ভেঙে অসুস্থ অবস্থায় আছে। তিনি বলেন, আমাদেরসহ সবারই ধারনা (যদিও আল্লাহ মাবুদ’ই ভালো জানেন) গরু জবাই করার কারনে এই অবস্থা হয়েছে। আমরা গ্রামের বহু মানুষের অনুরোধ উপেক্ষা করে জোর করেই গরু জবাই করেছিলাম। তিনি বলেন, ওই গ্রামে গরু জবাই হয়ই না। আমরা বিশেষ করে বাবু জোর করেই গরু জবাই করেছিলাম।
পীর বলুহ দেওয়ান মাজারের খাদেম জয়নাল শাহ্ বলেন, আমার কয়েক পুরুষ এই মাজারের খাদেম। জন্মের পর থেকে দেখে আসছি গ্রামের মানুষ গ্রামে গরু জবাই করেন না। পীর সাহেবের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে প্রজন্মের পর প্রজন্মের মানুষ গ্রামে গরু জবাই করেন না। তবে যারা গরুর গোশত খান, তারা নিজেদের বাড়িতে রান্না করে খেতে পারেন। এতে কেউ কাউকে বাধা প্রদানও করে না। তিনি আরো বলেন, যেমন আমাদের মেয়ে বিয়ে দেয়া আছে। মেয়ে-জামাইয়ের বাড়ির লোকজন গরুর গোশত খান, আমরা খাইনা। তারা আমাদের বাড়িতে আসলে গরু ছাড়া অন্য হালাল যে কোন গোশত দিয়ে আপ্যায়ণ করে থাকি। আবার তাদের বাড়িতে গেলে আমরা গরুর গোশত খাইনা।
গ্রামের ইউপি সদস্য মনিরুজ্জামান মিলন বলেন, গ্রামে প্রায় সাড়ে ১৭০০ ভোটার ও ২৭০০ অধিক বাসিন্দা আছেন। তাদের অনেকেই গরুর গোশত খান। তবে গ্রামে গরু জবাই করেন না। যারা করেন, তারা পাশ্ববর্তী মৌজায় জবাই করে বাড়িতে গোশত নেন।
নারায়ণপুর ইউপি চেয়ারম্যান ও হাজরাখানা গ্রামের বাসিন্দা শাহিনুর রহমান শাহিন বলেন, আমরা জন্মের পর থেকেই দেখে আসছি গ্রামে গরু জবাই করা হয় না। তবে এ বিষয়ে কেউ কাউকে নিষেধ করে না বা বাধা দেন না। এ কাজে পীর সাহেবের নিষেধ আছে।
খুলনা গেজেট/এসজেড