ভারতের উড়িষ্যায় ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার সাক্ষী হলেন ঝিনাইদহের কলেজ শিক্ষক দম্পত্তি। চোখের সামনে মৃত্যু ও আহত মানুষকে দেখে তিনি ও তার স্ত্রী বাকরুদ্ধ হয়ে যান। যার বর্ণনা দিতে শিক্ষক আক্তারুজ্জামান হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, আহত শত শত মানুষের বুকফাটা আর্তনাদ এখনো তার কানে বাজছে।
শিক্ষক আক্তারুজ্জামান বলেন, শুক্রবার সন্ধ্যায় ট্রেনের বগিতে বসে হঠাৎ বিকট শব্দ শুনতে পেলাম। সেই সঙ্গে ট্রেনটি জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল। পিছনের বগিতে থাকায় বুঝতে পারছিলাম সামনে কিছু একটা হয়েছে। এটা দেখার চেষ্টা করলাম, ভেসে আসছিল কান্না ও গগন বিদারি চিৎকারের শব্দ। পুলিশ ও অ্যাম্বুলেন্সের অসংখ্য গাড়ির শব্দ। কিন্তু কিছু সময়ে মধ্যে তাদেরকে ট্রেনের কাছ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। শুধু যাওয়ার সময় চোখের সামনে দেখতে পেলাম অসংখ্য আহত ও নিহত ব্যক্তিদের নিয়ে টানাটানি করা হচ্ছে। আহতরা চিৎকার করছেন, বাঁচাও-বাঁচাও বলে। তাদের উদ্ধারে কাজ করে যাচ্ছেন রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্থানীয় মানুষ।
ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার সামন্তা গ্রামের পাখরাইল গ্রামের বাসিন্দা আক্তারুজ্জামান। ওই গ্রামটি যশোরের চৌগাছা উপজেলার সীমান্তবর্তী। তিনি মহেশপুর সরকারি পদ্মপুকুর শেখ হাসিনা ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক। স্ত্রী নূরজাহানের চোখের চিকিৎসার জন্য দুর্ঘটনা কবলিত করমন্ডল এক্সপ্রেস ট্রেনে ভেলর যাচ্ছিলেন। তিনি দুর্ঘটনার পর রাতে বাড়িতে ফোন করে এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় স্ত্রীসহ তিনি প্রাণে বেঁচে গেছেন।
এরপর সাংবাদিকরা তার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, স্ত্রী নুরজাহানের চোখের সমস্যা। বেশ কয়েক দফা ভারতে চিকিৎসা করিয়েছেন। কিন্তু ভালো হয়নি। এবার সিদ্ধান্ত নেন ভেলর গিয়ে চিকিৎসা করাবেন। সেই সিদ্ধান্তে গত ১ জুন স্বামী-স্ত্রী ভারত যান। এরপর ট্রেনের টিকিট নিয়ে শুক্রবার দুপুরে শালিমার স্টেশনে হাজির হন। ৩টা ২০ মিনিটে তাদের বহনকারী করমন্ডল ট্রেনটি স্টেশন থেকে চেন্নাইয়ের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। সন্ধ্যা ৭টার দিকে তারা যখন উড়িষ্যার বালাসোর জেলার বাহাঙ্গাবাজার এলাকায় পৌঁছান তখন ট্রেনটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। তারা বিকট শব্দ ও প্রচন্ড ঝাঁকুনি অনুভব করেন। ট্রেনের মধ্যে থাকা হাজারো মানুষ কান্নাকাটি শুরু করেন। তারাও বুঝে নেন ট্রেনটি দুর্ঘটনায় পড়েছে।
আক্তারুজ্জামান বলেন, তারা ছিলেন ট্রেনের ২-এ নম্বর এসি বগিতে। তাদের সামনে ছিলো আরো কয়েকটি বগি। তারা দ্রুত ট্রেন থেকে নেমে সামনে কী ঘটেছে দেখার চেষ্টা করেন, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সেখানে উপস্থিত হয়ে স্থানীয় মানুষ তাদের নামতে বাধা দেন। তারা উদ্ধার কাজ শুরু করেন, আর যারা অক্ষত আছেন তাদের সরিয়ে নেয়া হয়।
তিনি বলেন, ট্রেন থেকে তাদের সরিয়ে নেয়ার পর তারা বাসযোগে কিছুটা দূরে একটি এলাকায় গিয়ে অবস্থান করেন। সেখানকার নাম তিনি ভুলে গেছেন। পরদিন সকালে ভুবনেশ্বর স্টেশন থেকে আরেকটি ট্রেনে তাদেরকে তুলে দেয়া হয়েছে। তারা এখন ভেলরের পথে রয়েছেন। ঘটনাস্থল থেকে বাসে ওঠা পর্যন্ত সময়টুকু তাদের আতঙ্কে কেটেছে। কী হচ্ছে সামনে, তা তারা কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। শুধুই শুনেছেন চিৎকার ও চেঁচামেচির শব্দ। অনেক বাংলাদেশি ছিলো এই ট্রেনে, তারা কেমন আছেন সেটাও বোঝা যাচ্ছিল না। শুধু তারা ভালো আছেন এ খবরটা স্বজনদের কাছে মুটোফোনে জানিয়ে দিচ্ছিলেন।
এভাবে কিছু সময় যাওয়ার পর ট্রেনের কর্মকর্তারা এসে তাদের সরিয়ে দেন। গোটা রাত তারা থেকেছেন পাশের একটি শহরে। শনিবার সকালে মাইকে তাদের ভুবনেশ্বর স্টেশনে যাওয়ার অনুরোধ করা হয়। তারা সেখানে গেলে পন্ডিশ্রী নামে আরেকটি ট্রেনে তাদের তুলে দেয়া হয়।
আক্তারুজ্জামান জানান, ঘটনার পর কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। তবে যখন তাদের সরিয়ে নেয়া হচ্ছিলো, তখন দেখতে পান হতাহতদের নিয়ে ছুটাছুটি, যা দেখে খুবই খারাপ লেগেছে। আহত মানুষের চিৎকার তাদের কষ্ট দিয়েছে, চোখের পানি ঝরেছে। তারপরও তিনি ভেবেছেন এত বড় একটি দুর্ঘটনায় পড়েও আল্লাহ তাদেরকে ভালো রেখেছেন।
আক্তারুজ্জামানের স্ত্রী নুরজাহান জানান, তারা ট্রেনের যে বগিতে ছিলেন, সেখানে দু’জন বাংলাদেশি ছিলো। তবে পেছনের অন্য কামরাগুলোতে আরো অনেক বাংলাদেশি ছিলো। পরের ট্রেনে তাদের তুলে দেয়ার পর বুঝতে পেরেছেন অনেক বাংলাদেশি দুর্ঘটনা কবলিত ট্রেনে ছিলেন। তবে কারো কোনো তথ্য তারা পাননি। দেশের কারো মৃত্যুর খবরও তাদের কানে পৌঁছায়নি।
খুলনা গেজেট/এনএম