খুলনা, বাংলাদেশ | ৩ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ | ১৭ মে, ২০২৪

Breaking News

খুলনার চুইঝাল সংস্কৃতি

ড. খ. ম. রেজাউল করিম

চুইঝাল দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থানীয় প্রজাতি। এটি মূলত গ্রীষ্ম অঞ্চলের লতাজাতীয় বনজ ফসল হলেও দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশে ভালোভাবে জন্মে। বিশেষ করে, ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, বার্মা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড চুইচাষের জন্য উপযোগী। বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে জন্মালেও বৃহত্তর খুলনা (খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট) জেলায় চুইঝালের উৎপাদন সবচেয়ে বেশি। এক হিসেব মতে, খুলনা বিভাগের ৪ জেলায় খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও নড়াইলে মোট ১১০ হেক্টর জমিতে চুইয়ের চাষ হচ্ছে। এতে মোট উৎপাদন প্রায় ১৯০ মেট্রিক টন।

এক হিসেব মতে, ৩ হাজার ৫৭০ জন কৃষক এসব জেলাতে চুইচাষের সঙ্গে যুক্ত। চুইচাষের জন্য আলাদা জমির প্রয়োজন পড়ে না। বিভিন্ন গাছের সাথে এই লতাজাতীয় গাছটির আরোহণের ব্যবস্থা করলেই এ গাছ সহজে বেড়ে উঠতে পারে। সুপারি, মেহগনি, আম, জাম, কাঁঠাল, শিরীষ, নারিকেল, জিয়াল ইত্যাদি গাছকে অবলম্বন করে চুইঝাল বেড়ে উঠতে পারে। চুইগাছ যত মোটা হয়, এর দামও তত বেশি হয়। বর্তমান বাজারে প্রতি কেজি চুই মানভেদে ৪০০ থেকে ১৫০০ টাকা দরে বিক্রি হয়। দেশে লতা কাটিং অর্থাৎ চুইয়ের কান্ড থেকে যে আকর্ষি বের হয় তা শিঁকড়সহ কেটে রোপণ করে সহজে চারা তৈরি করা হয়। চুইগাছ রোপণের এক বছর পর তা খাওয়ার উপযোগী হয়। তবে গাছ পূর্ণাঙ্গ হতে ৭ থেকে ৮ বছর সময় লাগে। চুইগাছের গড়ন অনেকটা পানের লতার মতোই, তবে এর ধূসর বর্ণের কান্ড অনেক মোটা এবং পাতা খানিকটা লম্বা ও পুরু হয়। ঝাঁঝালো স্বাদযুক্ত এই কান্ড ছোট ছোট টুকরো করে কেটে সেগুলো ফালি করে তরকারিতে ব্যবহার করা হয়। রান্নার পর গলে যাওয়া চুইঝালের টুকরোগুলো চুষে বা চিবিয়ে এর স্বাদ গ্রহণ করা হয়। খেতে বেশ ঝাল হলেও এর একটা অন্য রকম স্বাদ ও গন্ধ রয়েছে। এই স্বাদ-গন্ধ, ঐতিহ্য সবমিলিয়ে বাসাবাড়ি থেকে শুরু করে হোটেল, রেস্তোরা সবখানেই সমান কদর বিশেষ ধরনের এই মশলাটির। চুইলতার শিকড়, কান্ড, পাতা, ফুল-ফল সবই ভেষজগুণ সম্পন্ন। ক্যান্সার, হৃদরোগ, গায়ে ব্যথা, ক্ষুধামন্দা, গ্যাস্ট্রিক ও এ্যাজমাসহ অসংখ্য রোগের প্রতিষেধক হিসেবে চুইঝাল কার্যকর ভূমিকা পালন করে।

বস্তুত কোনো অঞ্চলে কি ধরনের ফসল জন্মাবে তা নির্ভর করে সেখানকার ভূমির প্রকৃতি ও আবহাওয়ার উপর। আর উৎপাদিত ফসলের উপর নির্ভর করেই সে এলাকার মানুষের খাদ্যের ধরন নির্ধারিত হয়। যেমন- ছাতকের কমলা, মধুপুরের আনারস, সিলেটের সাতকরার মত খুলনার চুইঝালের পরিচিতি দেশজুড়ে। বৃহত্তর খুলনা জেলায় চুইঝালের উৎপাদন বেশি হওয়ায় এখানকার প্রচলিত নানা খাবারে চুইঝালের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। তবে খুলনার স্থানীয় খাবার হিসেবেই চুইঝাল অধিক পরিচিতি লাভ করেছে। চুইঝাল দিয়ে সাধারণত গরুর মাংস, খাসির মাংস, হাঁসের মাংস, মুরগীর মাংস, বড়মাছ ইত্যাদি রান্নার প্রচলন খুলনা অঞ্চলে চোখে পড়ে। চুইঝাল মাছ- মাংস জাতীয় খাবারের স্বাদ বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। ফলে দিন দিন চুইঝাল দিয়ে রান্না খাবারের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। তাই প্রতিদিন খুলনার বিভিন্ন এলাকায় তো বটেই, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসব খাবারের স্বাদ নিতে ছুটে আসেন ভোজনরসিক মানুষ।

কোনো শহরে বেড়াতে গেলে, সেই শহরের সৌন্দর্য দেখার পাশাপাশি যে জিনিস সবার আগ্রহে থাকে সেটি হলো আঞ্চলিক খাবার। তেমনি একটি মজাদার খাবার চুইঝালের রান্না। দেখা যায় চুইঝালকে কেন্দ্র্র করে খুলনার ডুমুরিয়া, সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটা ও তালা, যশোরের কেশবপুর, মনিরামপুসহ বেশ কিছু জায়গায় হোটেল গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে, খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগর বাজারে আব্বাসের হোটেল চুইঝাল দিয়ে রান্না করা খাসির মাংসের জন্য বিখ্যাত।

জানা যায়, আব্বাস হোটেলের প্রতিষ্ঠাতা চুকনগরের বাসিন্দা আব্বাস আলী মোড়ল। খুলনার হোটেল জগতে কিংবদন্তিতুল্য আব্বাস আলী আনুমানিক ৭৫-৮০ বছর আগে ভারতের মাদ্রাজ থেকে রান্না শিখে ফিরে আসেন নিজের এলাকায়। পরে তাঁর সঙ্গে নিজস্ব রান্নার কৌশলে তিনি খুলনা অঞ্চলের হোটেল ও রেস্তোরায় চুইঝালের রান্নার ইতিহাসের জন্ম দেন। ব্যবসার প্রথম থেকে তিনি নিজেই রান্না করতেন। মজাদার রান্নার কারণে অল্পদিনেই তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে হোটেলটির একটি শাখা খুলনার সোনাডাঙ্গা আবাসিক এলাকায় খোলা হয়েছে। সাধারণ মানুষ, প্রশাসনিক, রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নির্বিশেষে যারাই খুলনা বেড়াতে আসেন, আব্বাসের হোটেলের চুইঝালের স্বাদ নেয় না, সচরাচর এমনটি ঘটে না। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ জাতীয় দলের ক্রিকেটার মানজারুল রানা আব্বাসের হোটেলে চুইঝালের রান্না খেয়ে বাড়ি ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। সেই ঘটনা হোটেলটিকে একটি আলাদা পরিচয় এনে দিয়েছে। এ হোটেল চুইঝাল-মাংসের জন্য সবথেকে জনপ্রিয় হলেও এ ব্যবসা এখন আর শুধু চুকনগরে আটকে নেই। খুলনার জিরো পয়েন্ট, সোনাডাঙ্গা, শিববাড়ি ছাড়িয়ে সাতক্ষীরা সদর, পাটকেলখাটা, তালা, যশোরের কেশবপুর, মনিরামপুর, বাগেরহাট সদর এমনকি ঢাকায়ও এর ব্যাপ্তি ঘটেছে। বলতে গেলে চুইঝালকে কেন্দ্র করে খুলনা অঞ্চলে খাদ্যের একটা আলাদা সংস্কৃতিই গড়ে উঠেছে। এ অঞ্চলে বিভিন্ন সামাজিক আচার অনুষ্ঠানসহ ঈদ, পুজা পার্বণে বিশেষ খাবার হিসেবে চুইঝাল দিয়ে মাংস রান্না করতে দেখা যায়।

কোন অঞ্চলের মানুষের আতিথেয়তা ওই অঞ্চলে উৎপাদিত পণ্য দ্বারা অনেকখানি প্রভাবিত। খুলনা অঞ্চলের মানুষের আতিথেয়তার অন্যতম উপাদান চুইঝাল। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন-সামাজিকতা হলো লোকালয়ের প্রাণ। সামাজিকতায় খুলনা অঞ্চলের মানুষের রয়েছে অনেক খ্যাতি। কারো বাড়িতে ভিন্ন অঞ্চল থেকে কেউ বেড়াতে এলে তাদেরকে চুইয়ের তৈরি বিশেষ খাবার পরিবেশন করা হয়। এখানে জামাই শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে এলে চুইঝালের রান্না খাবার দিতে হয়।

ক্রমবর্ধমাণ জনপ্রিয়তার দিকে লক্ষ করলে আজকের দিনে বাংলাদেশে চুইঝাল যে একটি অর্থকরী ফসল হিসেবে পরিগণিত হতে পারে তা বলাই বাহুল্য। চুইয়ের চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে খুলনার বিভিন্ন গ্রামে গড়ে ওঠেছে ছোট-বড় চুইঝালের নার্সারি।

কৃষিবিদদের মতে, হেক্টর প্রতি এর ফলন ২ থেকে ৩ টন। ২ থেকে ৩ শতক জমিতে চুই লাগালে ৩-৪ বছরের মধ্যে ২-৩ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব। খুলনার চুই এখন দেশের বাইরেও রপ্তানি হচ্ছে। সম্ভাবনাময় এ মসলা গাছ নিয়ে যেমন আরও গবেষণা দরকার, তেমনি দরকার এর সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণে সুষ্ঠু পরিকল্পনা। পাশাপাশি চুইঝাল ব্যবহারের উপকারিতা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করারও ব্যবস্থা নিতে হবে। তবেই আঞ্চলিকভাবে ব্যবহৃত এই অপ্রচলিত মসলাটি সারাদেশে ব্যবহারের পাশাপাশি বহির্বিশ্বে রপ্তানিযোগ্য অর্থকরী ফসল হয়ে উঠতে সক্ষম হবে।

লেখক: সমাজ গবেষক ও শিক্ষক, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!