খুলনা, বাংলাদেশ | ১৯ বৈশাখ, ১৪৩১ | ২ মে, ২০২৪

Breaking News

  অর্থ আত্মসাৎ মামলায় জামিন পেলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস
  রাজবাড়ীতে সাড়ে ৩ ঘণ্টা পর ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক
  হবিগঞ্জের মাধবপুরে ট্রাক ও প্রাইভেটকারের মুখোমুখি সংঘর্ষে ঘটনাস্থলে পাঁচজন নিহত
  ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্টের

কৃষি জমিতে কারখানা, কমছে ফসলের আবাদ

মোহাম্মাদ মিলন ও আজিজুর রহমান, দাকোপ থেকে ফিরে

প্রথমে কৃষি জমি কিনে নেন। এরপরে সেই জায়গায় ড্রেজার যন্ত্রের মাধ্যমে বালু ভরাট দেন। কংক্রিট আর লোহা দিয়ে তৈরি হয় ভবনের কাঠামো। পরে গ্যাস সংরক্ষনের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে বড় ট্যাংকি। ট্যাংকি থেকে গ্যাস বাজারজাতকরণে এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডারের বোতল ভরার জন্য বসানো হয় যন্ত্রাংশ। এভাবেই ফসলের আবাদ জমি বেসরকারি গ্যাস কোম্পানির মধ্যে থাকায় কৃষি জমির পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমছে। এ চিত্র খুলনার উপকূলীয় দাকোপ উপজেলার।

শুধু গ্যাস কোম্পানির কারণে আবাদ জমির পরিমাণ কমেনি। আধা নিবিড় চিংড়ি উৎপাদন খামার ও কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কারণে কৃষি জমির পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

জমিতে আবাদ করে সংসার চলেছে প্রশান্ত রায় নামের একজন ব্যক্তির। বয়স তাঁর ৬০ বছর। বাড়ি চালনা পৌরসভার খলিশা গ্রামে। ভাল ফলনের আশায় কৃষিকাজে কঠোর পরিশ্রমও করেছে তিনি। তাঁর অভিযোগ, নিজের জমি না থাকলেও অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করেছেন। কিন্তু কোম্পানিগুলো হওয়ায় এখন আর চাষাবাদ করতে পারেনা।

প্রশান্ত রায় বললেন, এলাকাতে বেসরকারি কোম্পানি হওয়ায় ফসলের আবাদ জমির পরিমাণ কমে গেছে, সঙ্গে কৃষিকাজেরও। কোম্পানি নির্মাণের আগে পাওয়ার টিলার যন্ত্র দিয়ে জমি চাষ করেছি। আর এখন কাজ না পাওয়ায় কষ্টে দিন কাটছে তাঁর। পরিবার নিয়ে কিভাবে দিনযাপন করবেন সেই শঙ্কায় দিশেহারা প্রশান্ত।

স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি বলেন, দাকোপ উপজেলায় কৃষি জমির পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে ফসল উৎপাদনে। এ অঞ্চলে চলছে বেসরকারি তরল পেট্রোলিয়াম (এলপি) গ্যাস কোম্পানি নির্মাণ, আধা নিবিড় চিংড়ি উৎপাদনের খামার, অপরিকল্পিত নগরায়ন, বাড়িঘর নির্মাণ ও জলাভূমি ভরাট করার আত্মবিনাশী প্রক্রিয়া। এভাবে চলতে থাকলে বসবাস উপযোগী পরিবেশই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, নিকট ভবিষ্যতে সমগ্র জনগোষ্ঠীই এক বিপর্যয়কর অবস্থায় গিয়ে পড়বে। যদি কৃষি জমি এমন দ্রুত হারে কমতে থাকে, তাহলে জনসংখ্যার খাদ্যের জোগান দেওয়া এক সময় কষ্টকর নয়, রীতিমতো অসম্ভব হয়ে পড়বে।

উপজেলা পরিসংখ্যান কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, দাকোপে এলপি গ্যাস কোম্পানি রয়েছে তিনটি ও ১৭টি আধা নিবিড় (সেমি ইনটেনসিভ) চিংড়ি উৎপাদর খামার রয়েছে। বেসরকারি এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য ফসলের আবাদ জমির পরিমাণ কমেছে বলে জানায় সূত্রটি। তবে কতটুকু কমেছে তার সঠিক পরিমাপ সংরক্ষিত নেই ওই কার্যালয়ে।

কৃষিকাজ থেকে বঞ্চিত খলিশা গ্রামের বাসিন্দা অনিল দাস। তিনি খুলনা গেজেটকে জানান, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় এলাকার কোনো উন্নয়ন হয়নি। কোম্পানি হয়েছে কিন্তু স্থানীয়দের কর্মসংস্থান হয়নি। ক্ষোভের মধ্যদিয়ে অনিল জানালেন কোম্পানি কর্তৃপক্ষ বাইরের লোকজন নিয়ে কাজ করছে। হাতেগোনা কয়েকজন স্থানীয় লোক কাজ করছে প্রতিষ্ঠানগুলোতে।

অভিযোগ রয়েছে, বেসরকারি ওই প্রতিষ্ঠানগুলো এতটাই শক্তিশালী যে, কোনো ধরনের সরকারি নীতিমালা ছাড়াই কৃজি জমির ব্যবহার ও নদী দখলে নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে। নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে কৃষি জমিতে বালু ভরাট করে। সরকারের কোনো নির্দেশনারও তোয়াক্কা করে না।

জানা যায়, দাকোপ উপজেলার পশুর নদের পাশে চুনকুড়ি গ্রামে এনার্জিপ্যাক-জি গ্যাস কোম্পানি, চালনা পৌরসভার খলিশা গ্রামে বিএমএলপিজি গ্যাস কোম্পানি ও বাণীশান্তার আমতলা গ্রামে গ্রীনটাউন এলপিজি গ্যাস কোম্পানিসহ ব্যক্তি মালিকানাধীন বড় বড় আধা নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি উৎপাদনের খামার রয়েছে। এরমধ্যে এনার্জিপ্যাক-জি গ্যাসকে নদীর পাড় দখল ও পরিবেশ আইনে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা আদায় করেছিল খুলনা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাজুয়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান রঘুনাথ রায় খুলনা গেজেটকে বলেন, কোম্পানি হওয়ায় এলাকার লোকজনের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি, সঙ্গে কোনো প্রকার উন্নয়ন ঘটেনি। তিনি বলেন, কৃষি জমি ব্যবহার করে কোম্পানির প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেছে। ফলে আবাদ জমির পরিমাণ কমে যাওয়ায় কৃষক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্রে, গত পাঁচ বছরে মোট ফসলি জমির পরিমাণ ১ হাজার ৪৫৮ হেক্টর কমেছে। হিসেবমতে, ২০১৫ সালে মোট ফসলি জমির পরিমাণ ছিল ২৪ হাজার ৮০৯ হেক্টর। সর্বশেষ ২০২০ সালে এসে মোট ফসলি জমির পরিমাণ দাড়িয়েছে ২৩ হাজার ৩৫১ হেক্টরে। খুলনা জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমন আবাদ হয় দাকোপে। এ বছর ১৮ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে আমন ধানের আবাদ হয়েছে। ২০১৬ সালের খরিপ-২ মৌসুমে আমন আবাদ হয়েছিল ১৯ হাজার ৬২০ হেক্টর জমিতে।

দাকোপ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মেহেদী হাসান খান খুলনা গেজেটকে বলেন, শিল্পোন্নয়ন প্রতিষ্ঠান, জলাবদ্ধতা ও চিংড়ির হ্যাচারি নির্মাণের কারণে ফসলের আবাদ জমির পরিমাণ কমেছে। কৃষি জমি ব্যবহার করে বেসরকারি কোম্পানি ও বিভিন্ন শিল্পোন্নয়ন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় পাঁচ বছরের আগের তুলনায় কৃষি জমির পরিমাণ কিছুটা কমেছে। পক্ষান্তরে উপকূলীয় এ অঞ্চলে পতিত জমির পরিমাণ বেশি ছিল। এখন ওই সব জমির একাংশ কৃষিকাজে ব্যবহার করছে কৃষকেরা।

এ বিষয়ে পরিবেশ সুরক্ষা মঞ্চের আহবায়ক কুদরত-ই খুদা খুলনা গেজেটকে জানান, সরকারের কৃষি জমি সুরক্ষা আইন অমান্য করে বিভিন্ন বেসরকারি বাণিজ্যিক কোম্পানি কৃষি জমি কিনে অকৃষি কাজে ব্যবহার করছে। যার ফলে কৃষি জমি হ্রাস পাচ্ছে এবং দেশে খাদ্য নিরাপত্তা সংকটের মুখে পড়ছে। প্রধানমন্ত্রীর একটি ঘোষণা রয়েছে তিন ফসলিজমি এবং কৃষিজমি কখনোই অকৃষি কাজে ব্যবহার করা যাবে না। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা এবং কৃষি জমি সুরক্ষা আইন বাস্তবায়ন করতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

 

খুলনা গেজেট / এমএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!