খুলনা, বাংলাদেশ | ৩ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ | ১৭ মে, ২০২৪

Breaking News

কাজের মেয়ের জন্য ধানমন্ডি থানায় তোলপাড়

এ এম কামরুল ইসলাম

কোতোয়ালি থানায় চাকরির মেয়াদ ভালভাবে সম্পন্ন হওয়ায় আমার পোস্টিং হলো ধানমন্ডি থানায়। তৎকালীন ধানমন্ডি থানার পরিধি ছিল অনেক বড়। বর্তমানে ধানমন্ডি থানা ভেঙে চারটি থানায় বিভক্ত হয়েছে। যথাক্রমে ধানমন্ডি, কলাবাগান, নিউমার্কেট ও হাজারীবাগ থানা। অন্যদিকে থানার লোকবল পর্যাপ্ত ছিল না। ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় অভিজাত শ্রেণির মানুষের বসবাস ছিল। তাই ঐ থানায় চাকরির ঝুঁকি ছিল বেশি এবং ডিউটি ছিল কড়া।

আমি যখন ধানমন্ডি থানায় যোগদান করি তখন ওসি ছিলেন জনাব মীর নওশের আলী। সাদা মনের মানুষ হিসেবে সমগ্র ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে তাঁর অনেক সুনাম ছিল। কোতোয়ালি থানা থেকে ধানমন্ডি থানায় বদলি হওয়ায় মনটা একটু খারাপ ছিল। তাই একদিন সন্ধ্যায় সাদা পোশাকে ধানমন্ডি থানা দেখতে গেলাম এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও হঠাৎ করে ওসি সাহেবের সামনে পড়ে গেলাম। ওসি সাহেব অধিকাংশ সময় রাতদিন পোশাক পরে থাকতেন। থানার কাছেই মাননীয় আইজিপি সাহেবের বাসা ও প্রচুর ভিআইপি মানুষের বসবাস হওয়ায় কখন কোথায় ডাক পড়ে, তাই ওসি সাহেবের সবসময় পোশাক পরে থাকা ছাড়া উপায় ছিল না।

আমার বদলির আদেশ তিনি আগেই পেয়েছিলেন। আমাকে সাদা পোশাকে ফিটফাট দেখে তিনি বললেন, ‘দেখে তো মনে হচ্ছে পিএসপি অফিসার। এই থানায় যোগ দিলে পিএসপি গিরি ছুটে যাবেনে। পারলে বদলি বাতিল করে অন্য থানায় চলে যান, না হলে আগামীকালই জয়েন করেন। আমার অফিসার সট আছে’।

এখানে ‘পিএসপি’ কথাটি একটু ভেঙে বলা দরকার। সোজাসুজি পিএসপি কথার পুরাপুরি হলো – ‘পাকিস্থান পুলিশ সার্ভিস’ । অর্থাৎ বর্তমানে বিসিএস সম মর্যাদার। তবে আমি সারা জীবন যত পিএসপি অফিসার দেখেছি তাঁদের চালচলন, কথাবার্তা, শিক্ষাদীক্ষা ও চাকরির ধরণ ছিল চোখে পড়ার মত। তখনকার দিনে পিএসপি অফিসার হতে হলে শুধু পরীক্ষায় পাশ করলে চাকরি হতো না। সেখানে আরো অনেক বিষয় বিবেচনা করে পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই বাছাইয়ের পর পিএসপি অফিসার নেওয়া হতো। তাই ওসি সাহেব আমার ভাবসাব দেখে আমাকে ‘পিএসপি’ বলে উপহাস করলেন। আমি একটু মনোক্ষুণ্ণ হলেও ওসি সাহেবের সরলতার বিষয়ে আগেই অবহিত ছিলাম বলে, তেমন খারাপ লাগেনি।

যাহোক, পরদিন সকালে কোতোয়ালি থানা থেকে ডিপার্চার নিয়ে ধানমন্ডি থানায় যোগদান করলাম। এই থানায়ও আমি সবার সিনিয়র হওয়ায় আমাকে সেকেন্ড অফিসারের দায়িত্ব দেওয়া হলো। ইতোমধ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাজকর্ম আমার মোটামুটি রপ্ত হয়ে গিয়েছিল। তাই ধানমন্ডি থানার মত ভিআইপি থানায় কাজ করতে আমাকে তেমন বেগ পেতে হয়নি।

হঠাৎ একদিন সকাল বেলায় থানায় হৈচৈ পড়ে গেল। ওসি সাহেবের ডাক চিৎকারে সবাই এক জায়গায জড়ো হলো। যারা সারারাত ডিউটি করে সকালে বাসায় গিয়েছিল তাদেরকেও ঘুম থেকে জাগিয়ে থানায় আনা হলো। ধানমন্ডি থানা তখন রমনা জোনের আওতায় থাকায় এসি রমনা জোন জনাব সামছুল আলম সাহেব থানায় হাজির হলেন। সকল অফিসার ও ফোর্স এক জায়গায় করে এসি ও ওসি সাহেব বললেন, ‘সাবেক শীর্ষ আমলা (তথ্য গোপন করলাম) জনাব রহমতুল্লাহ সাহেবের (ছদ্মনাম) বাসার কাজের মেয়ে হারিয়ে গেছে। মেয়েটার বয়স অনুমান ৯/১০ বছর। গায়ের রং ফর্সা। রাজশাহীর শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে। এই মেয়েকে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে খুঁজে বের করতে হবে। নইলে আমার ও আপনাদের সবার চাকরি যাবে। এটা আমার হুকুম না, আইজিপি স্যারের হুকুম। এখন থেকে ঐ কাজের মেয়েকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত কেউ বাসায় যেতে পারবে না। কে, কোথায়, কিভাবে খুঁজছেন তা প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় আমাকে জানাবেন। থানার সকল ওয়ারলেস নিয়ে যার য়ার মোটরসাইকেলে বেরিয়ে পড়েন। খবরদার, কেউ ফাঁকি দিলে কিন্তু রক্ষা নেই। আমারও চাকরি থাকবে না’…!

এসি এবং ওসি সাহেবের অবস্থা দেখে বিষয়টি সকলেই অনুধাবণ করলেন এবং যে যার মতো কাজের মেয়ের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন। ওসি সাহেব প্রতি ঘন্টায় খবর নিতে থাকলেন। সকল অফিসার অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে খোঁজাখুঁজি করছিলেন। আমিও মন থেকে উঠেপড়ে লেগেছিলাম।

চব্বিশ ঘণ্টা পার হয়ে আটচল্লিশ ঘন্টা চলে গেল। কাজের মেয়ের সন্ধান পাওয়া গেল না। সকল অফিসার ও ফোর্সের নাওয়া খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। ওসি সাহেবের চোখেমুখে হতাশার ভাব পরিলক্ষিত হলো।

তৃতীয় দিন সকালে আমার মোটর সাইকেলে একজন কনস্টেবল নিয়ে আবার সেই কাজের মেয়ের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম। এতদিন আমরা কেউই ভয়ে সেই আমলা (?) সাহেবের বাড়ির আশেপাশেই যাইনি। কিন্তু, ঐদিন সকালে সাহস করে সেই বাড়ির সামনে গেলাম। বাড়িটি ছিল দেড় বিঘার প্লট। ভিতরে অনেক খোলামেলা জায়গা এবং একপাশে একটি দৃষ্টি নন্দন দোতালা বাড়ি। বাড়ির গেটের উপর দিয়ে মাথা উঁচু করে দেখতে চাইলাম সেই বাড়ির ভিতরটা; যে বাড়ির কাজের মেয়ে খুঁজতে গিয়ে থানার সকল অফিসারের খাওয়া ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গেটের উপর দিয়ে দেখার চেষ্টা করা মাত্র বিশাল এক এলসেসিয়ান আমার দিকে ছুটে এলো। আমি জান নিয়ে মানে মানে সরে এলাম।

ক্লান্ত ভগ্ন হৃদয়ে পাশের বাড়ির জ্বরাজীর্ণ গেট খুলে কিছুটা স্বস্তির আশায় একটা গাছের নিচে বসলাম। ঐ বাড়িটিও ছিল দেড় বিঘার প্লট। তখন ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় দোতলার উপরে কোন বাড়ি ছিল না। এই বাড়িটি ছিল পুরাতন ভাঙাচোরা একটি একতলা। সারা বাড়ি আগাছায় ভরা। বাড়ির মধ্যে কোন মানুষের সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। সাহস করে বাড়ির দরজায় কড়া নাড়তে নাড়তে এক পর্যায়ে একজন বয়স্কা মহিলা দরজা খুলে দিলেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বুড়িমার সাথে আলাপ করে জানতে পারলাম – ঐ বাড়ির মালিক স্বপরিবারে দীর্ঘদিন বিদেশে থাকেন। বাড়ি পাহারা দিতে মাসিক বেতনে বুড়িমাকে রেখে দিয়েছিলেন।

সামান্য সময়ে বুড়িমার সাথে আমার বেশ ভাব জমে গেল। এক পর্যায়ে বুড়িমাকে বললাম, পাশের বাড়ি থেকে একটা কাজের মেয়ে পালিয়ে গেছে। আপনি কিছু শুনেছেন?
বুড়িমা অত্যন্ত সহজ সরলভাবে বললেন, ‘ওমা কাজের মাইয়া পলায় যাবে কেন, সে তো আমার কাছে আজ তিন দিন ধরে আছে। আমি তারে আমার নাতনির মতো আদর করি। মাইয়াডা খুব ভাল। আমার কাছে আসে কীযে কান্দাকাটি করিছে’!
আমি বললাম- সে এখন কোথায়?
বুড়িমা- আমার ঘরে ঘুমাইছে।

আমার মনে হলো- আকাশের চাঁদ আমার হাতের মুঠোয়। যার জন্য থানার সারা মানুষের খাওয়া ঘুম হারাম হয়ে গেছে, সে আমার হাতের মুঠোয়! ইচ্ছে হচ্ছিল ঘরে ঢুকে মেয়েটিকে আগে কব্জা করি। কিন্তু তা না করে বুড়িমাকে বললাম- তাকে একটু ডাকা যায়?
বুড়িমা কোন অজুহাত না দেখিয়ে সাথে সাথে মেয়েটিকে ঘর থেকে নিয়ে এলেন। মেয়েটি অত্যন্ত বুদ্ধিমতি ছিল। পুলিশ দেখেই সে বুঝতে পারলো তাকে ঐ বাড়িতে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য এসেছে। তাকে কোন কথা বলার আগেই সে শান্তভাবে বলল, ‘আমি ঐ বাড়িতে কখনও যাবো না’।
তারপর হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো। আমি ভীষণ বিব্রত হলাম। বুড়িমার কাছে ঐ মেয়েটি তার কষ্টের কাহিনী আগেই বলেছিল। তাই বুড়িমা এক-এক করে সেইসব কাহিনী আমাকে শুনাতে থাকলেন। আস্তে আস্তে মেয়েটি স্বাভাবিক হতে লাগলো।

মেয়েটির বুদ্ধিমত্তা দেখে আমি বিমোহিত হলাম। ছোটবেলা থেকে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা সে দারুণভাবে রপ্ত করেছিল বলে মনে হলো। তার চেহারায় আভিজাত্যের ভাব লক্ষ্য করা গেল। সুতরাং আমিও কিছুটা কৌশল অবলম্বন করলাম।

বুড়িমার কাছে সে আগেই সব কষ্ট শেয়ার করেছিল। আমি আবার সেই কথাগুলো মেয়েটির নিজের মুখ থেকে শুনতে চাইলাম। তাকে একটু স্বাভাবিক হওয়ার সুযোগ দিয়ে, কথা বের করতে শুরু করলমা। বুড়িমাও তাকে অভয় দিলেন।

এক পর্যায়ে মেয়েটি শেষ থেকে শুরু করলো। অর্থাৎ পালিয়ে আসার দিন বেগম সাহেব তাকে মারধর করেছিলেন বলে জানালো। আমি বললাম- বেগম সাহেব তোমাকে মারলেই, তুমি পালিয়ে না এসে সাহেবের কাছে জানাতে পারতে।
মেয়েটি বললো, ‘সাহেবের কাছে বলে কোন লাভ হতো না’।
কেন?
‘কয়েকদিন আগে বেগম সাহেব সাহবকেও মেরেছিল। মার খেয়ে সাহেব তিন দিন হাসপাতালে ছিলেন। বেগম সাহেব প্রায়ই সাহেবকে মারেন’।
সেকি! তাদের ছেলেমেয়েরা কিছু বলে না?

‘না, ছেলে থাকে তার গার্লফ্রেন্ড নিয়ে। মেয়ে থাকে তার বয়ফ্রেন্ড নিয়ে। তারা সারাদিন রাত মদ খায়, আর ফুর্তি করে। কেউ কারো খবর রাখে না। বেগম সাহেব তার বন্ধুদের নিয়ে প্রায়ই রাতে বাইরে থাকে, সাহেব শুধু আমাকে ডিসটার্ব করে’।

আমার কোনকিছু বুঝতে বাকী রইলো না। মেয়েটিকে ওসি সাহেবের সামনে হাজির করার পথ খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু কোনমতে তাকে রাজি করাতে পারছিলাম না। বুড়িমার কাছ থেকে বাড়ির বাইরে নিতে গেলেই, সে বুড়িমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করছিল। তার বদ্ধমূল ধারণা ছিল, সে বাইরে গেলেই ঐ বাড়িতে যেতে হবে। অবশেষে তাকে বুঝালাম- তোমাকে আমার বাসায় কাজের জন্য নিতে এসেছি। তখন সে আর আপত্তি করলো না। সুতরাং তাকে আমার মোটরসাইকেলের পিছনে উঠিয়ে সোজা থানায় নিয়ে গেলাম। তাতে আমার কথা কিছুটা সত্যি হলো। কারণ আমার বাসা ছিল থানার ভিতরেই।

ওসি সাহেব তখন থানায় ছিলেন না। তিনি নিজেও মেয়েটির সন্ধানে বাইরে ছিলেন। তাঁকে ওয়ারলেসের মাধ্যমে খবর দেওয়া মাত্র থানায় পৌঁছে গেলেন। মেয়েটিকে দেখে হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। আমাকে বললেন,
‘সাব্বাশ পিএসপি। সবার চাকরিটা বাঁচালেন’।

মেয়েটিকে পাওয়া গেল ঠিক, কিন্তু মূল সমস্যার সমাধান হলো না। ঐ বাড়িতে ফিরে যেতে তাকে কোনমতে রাজি করানো গেল না। শেষ পর্যন্ত ওসি সাহেবের পরামর্শে থানার মধ্যে আমার বাসায় নিয়ে রাখলাম।

মেয়েটি খুশি মনে আমার বাসায় থাকলো। পরদিন সকালে মেয়েটির প্রবল আপত্তির পরও ওসি সাহেব নিজে তাঁর গাড়িতে করে মেয়েটিকে সেই পূর্বের বাড়িতে দিয়ে এলেন। তারপর মেয়েটির কী হয়েছিল তা আমি বা আমরা কিছুই জানি না। তবে আমাদের চাকরিটা সেবারের মতো টিকে গেল।

আনন্দ
আমার মাধ্যমে মেয়েটিকে খুঁজে পাওয়ায় ওসি সাহেবসহ সবার ইজ্জত বাঁচলো।

বড় বড় মানুষের জীবনের বাস্তবতা জানার একটা সুযোগ হলো।

বেদনা
অসহায় মেয়েটিকে বাধ্য হয়ে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মালিকের বাড়িতে ফেরৎ দেওয়ায় কষ্ট আমাকে আজও পীড়া দেয়।

পুলিশ সব পারে বলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ধারণা আছে। কিন্তু, আমরা কি পেরেছিলাম- মেয়েটির ইচ্ছে মতো তার জায়গায় পৌঁছে দিতে? বরং বাধ্য হয়েই বেআইনি এবং অমানবিক কাজটি করতে হয়েছিল। চলবে…

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার। (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, অব.)




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!