খুলনা, বাংলাদেশ | ৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ | ১৯ মে, ২০২৪

Breaking News

  করোনায় একজনের মৃত্যু, শনাক্ত ১১
  তিন জেলায় বজ্রপাতে প্রাণ গেল ৭ জনের
  রাঙামাটিতে সশস্ত্র হামলায় ইউপিডিএফ সদস্যসহ নিহত ২

করোনার হটস্পট খুলনা অঞ্চল, যে কারণে বাড়ছে সংক্রমণ

নিজস্ব প্রতিবেদক

খুলনা বিভাগে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে করোনাভাইরাস। অদৃশ্য এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী। করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর পর বিভাগে একদিনে এত রোগীর মৃত্যু এবং শনাক্ত হয়নি। বিভাগে একের পর একদিন করোনায় মৃত্যু ও শনাক্তের রেকর্ড ভাঙছে। দেশে দৈনিক মৃত্যু ও সংক্রমণের হারে ঢাকাকে টপকে এখন শীর্ষ স্থানে রয়েছে খুলনা বিভাগ।

এক মাসে (৭ জুন থেকে বৃহস্পতিবার ৮ জুলাই) খুলনা বিভাগে ৭৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে। যা গত বছরের করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শুরু থেকে এ পর্যন্ত মোট মৃত্যুর অর্ধেকের চেয়ে ৬৮ জন বেশি। একইসঙ্গে শনাক্তের সংখ্যাও অর্ধেকের কাছাকাছি। ফলে হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে রোগীর চাপ। ধারণক্ষমতার বাইরে রোগী ভর্তি হচ্ছে। অনেকে হাসপাতালে ঘুরে ঘুরেও পাচ্ছেন না চিকিৎসাসেবা। প্রতিনিয়ত খুলনা বিভাগে করোনায় মৃত্যুর মিছিল যে হারে বাড়ছে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন সর্বমহল।

অসচেতনতা এবং সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় করোনার ভারতীয় ডেল্টা ভেরিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ায় দ্রুত সংক্রমণ বাড়ছে। এ ছাড়া একবারে শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে উপস্থিতি, পাকস্থলির কাযকারিতা ক্ষীণ নিয়ে ভর্তি, হাসপাতালে জনবল সংকট ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম স্বল্পতা, অক্সিজেন সংকট, সতকর্তার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের উদাসীনতা ও স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন না করায় মৃত্যুর সংখ্যা পারদের মতো উঠানামা করছে। এমনটাই জানিয়েছেন চিকিৎসক ও রোগীর স্বজনরা।

হাসপাতালে আসা রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, জরুরি মুহূর্তে চিকিৎসক ও নার্সদের পাওয়া যায় না। রয়েছে অক্সিজেনেরও সংকট।

খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, গত বছরের মার্চে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শুরু থেকে বৃহস্পতিবার (০৭ জুলাই) পর্যন্ত খুলনা বিভাগে করোনায় মৃত্যুবরণ করেছেন ১ হাজার ৪১৬ জন। যার মধ্যে গত ৭ জুন পর্যন্ত বিভাগে মোট মৃত্যু ছিল ৬৭৪ জন। আর গত ৭ জুন থেকে ৮ জুলাই পর্যন্ত একমাসে মৃত্যু হয়েছে ৭৪২ জনের। যা করোনায় মোট প্রাণহানির অর্ধেকের বেশি। এ ছাড়া গত ৭ জুন পর্যন্ত খুলনা বিভাগে করোনা শনাক্ত হয়েছিল ৩৬ হাজার ৪১১ জনের শরীরে। আর বৃহস্পতিবার (৮ জুলাই) পর্যন্ত বিভাগে শনাক্ত হয়েছে ৬৭ হাজার ৫৩১ জনের শরীরে।

তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত এক মাসে (৭ জুন-৮ জুলাই) শনাক্ত হয়েছে ৩১ হাজার ১২০ জনের। যা মোট শনাক্তের অর্ধেকের কাছাকাছি। আর গত বছর মার্চে দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর পর এক দিনে খুলনা বিভাগে সর্বোচ্চ ৭১ জনের মৃত্যু হয়েছিল শুক্রবার (৯ জুলাই)। আর এদিন সর্বোচ্চ শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ৬৫৬ জনের শরীরে। সর্বশেষ বুধবার ৬০ জনের মৃত্যু ও ১ হাজার ৯০০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে।

দৈনিক মৃত্যু ও শনাক্তের দিক বিবেচনায় বিভাগে এর চেয়ে বেশি রোগীর মৃত্যু এবং শনাক্ত আর কখনও দেখতে হয়নি। বিভাগে শনাক্ত ও মৃতের সংখ্যায় শীর্ষে রয়েছে খুলনা জেলা। এ ছাড়া কুষ্টিয়া, যশোর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, বাগেরহাট, নড়াইল ও সাতক্ষীরায় সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী।

খুলনা করোনা হাসপাতালের ফোকাল পার্সন ডা. সুহাস রঞ্জন হালদার বলেন, হাসপাতালে রোগী এখন অনেক বেশি। প্রথমে ১০০ শয্যা বিশিষ্ট করোনা হাসপাতাল ছিল। কিন্তু সেটি বাড়িয়ে ১৩০ শয্যা করেও সংকুলান করতে পারিনি। সেই কারণে সদর হাসপাতালে আরও ৭০ শয্যা এবং শহীদ শেখ আবু নাসের হাসপাতালে ১০টি আইসিইউ বেডসহ ৪৫ শয্যার হাসপাতাল চালু হওয়ার পরেও এখন খুলনা করোনা হাসপাতালে ১৩০ শয্যার বিপরীতে ১৯৮ জন রোগী ভর্তি রয়েছে। এ জন্য নতুন করে আরও ৬০টি শয্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। ইতোমধ্যে ২০টি বেডের কাজ শুরু হয়েছে। দু’একদিনের মধ্যে বাকী কাজ শেষ করা সম্ভব হবে।

তিনি আরও বলেন, এ অঞ্চলে করোনা বৃদ্ধির কারণ সীমান্তবর্তী জেলা এবং ভারত থেকে অনেক রোগী এবং লোক আসছেন। বেনাপোল ও দর্শনা স্থলবন্দর থাকার কারণে সকল রোগী খুলনা-সাতক্ষীরার ওপর থেকে ট্রান্সপোর্ট হচ্ছে। যার কারণে এই অঞ্চলে রোগটি ছড়িয়ে যাচ্ছে। হয়তো একজন লোক আসলেন এবং তিনি ছড়াতে ছড়াতে গেলেন। হয়তো এক সপ্তাহ পরে তার পজিটিভি এলো। এ অঞ্চলের মানুষের অসচেতনতার কারণে রোগটি একটু বেশি ছড়াচ্ছে।

খুলনা বিভাগে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে খুলনা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. আব্দুল আহাদ বলেন, আগে করোনার সংক্রমণ কিছুটা শহরকেন্দ্রিক ছিল। কিন্তু যখন গ্রামকেন্দ্রিক হয়ে গেছে তখনই করোনার রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। রোগী বৃদ্ধি, চিকিৎসার সরঞ্জাম সেই তুলনায় বৃদ্ধি না পাওয়ায় শনাক্ত ও মৃত্যু বাড়ছে।

করোনা হাসপাতালের ধারণক্ষমতা বাইরে চলে গেছে। বহু মানুষ বাড়িতেই সেবা নিচ্ছেন। গ্রামের মানুষগুলো মাস্ক পড়ে না আবার সেভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে না। যে কারণে অল্প সময়ের মধ্যে এই মানুষগুলো আক্রান্ত হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, যেসকল রোগী গ্রাম থেকে আসছে তাদের শ্বাসকষ্ট, জ্বর, কাশি যখন খুব বেশি হচ্ছে তখন তারা হাসপাতালে আসছেন। এই মানুষগুলোর চিকিৎসার শুরুতে একটু বিলম্ব হচ্ছে। যে কারণে তাদের হাইফ্লো ন্যাজাল অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়ছে। যার কারণে এদের আক্রান্ত ও মৃত্যুর হারও বেশি। কারও যদি সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দেয় তাহলে তাদের পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে। যদি পরীক্ষায় করোনা পজিটিভ হয় দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশের সীমান্তবর্তী জেলার মানুষ প্রথমে আক্রান্ত হয়েছে। পরবর্তীতে এই মানুষগুলো যখন শহরের দিকে গেছে, তখন শহরের মানুষও আক্রান্ত হয়েছে। এখন ঢাকাতেও রোগীর চাপ। যেহেতু সীমান্তবর্তী এলাকা আমাদের অনেক মানুষ চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে যাতায়াত আছে, চিকিৎসার জন্য গ্রামের অনেকেই সেখান থেকে এসে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চলাফেরা করায় ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। এসব মানুষকে সচেতন করা, স্বাস্থ্যবিধি মানতে বলা, উপসর্গ থাকলে পরীক্ষার ব্যবস্থা করে চিকিৎসার আওতায় আনলে সংক্রমণ কমানো সম্ভব হবে।

খুলনার সিভিল সার্জন নিয়াজ মোহাম্মদ বলেন, মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতা অনেক কম। স্বাস্থ্যবিধি মানতে তাদের মধ্যে অনীহা রয়েছে। যে কারণে সংক্রমণ বাড়ছে।

খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক ডা. রাশেদা সুলতানা বলেন, এখন শুধু খুলনায় নয়, সারাদেশে সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী। মানুষকে আরও সচেতন হতে হবে। অপ্রয়োজনে ঘরের বাইরে বের হওয়া যাবে না। বাইরে বের হলে অবশ্যই মাস্ক পরিধান করতে হবে। মাস্কের বিকল্প নেই।

 

খুলনা গেজেট/এমএইচবি




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!