খুলনা, বাংলাদেশ | ৩ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ | ১৭ মে, ২০২৪

Breaking News

  কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে যাত্রীবাহী বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে নিহত ৫, আহত ১৫

কম্বোডিয়ার জেলখানায় আসামি জিজ্ঞাসাবাদ ও পুলিশ হত্যার রহস্য উদঘাটন

এ এম কামরুল ইসলাম

কম্বোডিয়ায় পুলিশ হত্যা মামলার তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। আমি নিজেও তৃপ্তি পাচ্ছিলাম না। মূল আসামি পুলিশকে গুলি করার পর হাতেনাতে পিস্তলসহ আটক হয়ে জেলখানায় থাকায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার কোন উপায় ছিল না। আসামিকে রিমান্ডে নিয়ে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করার আগ্রহ স্থানীয় পুলিশের মধ্যে তেমন দেখা গেল না। কিন্তু পুলিশকে গুলি করার মূল রহস্য তখনো উদঘাটিত হয়নি। সুতরাং জেলখানায় আটক আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সঠিক তথ্য উদঘাটন করার জেদ আমার মাথায় চেপে বসলো। সেজন্য আমাকে জেলখানায় গিয়ে অথবা অন্য কোনভাবে আটক আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই হবে।

প্রথমে আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে জেলখানায় যাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য বললাম। কিন্তু তাঁরা সকলেই অপারগতা প্রকাশ করলেন। মূলতঃ কেউ বাড়তি ঝামেলা মাথায় নিতে চাইতেন না। উপায়ান্তর না দেখে স্থানীয় পুলিশ কমিশনার মহোদয়ের অফিসে গেলাম। তিনি আমাকে পেয়ে বেশ খায়খাতির করলেন। এমনকি তাঁর বাসায় নিয়ে খাওয়ালেন। কিন্তু জেলখানায় যাওয়ার কথা শুনে হঠাৎ চুপ মেরে গেলেন। বিশেষ করে পুলিশ হত্যার আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের খবরে আরো বেশি আতংকিত হলেন। ঐ হত্যার সাথে একজন আর্মি ক্যাপ্টেনের জড়িত থাকার বিষয় তিনি আগেই অবহিত ছিলেন। পুলিশের সাথে আর্মির বিরোধ সৃষ্টির ভয়ে তাঁরা বিষয়টি এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছিলেন। অতএব আমার শত অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি আমাকে জেলখানা ভিজিটের ব্যবস্থা করতে রাজি হলেন না। তবে, তিনি মনে মনে ঐ ঘটনার সাথে জড়িত আর্মি ক্যাপ্টেনের শাস্তি চেয়েছিলেন। তাই, তিনি সরাসরি লিখিত অনুমতির অপেক্ষা না করে, অলিখিতভাবে জেলখানায় গিয়ে জেল কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে উদ্দেশ্য হাসিলের পরামর্শ দিলেন।

তাঁর পরামর্শমতো আমি জেলখানায় গেলাম। জেল কর্তৃপক্ষ আমাকে দেখে সাদরে গ্রহণ করলেন। কিন্তু জেলখানায় ঢুকে কোন আসামির সাথে কথা বলতে হলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের লিখিত অনুমতির কথা জানালেন। এসব কথা আমার আগেই জানা ছিল। তাই কোন নির্দিষ্ট আসামি জিজ্ঞাসাবাদের কথা না বলে, শুধু জেলখানার স্বাভাবিক অবস্থা দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করলাম। জেলের দায়িত্বরত অফিসারগণ আমার প্রস্তাবে সম্মত হয়ে ভিতরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। জেলখানায় প্রবেশের পর সকল হাজতি ও কয়েদিরা ‘উনতাক উনতাক’ বলে আমাকে ঘিরে ধরলো। কম্বোডিয়ার সাধারণ মানুষ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীকে ‘উনতাক’ নামেই চিনতেন। (উনতাকের আসল মানে ছিল UNTAC. অর্থাৎ United Nations Transitional Authority in Cambodia.)

আমাকে পেয়ে কেউ কেউ আমার কাছে সিগারেট চাইলো। আমি তাদেরকে সিগারেট দিয়ে নিজেই জ্বালিয়ে দিলাম। আমিও তাদের সাথে সিগারেট টানতে টানতে গল্প শুরু করলাম। আমার দোভাষীর মাধ্যমে তাদের সাথে কথা বলে বুঝলাম- তারা ভীষণ মজা পাচ্ছে। এক পর্যায়ে তারা আমার মারাত্মক ভক্ত হয়ে পড়লো এবং সকলে বললো- জেলের মূল গেট খুলে দিলেও আমি থাকতে তারা পালাবে না। তাদের সাথে আড্ডা দিয়ে আমারো বেশ ভাল লাগছিল। আমি কৌশলে তাদের নাম ও কে কী কারণে জেলে এসেছে তা জেনে নিলাম এবং এক পর্যায়ে আমার টার্গেটকে পেয়ে গেলাম। তার হাত ধরে একটু আলাদা জায়গায় নিয়ে কথা বলতে চাইলাম। কিন্তু সে কথা বলতে রাজি হলো না।

আমি ভীষণ আশাহত হলাম। ভাবলাম হয়তো কর্তৃপক্ষ তাকে আগেই নিষেধ করেছে। কিন্তু পরে বুঝলাম ঘটনা অন্যখানে।

আমার টার্গেট হাতে পেয়ে আমি তার সাথে যতই স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করছিলাম সে ততই বেঁকে বসছিলো। আমি কোন কারণ খুঁজে না পেয়ে দোভাষীর মাধ্যমে ভাল করে বুঝিয়ে বলতে অনুরোধ করলাম। কিন্তু দোভাষীও আমতা আমতা করতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত দোভাষী বললেন-
Sir, I beg your pardon. He needs cigarettes to talk with you. But he is afraid.
আমি একটু অট্টহাসি দিয়ে বললাম- It is very simple. No problem.

তারপর আমার পকেট থেকে সিগারেট বের করে তার ঠোঁটে একটা দিয়ে আমিও একটা ধরিয়ে আলাপ শুরু করলাম।

সে সিগারেট টানতে টানতে পুরো কাহিনী বলতে শুরু করলো। এখানে তার জবানিতে ঘটনাটি তুলে ধরলামঃ

“আমি ও আমার বন্ধু ঘটনার রাতে এক বাড়িতে বসে মদ খেয়েছিলাম। আমার বন্ধু আর্মি অফিসার। সে বললো, একটা ভাল মেয়ের সন্ধান আছে। চল্ দু’জনে এনজয় করে আসি। আমি তার কথায় রাজি হয়ে আমার মোটরসাইকেলে করে ঐ মেয়ের বাসায় গেলাম। সেখানে যাওয়ার পর আমার বন্ধু বললো, সে আগে এনজয় করবে। তত সময় আমাকে বাইরে থাকতে হবে। আমি তার কথায় রাজি হয়ে বাইরে রাস্তায় মোটরসাইকেলের উপর বসে ছিলাম। আমার বন্ধুর সরকারি পিস্তলটি আমার কাছে রেখে গিয়েছিল। রাতে শীত একটু বেশি ছিল। ওদিকে আমার বন্ধু ঐ মেয়ের সাথে বেশি সময় নেওয়ায় আমার ভীষণ রাগ লাগছিল।

আমি ঐ মেয়ের ঘরের বাইরে গিয়ে আমার বন্ধুকে দুইবার ডেকেছিলাম। তাতেও সে বাইরে আসেনি। কিন্তু আমার দেরী সহ্য হচ্ছিলো না। তাই রাগের মাথায় তাকে ভয় দেখানোর জন্য ফাঁকা গুলি করছিলাম; যাতে সে তাড়াতাড়ি বের হয়ে আসে। এমন সময় পাশের বাড়ি থেকে একজন লোক বের হয়ে বলে-
এখানে কি হয়েছে। কে তুমি?
তখন আমি বলি -তুই কে?
সে বলে -আমি পুলিশ।
আমি ভুলে বলে ফেলি -আমি তোর বাপ।

কারণ তখন আমার শক্তি ছিল আমার আর্মি বন্ধু ও তার পিস্তল। আমি ঐ পুলিশকে ভয় দেখানোর জন্য তার দিকে গুলি করি। কিন্তু গুলিটি তার গায়ে লেগে যায়। আসলে তাকে গুলি করার কোন উদ্দেশ্য আমার ছিল না।

যখন বুঝলাম তার গায়ে গুলি লেগেছে তখন মোটরসাইকেল চালিয়ে পালাতে চেষ্টা করি। পুলিশ ফাড়ি পার হওয়ার সময় তারা আমাকে আটক করে।
আপনি আমাকে বাঁচান স্যার।”

আমি তাঁর সব কথা অনেকক্ষণ ধৈর্য্য ধরে শুনছিলাম। সামান্য জেরা করে বুঝলাম সে সব সত্য কথা বলেছে। তার বক্তব্যের সাথে আগের সেই মেয়েটির বক্তব্যের মিল ছিল। তাই বেশি সময় না নিয়ে, তাকে ও জেল কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ দিয়ে অফিসে ফিরে গেলাম।

আমার সাফল্যজনক সাহসী পদক্ষেপের জন্য মনে মনে একটু গর্বিত হলাম। অবশ্য ঐ জেলখানা ভিজিটে কোন দূর্ঘটনা ঘটলে সকল দায়ভার আমাকেই বহন করতে হতো। তাই কাউকে কিছু না বলে, সকল ঘটনা উল্লেখপূর্বক পুলিশ হত্যার পূর্ণাঙ্গ লিখিত রিপোর্ট দাখিল করলাম। প্রভিন্সিয়াল কমান্ডার ও নমপেন হেডকোয়ার্টার আমার রিপোর্ট পড়ে ভীষণ খুশী হয়েছিলেন।

কম্বোডিয়ার জেলখানা একটু ভিন্ন ধরনের ছিল। আমার ভিজিটের সময় ঐ জেলে সর্বসাকুল্যে ৫০/৬০ জন হাজতি ও কয়েদি ছিল। জেলখানার মাঝখানে গোলাকার একটি মাঠের চারদিক দিয়ে সারি সারি কামরা। সারাদিন হাজতিরা ঐ মাঠে থাকে। রাতের বেলায় চারদিকের রুমে গিয়ে ঘুমায়। ঐসব রুমের সামনের দিকে খোলা। কোন জানালা দরজা নেই। কিছুটা আমাদের দেশের গোয়াল ঘরের মতো।

আমার জেলখানা ভিজিটের খবর বিদ্যুৎ বেগে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়লো। এমনকি ইন্ডিয়ান আর্মি হাসপাতালের কর্ণেল দাসগুপ্ত এই ঘটনা শুনে বেশ আগ্রহান্বিত হয়ে আমার বাসায় হাজির হয়ে তাঁকে জেলখানা দেখানোর অনুরোধ করলেন। সদর দপ্তরে তিনি ও আমি শুধু বাঙালি। এর বাইরে অন্যান্য অফিসে দুইতিন জন বাঙালি থাকলেও, যে যার কাজে ব্যস্ত থাকতেন। তাই কর্ণেল দাসগুপ্তের সাথে আমার বেশ দহরমমহরম ছিল। তাঁর জেলখানা ভিজিটের আশা পূরণ করা আমার নৈতিক দায়িত্ব হয়ে গেল। কিন্তু উপযুক্ত কারণ ছাড়া জেলখানা ভিজিটের কোন উপায় ছিল না। তাই তাঁকে সুযোগের অপেক্ষায় থাকার অনুরোধ করলাম।

আনন্দ

পুলিশ হত্যা মামলার মূল রহস্য উদঘাটনে আমার সাফল্যের জন্য গর্বিত হলাম। কম্বোডিয়ার জেলখানা ভিজিটের জন্য নিজের অভিজ্ঞতাও বেড়ে গেল। জেলের কয়েদি ও হাজতিদের সাথে মিশে আমারো বেশ ভাল লেগেছিল।

বেদনা

বাংলাদেশের মতো জাতিসংঘের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও দায়িত্ব নিয়ে কোন সাহায্য করতে চায় না। অথচ কাজ চান একশোতে একশো। চলবে…

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার। (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, অব.)




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!