খুলনা, বাংলাদেশ | ২৬ বৈশাখ, ১৪৩১ | ৯ মে, ২০২৪

Breaking News

এলিসা তুমি ফিরে আসো

এ এম কামরুল ইসলাম

ফুটফুটে মেয়েটির নাম এলিসা কার্সন Alyssa Carson. তার বয়স এখন ২১ বছর। সে আমেরিকার অধিবাসী। তার মা নেই। বাবার কাছে বড় হয়েছে। ২০৩৩ সালে তার বয়স যখন ৩২ বছর হবে তখন সে মঙ্গল গ্রহে যাবে। তাই এখন সে আকাশ ভ্রমণের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। NASA তাকে মঙ্গল গ্রহে যাবার জন্য প্রস্তুত করছে। মেয়েটি ও NASA জানে যে, সে আর কোনদিন পৃথিবীতে ফিরে আসবে না। এই মেয়েই হবে মঙ্গল গ্রহে প্রথম মানুষ। মেয়েটির এই আত্মহননের কথা ভেবে ও NASA’র এই পরিকল্পিত হত্যাকান্ডের বিপক্ষে আমার খোলা চিঠি।

স্নেহের এলিসা,

আমার এই চিঠি তুমি হয়তো কখনো পাবে না জেনেও তোমাকে লিখছি। তুমি আমার মেয়ের চেয়ে বয়সে ছোট। মিডিয়ার বদৌলতে তোমার অনেক বক্তৃতা আমি শুনেছি। তোমার সেই সাত বছর বয়স থেকে মহাশূন্যে ভেসে বেড়ানোর আকাঙ্খার জন্য তোমার নিষ্ঠুর বাবা এই পথে তোমাকে আরো লেলিয়ে দিয়েছে তাও জানি। তুমি সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায় মঙ্গল গ্রহে যেতে চাও সেটাও তুমি বহুবার বলেছো। ওখানে গেলে তোমাকে বহনকারী নভোযান এই সুন্দর পৃথিবীতে আর কখনো ফিরে আসবে না সেটা নিশ্চিত হওয়ার পরও তুমি তোমার সিদ্ধান্তে অটল রয়েছো তাও শুনেছি। মরণের পথে পাড়ি দিতে যে NASA তোমাকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে তারাও তোমাকে সব বুঝিয়ে বলে শর্ত দিয়েছে- তুমি কখনো বিয়ে করতে বা কোন পুরুষের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করতে পারবে না। তোমার এই ভরা যৌবনে সেটাও তুমি তুচ্ছ করেছো। অর্থাৎ তুমি শয়নে-স্বপনে, জাগরণে শুধু মঙ্গল গ্রহ ব্যতীত অন্য কিছুই দেখো না। পৃথিবীর কোন আকর্ষণ তোমাকে স্পর্শ করতে পারে না। সবকিছু জেনে বুঝে আমি অত্যন্ত সাধারণ একজন মানুষ বা একজন বাবা হয়ে তোমাকে লিখছি। তোমার মঙ্গল গ্রহে যাত্রার আগে যদি কোনভাবে আমার এই চিঠি তোমার বা NASA’ র হস্তগত হয় তাহলে তুমি তোমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। NASA এই চিঠি পেয়ে যেন তোমাকে হত্যা করা থেকে বিরত থাকে এই কামনা করি। আমি মৃত্যুর আগে দেখে যেতে চাই যে, তুমি ও NASA সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছো।

তোমার এই আত্মহত্যার পক্ষে তুমি হাজার যুক্তি দেখাতে পারবে। তোমার আগে পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে হাজার হাজার সৃষ্টিশীল মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পৃথিবীর রহস্য আবিষ্কার করেছে সেটাও তুমি বলবে। তারা সমগ্র পৃথিবীকে একে অপরের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে সাগর মহাসাগর পাড়ি দিয়ে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে গিয়েছে। পথিমধ্যে তারা অনেকে মৃত্যুকে হাসিমুখে বরণ করেছে। এসব যুক্তি সবই তোমার পক্ষে। তবুও তোমাকে আমি এই মরণ খেলা থেকে ফিরে আসতে সবিনয়ে অনুরোধ করছি।

তুমি হয়তো ভাবছো- এভাবে মৃত্যু হলে তুমি বিখ্যাত হবে। সারা পৃথিবী তোমাকে দীর্ঘদিন মনে রাখবে। NASA’র সদর দপ্তরে তোমার ঐতিহাসিক জীবন বৃত্তান্তসহ বিভিন্ন রঙিন ছবি দীর্ঘদিন ঝলমল করবে; কিন্তু একজন সাধারণ মানুষ হয়ে একশো বছর বেঁচে থাকলেও কেউ তোমাকে মনে রাখবে না। অতএব মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার পর অথবা পথিমধ্যে তোমার মৃত্যু হলে সারা পৃথিবীর মানুষ সেই করুণ মৃত্যুর ভিডিও দেখে কান্নার রোল তুলবে। ঐ সময় আমি বেঁচে থাকলে আমিও সবার সাথে কাঁদবো। কিন্তু তুমি কী একবারও ভেবে দেখেছো- তাতে মহাসৃষ্টি জগতের কী একটুও কান্না আসবে? বরং তোমার ও NASA’র হটকারিতায় সমগ্র সৃষ্টি তোমাদের দিকে তাকিয়ে হাসবে।

একটু গভীরে গিয়ে দেখো, -তোমাকে এখানে কে পাঠিয়েছে।

-তুমি কি তোমার ইচ্ছায় এখানে আসতে পেরেছো? নিশ্চয়ই না।

– তুমি কি একটি পিপড়া বানাতে পারো?
-বিনা কারণে কোন প্রাণী হত্যা করার কোন অধিকার কি তোমার আছে?
-এমনকি তোমার নিজেকে হত্যা করার অধিকার তোমাকে কি কেউ দিয়েছে?

সৃষ্টির সকল প্রাণী একজনের ইচ্ছায় এখানে এসেছে, আবার তাঁরই ইচ্ছায় তিনি নিয়ে যাবেন। এখানে কোন সৃষ্টি নিজের ইচ্ছায় আসতেও পারে না, যেতেও পারে না। তুমি, আমিসহ সকল সৃষ্টি একই নিয়মে আসতে এবং যেতে বাধ্য। তেমনি তুমি তাঁর ইচ্ছায় এসেছো ঠিকই, কিন্তু যেতে চাচ্ছো নিজের ইচ্ছায়। এটা কখনোই কাম্য নয়।

তুমি হয়তো বলবে- মরতে যখন হবেই তখন বীরের মতো মরবো। সমগ্র পৃথিবী তোমার মৃত্যুর ভিডিও দেখবে আর অঝোরে কাঁদবে। তুমি মহাকাশযানে বসে সবাইকে বাই-বাই, টাটা বলে হাসতে হাসতে চলে যাবে। কিন্তু আমার কাছে এ মরণ কখনো বীরত্বপূর্ণ নয়। এ মরণখেলা সৃষ্টির কোন কল্যাণ বয়ে আনবে না। বরং তোমার দৃষ্টিতে যে মৃত্যু উপভোগ্য ও অহংকারের, আমার কাছে সে মৃত্যু পাপের ও সৃষ্টিকে অপমানের।

হয়তো এমন হতে পারে, তুমি মরবে না। বরং মঙ্গল জয় করে তুমি অলৌকিকভাবে পৃথিবীতে সু্স্থ অবস্থায় ফিরে এসে সমগ্র পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিবে। তারপর যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন সমগ্র বিশ্ব তোমাকে মাথায় নিয়ে নাচবে। তুমি হবে পৃথিবীর এক নম্বর মানুষ। কিন্তু, আমি বলি- তোমার এই ভাবনা অযৌক্তিক। তোমাকে নিয়ে কেন মানুষ মাতামাতি করবে?
-তুমি এই সৃষ্টির জন্য মঙ্গল গ্রহ থেকে কী নিয়ে এলে?
-অনেক ছবি ও অনেক অজানা তথ্য?

-সৃষ্টির তাতে কী লাভ?

তোমার জন্মের আগে এই NASA কয়েকজনকে চাঁদে পাঠিয়েছিল বলে দাবি করে। তাদের দেখাদেখি আরও দু’একটা দেশ অহংকার প্রদর্শন করতে চন্দ্র বিজয়ের তকমা লাগিয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে চন্দ্র বিজয় করে এসে তারা সৃষ্টিকে কী দিয়েছে? কিছুদিন তাদের নিয়ে নাচানাচি করার পর সবাই থেমে যায়। কালের পরিক্রমায় অনেকেই মনে করে, তাদের চন্দ্র বিজয় ছিল একটা ভণ্ডামি বা গুজব। NASA বা চন্দ্রবিজয়ী দেশ সমগ্র পৃথিবীর মানুষকে বোকা বানিয়ে ভুঁয়া তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করেছে ইত্যাদি।

আমি যদি ধরে নেই তারা আসলেই চাঁদে গিয়েছিল, তাতেই বা কী আসে যায়। তথাকথিত চন্দ্র বিজয়ের পঞ্চাশ বছরের বেশি পেরিয়ে গেলেও সৃষ্টিজগৎ সেই বিজয় থেকে এ পর্যন্ত কী পেয়েছে বলতে পারো। বরং গরীবের মুখের আহার কেড়ে সেই টাকা খরচ করে চন্দ্র বিজয়ের তকমা পরেছিল। তার চেয়ে ঐ টাকা খরচ করে তখন যদি সমগ্র সৃষ্টিকে আরো সমৃদ্ধ করতে কোন অবদান রাখতো সেটাই সার্থক হতো। করোনা, মহামারী, দুর্ভিক্ষ, বৈশ্বিক বিপর্যয় এসব হয়তো এমনভাবে দেখা দিতো না। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ অনাহারে, অর্ধাহারে বা অপুষ্টিতে মারা যেতো না। চন্দ্র বিজয় বা মঙ্গল বিজয়ের চেয়ে পৃথিবীকে জলবায়ু পরিবর্তনের হাত থেকে রক্ষা করা অনেক মহৎ কাজ।

প্রিয় এলিসা,

তুমি নিজেকে অমর করতে চাইলে তোমার সামনে অগণিত পথ খোলা আছে। তোমার দৃষ্টিশক্তি আমার চেয়ে অনেক বেশি। অতএব তোমাকে অমর করার অগণিত পথ তুমি সহজেই খুঁজে পাবে। তবুও আমি সোজা কথায় কয়েকটি পথের ঠিকানা তোমাকে দিলাম।

-তুমি নেমে পড়ো মানুষের ক্ষুধা নিবারনের জন্য খাদ্য উৎপাদনের নতুন কোন পন্থা আবিস্কার করতে।

-মানুষে মানুষে হিংসা বিদ্বেষ দূর করতে আমারণ সংগ্রাম করতে পারো।

-সমগ্র পৃথিবীকে একত্রিত করতে বিশ্ব ভ্রমণ শুরু করতে পারো।

-বিশ্বব্যাপি মারণাস্ত্র তৈরি বন্ধ করতে জনমত সৃষ্টি করতে পারো।

-দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে বৈষম্য বন্ধে জনমত গড়তে পারো।

-মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করতে পারো।

-বিভিন্ন ধর্মীয় বিরোধ বন্ধ করার জন্য নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারো।

-পৃথিবীর যেসব দেশে মানুষ অনাহারে থাকে তাদের দুঃখে শরিক হওয়ার জন্য ধনী দেশকে এগিয়ে আসতে বাধ্য করতে পারো।

-জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক ক্ষতি থেকে সৃষ্টিকে রক্ষার কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারো।

-কিছু না পারো তোমার নিজের দেশের হোমলেস জনগোষ্ঠীকে ঘরে ফিরিয়ে নেওয়ার কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত কর।

এমন আরো হাজার হাজার ভাল কাজে যুক্ত হয়ে বিশ্বসেরা হও এবং নিজের জীবনকে যতদিন পারো উপভোগ কর। একান্তই যদি শত শত কোটি সাধারণ মানুষের মতো এই পৃথিবী ছেড়ে নীরবে নিভৃতে বিদায় নিতে হয় তাতে তুমি কষ্ট নিও না। মনে করবে, তুমি তোমার মতো ভাল কিছু করতে চেষ্টা করেছো এবং সৃষ্টিকর্তার দেওয়া জীবনকে সম্মানের সাথে উপভোগ করেছো।

তোমার কাছে এই আমার শেষ মিনতি।

ইতিঃ
তোমার পিতৃসম একজন শুভাকাঙ্খী।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার। (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, অব.)

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!