খুলনা, বাংলাদেশ | ২৫ বৈশাখ, ১৪৩১ | ৮ মে, ২০২৪

Breaking News

  প্রথম ধাপের উপজেলা ভোট শেষ, চলছে গণনা
  উপজেলা নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে জনগণ : রিজভী
  তেঁতুলিয়ার খয়খাটপাড়া সীমান্তে বিএসএফ’র গুলিতে দুই বাংলাদেশি নিহত

ঋণ দায় কর্তৃত্ব

গৌরাঙ্গ নন্দী

প্রাচীন ভারতীয় অর্থশাস্ত্রবিদ কৌটিল্য-এর কথা বলে সমাজে একটি প্রবাদ প্রচলিত ছিল (যা হারিয়ে যেতে বসেছে), তা হচ্ছে: ধার করে হলেও ঘি খাও। আর্থিক চাকা সচল রাখতে তাই টাকা ধার করা একটি সাধারণ প্রবণতা। এটি ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। ব্যবসায়ী গোষ্ঠী সমাজের দণ্ডমুণ্ড-নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে শুরু করলে তারা ধার করার নিয়ম-নীতি তৈরি করে; যার প্রতিফলন ছিল আমাদের মত পিছিয়ে পড়া অর্থনীতির দেশেও – তৈরি হয়েছিল দেউলিয়া আইনসহ অনেক বিধিমালা। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নাগরিকদের ঋণ দেয়; আর রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের নিকট হতে ঋণ নেয়। আমাদের দেশও এ থেকে ব্যতিক্রম নয়। সমাজকে ধনবাদী ধারায় গড়ে তোলার জন্যে ব্যক্তি তথা কর্পোরেট খাত বিকশিত করতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতেই হবে। আর এই অ-মুনাফাখাতে রাষ্ট্র ছাড়া, ব্যক্তি-ত বিনিয়োগ করবে না। আমাদের রাষ্ট্র ও সরকার সেই কাজটি করে চলেছে, আর স্বাভাবিকভাবে উন্নয়নের জন্য অর্থ ধার বা ঋণ করতে হচ্ছে। আশঙ্কার দিকটি হচ্ছে, ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, গত ১২ বছরে বাংলাদেশের ঋণ আড়াই গুণের বেশি বেড়েছে।

ওই প্রতিবেদন, ওয়ার্ল্ড ডেব্ট রিপোর্ট বা বৈশ্বিক ঋণ প্রতিবেদন ২০২৩-এর তথ্যানুসারে, ২০২২ সাল শেষে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৭ দশমিক শূন্য ১২ বিলিয়ন বা ৯ হাজার ৭১২ কোটি ডলার; ২০২১ সালে যা ছিল ৯১ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন বা ৯ হাজার ১৪৭ কোটি ডলারের বেশি। সেই হিসাবে এক বছরে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ বেড়েছে সাড়ে ৬ শতাংশের বেশি। যেখানে ২০১০ সালে বাংলাদেশের মোট বিদেশি ঋণ ছিল ২৬ দশমিক ৫২ বিলিয়ন (২ হাজার ৬৫২ কোটি) ডলার; ২০১৮ সালে যা ৫৭ দশমিক ১২ বিলিয়ন (৫ হাজার ৭১২ কোটি) ডলার ও ২০২২ সালে তা ৯৭ বিলিয়ন (৯ হাজার ৭০০ কোটি) ডলার ছাড়িয়ে যায়।
প্রশ্নটি হচ্ছে, এতে কী কোন শঙ্কা আছে? বাংলাদেশের বাতাসে এখন নির্বাচনের ডামাডোল। রাজনীতিকরা-ত এসব বিষয়ে কোন কথা বলছেন না!! তবে বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক -বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর। তিনি নিজেই বলেছেন, তাঁর ৩৬ বছরের চাকরিজীবনে অর্থনীতির এতটা খারাপ অবস্থা কখনো দেখেননি।

তাঁর মতে, দেশের অর্থনীতি প্রায় দুই বছর ধরেই সংকটে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলার-সংকট, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন, বিনিয়োগে মন্দা, জ্বালানিসংকট, আর্থিক হিসাবে ভারসাম্যহীনতা — প্রায় সব সূচকেই নেতিবাচক দশা। ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা, এখন তা অফিসিয়ালি ১১০ টাকা, বাস্তবে ১২৫ টাকায় উপরে। প্রতি মাসে ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার করে রিজার্ভ কমেছে। দুই বছরে রিজার্ভ অর্ধেক হয়েছে। ১০ বছরের মধ্যে প্রথম দেখা দিয়েছে আর্থিক হিসাবে বড় ঘাটতি। মূল্যস্ফীতি গড়ে প্রায় ১০ শতাংশ। রপ্তানি আয়েও ঘাটতি। জ্বালানিসংকট মানেই – কম কর্মসংস্থান ও উচ্চ জীবনযাত্রার ব্যয়। নানান ধরণের উদ্যোগ নিয়েও প্রবাসী আয় কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে বাড়ছে/আসছে না। সর্বোপরি যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক আকাশে ঘন-মেঘ।
সংকট কাটানোর জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) পরামর্শ দিয়ে চলেছে। ঋণের দ্বিতীয় কিস্তিও ছাড় দিয়েছে। তবে এতে স্বস্তি ফিরবে না। গভর্নর বলছেন, মার্চে সংকট কাটবে। কিন্তু তিনি কীভাবে সংকট কাটাবেন!! তাঁর কাছে ত কোন সমাধান নেই, সমাধানতো রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে।

মুশকিলটি হচ্ছে, আমাদের দেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দলগুলো একই ধারার অর্থনীতির (ধনবাদী, তথা মুক্তবাজার) ধারক-বাহক-চিন্তক হলেও নিজস্ব গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বে ভয়ানক রকমভাবে পরষ্পরবিরোধী অবস্থানে। এখনও আমাদের দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগ বিরোধী দুটো ধারায় বিভক্ত। বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে যে দলগুলো আছে, তাদের স্বাধীনভাবে চলার ক্ষমতা নেই। বিপরীতে, আওয়ামী লীগ বিরোধী প্রধান রাজনৈতিক গোষ্ঠী -বিএনপি এবং তাদের সাথে জড়িয়ে আছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী গোষ্ঠী ও অন্যান্য ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী। আওয়ামী লীগের সঙ্গেও বন্ধুত্বের সম্পর্ক রয়েছে এক বা একাধিক ধর্মীয় সংগঠনের। সত্যিটা হচ্ছে, উভয় দলের সঙ্গে যেসব ধর্মীয় রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী জড়িয়ে আছে, তাদের মানুষের মাঝে সমর্থন আছে; তবে সমর্থন একেবারেই নেই সমাজবাদের রাজনীতিতে বিশ্বাসী এক সময়ের ত্যাগী রাজনীতি ও রাজনীতিক বলে পরিচিত বামপন্থীদের। একথা বলাইবাহুল্য যে, বামপন্থাদের চেতনা ধুয়ে-মুছে এখন ধনবাদী ও তাদের দোসর ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী সমাজে বেশ জায়গা দখল-নিয়ন্ত্রণ-কর্তৃত্ব করতে শুরু করেছে।

তা একই ধারার দুই (বা ততোধিক) গোষ্ঠীর মধ্যে কর্তৃত্ব নিয়ে বিরোধ থাকবে না? থাকবে বৈকি। তা আছে। এবং এক পক্ষ আর এক পক্ষকে নিশ্চিহ্নও করতে চাইছে। ১৯৭৫এর পর থেকে আওয়ামী ধারাকে অর্থাৎ তখনকার প্রেক্ষাপটে পিছিয়ে থাকা অর্থনৈতিক-সামাজিক গোষ্ঠীকে (যারা এই পনের বছরে অনেক বেশী শক্তিশালী ও সংগঠিত) নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা হয়েছে। এখন ঠিক তার বিপরীত ধারা বহমান। ইতোমধ্যে, সমাজে একটি বড় ধরণের রূপান্তর ঘটে গেছে। সেটি হচ্ছে সমাজের ধনবাদী রূপান্তর। মানুষ সাধারণভাবে ধনী হতে চায়, সম্পদশালী হতে চায়, ছাত্র-যুবা ক্যারিয়ার চায়, নিশ্চিন্ত-স্বচ্ছন্দ্যের ভবিষ্যত চায়। একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামের একজন বাসিন্দারও স্বপ্ন ওই একই, স্বচ্ছন্দ্য-সম্পদ। প্রতিবেশী কষ্টে আছে, তার প্রতি সহমর্মিতা দেখানো প্রয়োজন, তা আর প্রতিবেশী ভাবে না। গরীব প্রতিবেশী যদি ধনী প্রতিবেশীর সমর্থক হয়, তবে হয়তো কিছু সহায়তা-সমর্থন মেলে; অথবা ক্ষমতাকাঠামোর মধ্যে থাকা মানুষগুলো (স্থানীয় পরিষদের নির্বাচিতরা) নিজ অনুসারীদের মাঝে হয়তো সহায়তার সামান্য হাত বাড়িয়ে দেয়।

চেষ্টাটাও তাই, একটি ধনবাদী সমাজ তথা মুক্তবাজার অর্থনীতির দেশ গড়ে তোলার। তার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে, যাকে উন্নয়নের দৃশ্যমান বস্তু করা হয়েছে। আর আস্থাভাজনদের দিয়ে কর্পোরেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হচ্ছে। এতে স্বাভাবিকভাবে সীমহীন দুর্নীতি, জবর-দখল, অনৈতিকতা, প্রাকৃতিক সম্পদ উজাড়-দখল-কর্তৃত্ব, মূল্যবোধ ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিলুপ্তির এক উদ্বেগজনক চিত্র জোর কদমে এগিয়ে চলতে শুরু করেছে।

ধনবাদী ধারায় দেশ বিকশিত হোক, তা যেমন আওয়ামী লীগ চায়, বিরোধীরাও চায়, ব্যবসায়ী গোষ্ঠীতো চায়-ই। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী বা অপরাপর ছোট-খাট ধর্মীয় ভাবাপন্ন দলগুলোরও অর্থনীতির এসব বিষয়ে কোন মতভিন্নতা নেই। যে কারণে সমাজটি একেবারে ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে-কর্তৃত্বে পরিচালিত হলেও কারও কোন উদ্বেগ তৈরি হয় না। কার্যত: মুক্ত-বাজার অর্থনীতির নামে দেশটি নতুন গড়ে ওঠা ব্যবসায়ী সমাজ নিয়ন্ত্রণ করছে এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদেরকে সকল এবং সফলভাবে সহায়তা করে চলেছে। যেহেতু বিরোধী গোষ্ঠীরও অর্থনীতি নিয়ে ভিন্নমত নেই, ভিন্নমত শুধুমাত্র শাসনতান্ত্রিক কাঠামোয় অংশগ্রহণের সুযোগ নিয়ে; সে-কারণে ধনীদের মধ্যে বর্তমানের অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী গোষ্ঠী যেমন চাইছে, দুর্বলতর গোষ্ঠীটি ক্ষমতা থেকে দূরে থাকুক; আর দুর্বল গোষ্ঠটি শাসনক্ষমতায় যাওয়ার নিশ্চয়তা না পেয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে চাইছে না। এ কারণে এবারে বেশ চেষ্টা ছিল বিএনপি থেকে নেতাদের বের করে আনা। যে কারণে রাজনীতির মাঠে হঠাৎ করে কিংস পার্টির নাম শোণা যায়। কিংস পার্টি মানে সরকারের সহায়তায় গড়ে ওঠা বা সরকারকে সহায়তা করবে এমন পার্টি। প্রকৃতপক্ষে, তারা তেমন সাড়া জাগাতে পারেনি। আর স্বাভাবিকভাবে সাড়া জাগাতে না পারায় সরকারের পক্ষ হতেও তেমন সহায়তা তারা পাচ্ছে না। দৈবাৎ, দু’-একজনের বরাতে সংসদ সদস্য হওয়ার সুযোগ তৈরি হতে পারে।

বিপদটি হচ্ছে অন্যত্র। তা হচ্ছে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন এই ধারাটি বিজয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বিরোধী যে পক্ষটি সমাজে থাকছে, তাদের মধ্যে আরও মৌলবাদী ঝোঁক বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এমনিতে তাদের মধ্যে মৌলবাদী একটি গোষ্ঠী অতি ক্রিয়াশীল। ইতিমধ্যে ভারত বিরোধিতার রাজনীতি দৃঢ় হয়েছে, যা আরও দৃঢ়তর হবে। সমাজের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িকতার বিকাশ ঘটবে; অবশ্য, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও সাম্প্রদায়িকতা, বিভেদের রাজনীতি অবসানের তেমন কোন ভাবনা বা পরিকল্পনা নেই। সবচেয়ে উদ্বেগজনক হচ্ছে, অর্থনীতির ভঙ্গুর দশাকে কেন্দ্র করে যে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা রাজনৈতিক নেতৃত্বের হেলাফেলা প্রতিক্রিয়ায় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে আরও বেশী শক্তিশালী করে তুলতে পারে। মনে রাখা দরকার যে, ক্ষমতা কাঠামোর কর্তৃত্ব নিরঙ্কুশ করতে ভিন্নমত, মুক্তচিন্তা বিকাশের সকল পথগুলো বন্ধ করা এবং এককেন্দ্রিক ভাবনা ও রাজার পায়ে অবনত হওয়ার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তা সত্যিকারের মানবিক-গণতান্ত্রিক সমাজ বিরোধী, একাত্তরের চেতনা বিরোধীও।

খুলনা, বাংলাদেশ; ডিসেম্বর ১৯, ২০২৩




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!