খুলনা, বাংলাদেশ | ৩ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ | ১৭ মে, ২০২৪

Breaking News

  কক্সবাজার সদর উপজেলায় খাল থেকে দুই জেলের মরদেহ উদ্ধার
  রাজধানীর বাসাবোতে ১১ তলা থেকে পড়ে দুই শ্রমিকের মৃত্যু, আশঙ্কাজনক ১
  কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে যাত্রীবাহী বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে নিহত ৫, আহত ১৫

ইতিবৃত্ত পর্যালোচনা : প্রেক্ষিত বাংলাদেশের বাজেট ২০২২-২০২৩

জিয়াউর রহমান

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় বাজেট প্রণয়ন করা হয়। বাংলাদেশের বাজেট প্রণয়ন করা হয় জুন মাসে এক বছরের জন্য, যা বছরের পহেলা জুলাই থেকে পরবর্তী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত মেয়াদ কার্যকর থাকে। মূলত সরকারের নির্দিষ্ট সময়ের (১ জুলাই থেকে পরবর্তী বছরের ৩০ জুন) দেশের আর্থিক পরিকল্পনার সুষ্ঠু চিত্র প্রতিফিলত হয় বাজেটের মাধ্যমে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৮৭(১) অনুচ্ছেদে বাজেট শব্দটি ব্যবহারের পরিবর্তে সমরূপ শব্দ ‘বার্ষিক আর্থিক বিবরণী’ ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতি বছর জুন মাসে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে সরকারের পক্ষে অর্থমন্ত্রী বাজেট বিল আকারে পেশ করেন।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য বাজেট পেশ করেছেন জাতীয় সংসদে গত ৯ জুন ২০২২ তারিখে। বৈশ্বিক মহামারি করোনা (কোভিড-১৯) পরবর্তী অর্থনৈতিক অভিঘাত সফলভাবে মোকাবেলা করে চলমান উন্নয়ন বজায় রাখা ও উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য সামনে রেখে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল । ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেটের শিরোনাম করা হয়েছে ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় পরিবর্তন’। অর্থ্যাৎ এবারের বাজেটে মহামারি করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতির পুন:রুদ্ধারের আশা ব্যক্ত করেছেন অর্থমন্ত্রী। প্রস্তাবিত বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হয়েছে এবং মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। মোট বিনিয়োগ ধরা হয়েছে জিডিপির ৩১.৫ শতাংশ যার মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ ২৪.৯ শতাংশ এবং সরকারি বিনিয়োগ ৬.৬ শতাংশ। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেটে মোট রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছরে আয় ধরা হয়েছিল ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। সে অনুযায়ী এবারে বাজেটে মোট প্রাক্কলিত আয়ের পরিমাণ বাড়ছে ৪৪ হাজার কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)তে এ অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ লক্ষ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা।

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ইউক্রেন-রাশিয়ার কারণে বাংলাদেশের দ্রব্যমূল্যের দাম নিয়ন্ত্রণ সহ উৎপাদন সরবরাহ ঠিক রাখা। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের জন্য জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত বাজেট হচ্ছে দেশের ৫১তম বাজেট। স্বাধীনতা পরবর্তী ভঙ্গুর অর্থনীতির স্বাধীন বাংলাদেশে মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার দেশের প্রথম বাজেট সংসদে উপস্থান করেন জাতীয় নেতা ও তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭২ সালের ৩০ জুন। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ একই সঙ্গে ১৯৭১-৭২ ও ১৯৭২-৭৩ অর্থবছর অর্থাৎ দুই অর্থবছরের বাজেট ১৯৭২ সালের ৩০ জুন ঘোষণা করেছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত ভঙ্গুর অর্থনীতির ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে প্রথম বাজেট যা ছিল বিদেশি অনুদান ও ঋণ নির্ভর যেটাকে তিনি আখ্যা দিয়েছিলেন ‘উন্নয়ন এবং পুনর্নির্মাণ ও পুনর্বাসন বাজেট’। আর এবার ঘোষিত বাজেট হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেটের প্রায় ৮৬০ গুণ যার শিরোনাম করা হয়েছে ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় পরিবর্তন’।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেট ও স্বাধীনতার ৫১তম বাজেটের মধ্যে টাকার অঙ্ক ও সময়ের অনেক ব্যবধান থাকলেও দুটি বাজেটের লক্ষ্য এক ও অভিন্ন অর্থ্যাৎ বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা। আমরা আশাবাদী বর্তমান সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সংসদে উপস্থাপিত বাজেট যথাযথভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট যথাযথভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে করোনা ভাইরাসের মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতির পুনঃরুদ্ধারসহ ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশের উদীয়মান অর্থনীতি এটাই আমাদের সকলের কামনা।

একটি দেশের বাজেট ঘোষণার পর সেটি নিয়ে যেভাবে আলোচনা ও সমালোচনা হয়, বাজেট প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ততটা সহজ নয়। কেননা প্রতিটি দেশের জন্য প্রণিত বাজেটের কাঠামো ও আইনি ভিত্তিও বহুমাত্রিক। প্রতি বছর সংসদে অর্থমন্ত্রী যে বাজেট উপস্থাপন করেন সেই ‘বাজেট’ শব্দের উৎপত্তি নিয়েই রয়েছে বিস্তর বিতর্ক। কেননা ‘বাজেট’ ইংরেজি শব্দ। সাবেক অর্থ সচিব ও অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলি খান তাঁর রচিত ‘বাংলাদেশে বাজেট : অর্থনীতি ও রাজনীতি’ বইয়ে লিখেছেন- মধ্যযুগের ইংরেজি ‘বুজেট’ (Bougette) থেকে বাজেট শব্দের উৎপত্তি। বুজেট শব্দের অর্থ মানিব্যাগ বা টাকার থলি। বাংলায় থলির সমার্থক বোচকা-পোটলা। তবে, বুজেট এর পরিভাষা এখনো রচিত হয়নি। বাংলা একাডেমির বিবর্তনমূলক অভিধানে উল্লেখ রয়েছে বাংলায় বাজেট শব্দটি ১৯০২ সালে প্রথম ব্যবহার করেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাজেটের উৎপত্তি হয়েছে আজ থেকে প্রায় সাড়ে ৩ শ বছর আগে। ১৭২৫ থেকে ১৭৪২ সাল পর্যন্ত রবার্ট ওয়ালপুল যুক্তরাজ্যের অর্থমন্ত্রী এবং কার্যত প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি সারাবছরই কর কমানো বা কর বাতিলের দাবি পেতেন। এসব তিনি একটি ‘বুজেটে’ বা মানিব্যাগে ভরে রাখতেন। অর্থবছরের শেষদিকে যখন বাজেট তৈরির কাজ শুরু হতো, তখন তিনি কাগজগুলোর ভিত্তিতে আয়-ব্যয়ের হিসাব দাঁড় করাতেন । মানে বাজেট প্রণয়ন করতেন। সেই থেকে ‘টাকার থলি বা বাজেট’ হয়ে গেছে সরকারের বার্ষিক হিসাব-নিকাশের প্রতিশব্দ। সুতারং ইতিহাস বলে, বাজেট-ব্যবস্থার উৎপত্তি মানিব্যাগ থেকে। শিল্পবিপ্লবের পর ইংল্যান্ডের অর্থনীতি অনেক বড় হয়। ফলে বাজেট-সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো বাড়তে থাকে। এত বেশি দাবি আসে যে, এসব প্রস্তাব শুধু একটি মানিব্যাগে সংকুলান সম্ভব হয় না। ফলে মানিব্যাগের জায়গায় আসে ব্রিফকেস। বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী সংসদের বাজেট অধিবেশনে ব্রিফকেস নিয়ে যান এবং ব্রিফকেসের ভেতর থাকে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতার কপি।

বাজেট হচ্ছে একটি দেশের সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের হিসাব। সরকারকে দেশ চালাতে হয়, সরকারের হয়ে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের বেতন দিতে হয়, আবার নাগরিকদের উন্নয়নের জন্য রাস্তাঘাট বানানোসহ নানা ধরনের উদ্যোগ নিতে হয়। সুতরাং একটি নির্দিষ্ট অর্থবছরে কোথায় কত ব্যয় হবে, সেই পরিকল্পনার নামই বাজেট।

মহান জাতীয় সংসদে প্রতিবছর জুন মাসে অর্থমন্ত্রী বিল আকারে যে বাজেট উপস্থাপন করেন তার আইনি ভিত্তি হচ্ছে মূলত: বাংলাদেশের সংবিধান। সংবিধানের ৮৭(১) অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে- ‘প্রত্যেক অর্থ-বৎসর সম্পর্কে উক্ত বৎসরের জন্য সরকারের অনুমিত আয় ও ব্যয়-সংবলিত একটি বিবৃতি (এই ভাগে ‘বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি’ বা Annual Financial Statement নামে অভিহিত)। অর্থ্যাৎ সংবিধানে স্পষ্টভাবে বাজেট শব্দটি উল্লেখ নেই আছে ‘বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি’ । মূলত এই বার্ষিক আর্থিক বিবৃতিই ‘বাজেট’ নামে অভিহিত। সংবিধানের পঞ্চম ভাগের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের আওতায় ৮১ থেকে ৯৩ নম্বর অনুচ্ছেদে সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনার ভিত্তি বর্ণিত আছে। তাছাড়া সংবিধানের ১৫২(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘অর্থ-বৎসর’ অর্থ্যাৎ জুলাই মাসের প্রথম দিবসে অর্থ বৎসরের আরম্ভ।

বাংলাদেশের সংসদে অর্থমন্ত্রী যে বাজেট উপস্থাপন করেন তার রীতি বর্ণিত আছে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি’তে। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ষোড়শ অধ্যায়ে ‘আর্থিক বিষয়াবলী সংক্রান্ত কার্যপদ্ধতি’ শিরোনামে বাজেট, মঞ্জুরি-দাবি, নির্দিষ্টকরণ বিল, সম্পূরক ও অতিরিক্ত মঞ্জুরি এবং ঋণের ওপর ভোট, ছাঁটাই প্রস্তাব, প্রস্তাবের ওপর আলোচনা, আলোচনার জন্য স্পিকার বরাদ্দকৃত সময় ইত্যাদির বিশদ বর্ণনা রয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি’র ১১১(১) বিধিতে বার্ষিক আর্থিক বিবৃতিকে ‘বাজেট’ নামে উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি’র ১১১(২) বিধিতে বলা হয়েছে, ‘এই ব্যাপারে সংবিধানের বিধান সাপেক্ষে অর্থমন্ত্রী যেরূপ উপযোগী মনে করেন, সেই আকারে বাজেট সংসদে পেশ করিবেন।’

১৯৭২ সাল থেকে সংসদে বাজেট উপস্থাপন করা হলেও ২০০৯ সালের আগ পর্যন্ত সরকারি অর্থ ব্যবস্থাপনার সুনির্দিষ্ট কোনো আইন ছিলনা। যারফলে সরকারি অর্থ ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রিত হতো মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রণীত বিধির মাধ্যমে। ২০০৯ সালে সংবিধানের ৮৫ অনুচ্ছেদের বিধান সাপেক্ষে বাংলাদেশে প্রণীত হয় ‘সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন-২০০৯’। বর্তমানে বাংলাদেশের সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হয়ঃ ‘সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন-২০০৯’; সচিবালয় নির্দেশমালা-২০১৪; রুলস অব বিজনেস-১৯৯৬; জেনারেল ফিন্যান্সিয়াল রুলস ইত্যাদির বিধি-বিধান মোতাবেক। সংবিধানের ৮২ অনুচ্ছেদ মোতাবেক ‘রাষ্ট্রপতির সুপারিশ’ নিয়ে ‘সংসদে উত্থাপন করা’ হয় অর্থ বিভাগ হতে প্রণীত প্রস্তাবিত বাজেট। অর্থমন্ত্রী সংসদে বাজেট বিল আকারে উপস্থাপনের পর উত্থাপিত বাজেট নিয়ে সংসদে আলোচনা হয়, সংসদে তর্ক হয় ও বিতর্ক হয়। সংসদে উত্থাপিত অর্থবিল সংসদ সদস্যদের অনুমোদনের পর এটি আইনে পরিণত হয় এবং তা পরবর্তী অর্থবছরের জন্য কার্যকর হয়। বাংলাদেশে প্রণীত বাজেটের অংশ থাকে মূলত তিনটিঃ যার প্রথম ভাগে থাকে আয়ের হিসাব।অর্থ্যাৎ প্রস্তাবিত বাজেটের সরকারের সম্ভাব্য আয়ের হিসাব থাকে। সরকারের সম্ভাব্য আয়ের উৎস আবার তিনটি যথা জনগণ কর্তৃক প্রদেয় কর (এনবিআর ও অন্যান্য সংস্থা কর্তৃক আদায়কৃত কর); কর বহির্ভূত আয় (ফি, লভ্যাংশ, অর্থদণ্ড, জরিমানা ইত্যাদি) এবং বৈদেশিক অনুদান।

বাংলাদেশে প্রণীত বাজেটের দ্বিতীয় ভাগে থাকে সরকারের সম্ভাব্য ব্যয়ের হিসাব। বাজেটের সম্ভাব্য ব্যয় চারটি ভিন্ন খাতে বিভক্ত করা হয়ঃ পরিচালন ব্যয়; খাদ্য হিসাবে ক্রয়; ঋণ ও অগ্রিম বাবদ পরিশোধ এবং উন্নয়ন ব্যয়। বাজেটের যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য দরকার আয়-ব্যয়ের সঠিক হিসাব। ড আকবর আলি খান তার ‘বাংলাদেশে বাজেট: অর্থনীতি ও রাজনীতি’ উল্লেখ করেছেন ‘আমরা যেমন দেখি, ‘যদি সঠিক আয়ের হিসাবে বাজেটের ব্যয় নির্ধারণ করা হয়, তাহলে অনেক অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাস করা সম্ভব হবে’।

বাজেটের তৃতীয় ভাগে থাকে সম্ভাব্য ঋণের পরিমাণ। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে বাজেটকে বলা হয় ‘ঘাটতি বাজেট’। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের সব বাজেটই ছিল ‘ঘাটতি বাজেট’। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে কিছুটা ঘাটতি থাকা ভালো কেননা এতে অব্যবহৃত সম্পদের ব্যবহার বাড়ে, ঘাটতি পূরণের চাপ থাকে এবং অর্থনীতিতে উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা যা জিডিপির ৫.৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ছিল ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি যা ছিল জিডিপির ৬.২ শতাংশ। অর্থনীতিবিদদের মতে, সাধারণত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ শতাংশ পর্যন্ত ঘাটতি বাজেট মেনে নেওয়া হয়। বাজেট ঘাটতি দুভাবে পূরণ করা হয়। যেমন,বৈদেশিক উৎস এটি মূলত বৈদেশিক ঋণ। সরকার বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশ থেকে সহজ শর্তে ঋণ নেয়। এই উৎস থেকে বেশি ঋণ নিয়ে ঘাটতি পূরণ করতে পারলে তা অর্থনীতির জন্য বেশি সহনীয়। কারণ, এতে সুদ হার কম এবং পরিশোধ করতে অনেক সময় পাওয়া যায়। তবে শর্ত থাকে বেশি। অভ্যন্তরীণ উৎস সরকার দুভাবে দেশের ভেতর থেকে ঋণ নেয়। যেমন, ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও ব্যাংকবহির্ভূত ব্যবস্থা। ব্যাংকবহির্ভূত ব্যবস্থা হচ্ছে সঞ্চয়পত্র। ‘ঘাটতি বাজেট’ নেতিবাচক শুনালেও এটা বরং উন্নয়ন সহায়ক। আইএমএফের তথ্যমতে, কাতার, লুক্সেমবার্গ, উজবেকিস্তান ইত্যাদি পেট্রো-ডলারে সমৃদ্ধ হাতেগোনা কয়েকটি দেশ বাদে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ‘ঘাটতি বাজেট’ দেওয়া হয়।

দেশে দেশে বাজেট উপস্থাপনের নানা ঐতিহ্য রয়েছে। সব দেশেই অর্থমন্ত্রীদের ব্রিফকেস সঙ্গে নিয়ে সংসদে বাজেট ঘোষণার রেওয়াজ দেখা যায়। তবে ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন তার প্রথম বাজেটটি ঘোষণার সময় ব্রিফকেসের পরিবর্তে লালসালুতে মোড়া বাজেট ডকুমেন্ট সঙ্গে নিয়ে সংসদে ঢুকেছিলেন। দক্ষিণ ভারতীয় ঐতিহ্যের লাল শাড়ির সঙ্গে সামাঞ্জস্য রেখে ওই বছরের বাজেট ডকুমেন্ট সাজিয়েছিলেন তিনি। কানাডায় ১৯৫০ সাল থেকে সে দেশের অর্থমন্ত্রী বাজেট পেশের আগের দিন নতুন জুতা কেনেন। সেই নতুন জুতা পায়ে দিয়ে অর্থমন্ত্রী সংসদে যান, বাজেট পেশ করেন। কানাডার ইতিহাসে প্রথম নারী অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড এ বছর জুতা কিনেছেন মোড়ের দোকান থেকে। করোনা আক্রান্ত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রণোদনার প্রতীক হিসেবে। আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশের বাজেটের প্রতীক হলো ‘ব্রিফকেস’। আর এই ব্রিফকেসটি কেনা হয় অর্থ বিভাগে সেবা শাখার মাধ্যমে।

প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক অবকাঠামো খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ২৭.০৫ শতাংশ; এর মধ্যে মানবসম্পদ খাতে (শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাত) বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা। ভৌত অবকাঠামো খাতে প্রস্তাব করা হয়েছে ২ লাখ ৮৬০ কোটি টাকা বা ২৯.৬২ শতাংশ; যার মধ্যে সার্বিক কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন খাতে ৮৬ হাজার ৭৯৮ কোটি; যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে ৭৯ হাজার ২৬ কোটি এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ২৬ হাজার ৬৫ কোটি টাকা। সাধারণ সেবা খাতে প্রস্তাব করা হয়েছে ১ লাখ ৫৩ হাজার ২০৮ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ২২.৫৯ শতাংশ। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি), বিভিন্ন শিল্পে আর্থিক সহায়তা, ভর্তুকি, রাষ্ট্রায়ত্ত, বাণিজ্যিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের জন্য ব্যয় বাবদ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ৫৩ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৭.৮৪ শতাংশ; সুদ পরিশোধ বাবদ প্রস্তাব করা হয়েছে ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ১১.৮৫ শতাংশ; নিট ঋণদান ও অন্যান্য ব্যয় খাতে প্রস্তাব করা হয়েছে ৭ হাজার ৪১ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ১.০৪ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা, যোগাযোগ অবকাঠামো, ভৌত অবকাঠামো, আবাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, কৃষি, মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।

পরিশেষে বলা যায় যে, স্বাধীন বাংলাদেশের ৫১তম বাজেটের শিরোনাম করা হয়েছে ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় পরিবর্তন’ এবং বাজেট প্রস্তুত করা হয়েছে সরকারের অতীতের অর্জন এবং উদ্ভূত বর্তমান করোনা ও ইউক্রেন -রাশিয়ার যুদ্ধের সম্ভাব্য ক্ষতি পুষিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে। এছাড়া ২৫ জুন ২০২২ উদ্বোধন করা হল নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত পদ্মা সেতু যা দেশের জিডিপিতে ১.২৬ শতাংশের বেশী অবদান রাখবে মর্মে অর্থনীতিবিদরা মতামত ব্যক্ত করেছেন। সুতারং আমরা আশাবাদী যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশে যে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে তার ধারা অব্যাহতসহ আগামীতে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভীত মজবুত করার পদক্ষেপের প্রতিফলন আমরা দেখতে পারবো প্রস্তাবিত বাজেটের সফল বাস্তবায়নের মাধ্যেমে।

(লেখক : উপসচিব ও কনসালটেন্ট, এটুআই প্রজেক্ট, ঢাকা)

খুলনা গেজেট/ টি আই




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!