খুলনা, বাংলাদেশ | ২৯ বৈশাখ, ১৪৩১ | ১২ মে, ২০২৪

Breaking News

  রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাতভর ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষ, আহত ৩

আয়কর রিটার্ন : হিসাব নিকাশ করবেন কিভাবে

গেজেট ডেস্ক

এ দেশের মানুষ কর দেওয়াকে ঝামেলার বিষয় মনে করেন। তাঁদের ধারণা, একবার কর দিলে কর কর্মকর্তাদের চোখে পড়ে যাবেন। তাহলে প্রতিবারই কর দিতে হবে। কর কার্যালয়ে হয়রানি একদম হয় না, তা–ও ঠিক না। হয়রানির অভিযোগ বহুকালের। তাই অনেকে করযোগ্য আয় থাকা সত্ত্বেও কর দেন না। করের হিসাব-নিকাশও একটু জটিল। সাবধানে হিসাব–নিকাশ করতে হয়। কৌশলী হলে করে ছাড়ও পাওয়া যায়।

প্রতিবছর ১ জুলাই থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত বার্ষিক আয়কর বিবরণী জমা দেওয়া যায়। আপনি চাইলে আজই কর বিবরণী জমা দিতে পারবেন। এতে শেষ মুহূর্তের ঝামেলা থেকে বাঁচবেন। তবে রিটার্ন ফরম পূরণের আগে দেখে নেবেন, সর্বশেষ বাজেটে কী ধরনের পরিবর্তন আনা হলো। তাহলে রিটার্ন ফরম পূরণ করা অনেক সহজ হয়ে যাবে। করোনাকালে ব্যস্ততা কম থাকায় এবার দেখে নিই কোথায় ছাড়, কোথায় কর আছে।

৩ লাখ টাকা পর্যন্ত কর নেই : এবারের বাজেটে করদাতাদের জন্য বড় সুখবর দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। করমুক্ত আয়সীমা আড়াই লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে তিন লাখ টাকা করা হয়েছে। পাঁচ বছর পর এই পরিবর্তন আনা হলো।

বার্ষিক তিন লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ে কোনো কর দিতে হবে না। পরের এক লাখ টাকার জন্য ৫ শতাংশ হারে; পরের তিন লাখ টাকার জন্য ১০ শতাংশ; পরের ৪ লাখ টাকার জন্য ১৫ শতাংশ; পরের ৫ লাখ টাকার জন্য ২০ শতাংশ এবং অবশিষ্ট টাকার জন্য ২৫ শতাংশ হারে কর দিতে হবে। সবচেয়ে নিচের দিকে থাকা করদাতা এবং সবচেয়ে ধনীদের কর কমল।

একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যেতে পারে, গত বছরের জুলাই থেকে এ বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত সব মিলিয়ে আপনার ১০ লাখ টাকা করযোগ্য আয় হলো। তাহলে আপনাকে কত কর দিতে হবে, সেটা দেখা যাক। প্রথম তিন লাখ টাকার ওপর কর নেই। আপনার উপার্জিত বাকি সাত লাখ টাকার ওপর কর বসবে। সেখানে প্রথম এক লাখ টাকার ওপর ৫ হাজার টাকা; পরের তিন লাখ টাকার জন্য ৩০ হাজার টাকা এবং বাকি তিন লাখ টাকার ৪৫ হাজার টাকা। মোটা দাগে, আপনার করের পরিমাণ দাঁড়াবে ৮০ হাজার টাকা। এভাবে যত আয় বাড়বে, করের হার এবং পরিমাণও বাড়ে।

অন্যদিকে নারী ও ৬৫ বছরের বেশি প্রবীণ করদাতাদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা করা হয়েছে। প্রতিবন্দ্বী করদাতাদের সাড়ে ৪ লাখ টাকা এবং গেজেটভুক্ত যোদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও প্রতিবন্দ্বী ব্যক্তির পিতা–মাতা ও অভিভাবকদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা চার লাখ ৭৫ হাজার টাকা করা হয়েছে।

মনে রাখবেন, আপনার আয় তিন লাখ টাকা পার হলে রিটার্ন দিলেই আপনাকে ন্যূনতম কর দিতেই হবে। যেমন ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ৫ হাজার টাকা, অন্য সিটিতে ৪ হাজার টাকা এবং এর বাইরে যেকোনো এলাকায় ৩ হাজার টাকা ন্যূনতম কর দিতেই হবে।

অনলাইনে দিলে ২ হাজার টাকা ছাড় : হয়রানির ভয়ে আপনি কর কার্যালয়ে গিয়ে কর দিতে চান না কিংবা ব্যস্ততার কারণে সশরীরে সেখানে যাওয়ার সময় পাচ্ছেন না। তাই ঘরে বসে অনলাইনে রিটার্ন দিতে চান। তাহলে আপনার জন্য বিশেষ সুযোগ আছে। প্রথমবার অনলাইন রিটার্ন দিলে দুই হাজার টাকা কর ছাড় পাবেন।

যদি ১২ সংখ্যার ইলেকট্রনিক কর শনাক্তকরণ নম্বর (ইটিআইএন) থাকলে করযোগ্য আয় থাকুক, আর না–ই থাকুক অবশ্যই বছর শেষে আপনাকে রিটার্ন দিতেই হবে। তবে ক্রেডিটকার্ডধারী ও জমি বিক্রেতারা এই ক্ষেত্রে ছাড় পাবেন।

এদিকে সম্পদের ওপর সারচার্জ আগের মতোই বহাল রাখা হয়েছে। তিন কোটি টাকার বেশি সম্পদ থাকলে আয়করের ওপর বিভিন্ন হারে সারচার্জ দিতে হবে।

হিসাব-নিকাশ : চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, জীবননাশী রোগের চিকিৎসা খরচ, যাতায়াত, প্রভিডেন্ড ফান্ড, শ্রমিক তহবিলসহ বিভিন্ন খাতে একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত উপার্জনে কর ছাড় আছে।

চাকরিজীবী হলে আপনার মূল বেতন, বিশেষ বেতন, বোনাস, মহার্ঘ ভাতা সবই করযোগ্য আয় হিসেবে বিবেচিত হবে। যেমন মূল বেতন যদি ৫০ হাজার টাকা হয়, তাহলে বছর শেষে ১২ মাসের মূল বেতন যোগ হয়ে ৬ লাখ টাকা করযোগ্য আয় হবে। আর দুই ঈদে যদি দুটি উৎসব বোনাস হিসেবে মূল বেতনের সমান টাকা পান, তাহলে আরও ১ লাখ টাকা যোগ হবে। মহার্ঘ ভাতা পেলেও তা যোগ হবে।

মনে রাখবেন, আপনার বাড়িভাড়া হিসেবে পাওয়া পুরো টাকা কিন্তু করযোগ্য আয় নয়। বাড়িভাড়ার টাকায় ছাড় আছে। বাড়িভাড়া বাবদ যে টাকা পাবেন, এর মধ্যে মূল বেতনের ৫০ শতাংশ বা মাসিক ২৫ হাজার টাকার মধ্যে যেটি কম, তা করমুক্ত। যেমন আপনার মূল বেতন ৫০ হাজার টাকা এবং বছর শেষে মূল বেতন বাবদ আয় ৬ লাখ টাকা। তাহলে বাড়িভাড়া বাবদ বছরে তিন লাখ টাকা বা মাসে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত করমুক্ত। কিন্তু আপনি বাড়িভাড়া বাবদ প্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা পেলেন, তাহলে কী হবে? উত্তর সহজ, বাড়তি ৫ হাজার টাকা হিসাব করে ৬০ হাজার টাকা করযোগ্য আয় রিটার্নে যোগ করে দেবেন এবং কর দিতে হবে।

একইভাবে একজন চাকরিজীবীর চিকিৎসা ভাতায় ছাড় মিলবে মূল বেতনের ১০ শতাংশ বা ১ লাখ ২০ হাজার টাকার মধ্যে যেটি কম, তাতে কর ছাড় মিলবে।

আপনি অফিসে যাতায়াতের জন্য ভাড়ার টাকা পান। নিয়োগকর্তা যাতায়াত বাবদ খরচ দেন। যাতায়াত ভাতার ৩০ হাজার টাকা (বছরে) পর্যন্ত কোনো কর নেই। তবে যাতায়াত ভাতার পরিমাণ এর বেশি হলে বাড়তি টাকা করযোগ্য আয়ে পড়ে যাবে। তবে কোনো চাকরিজীবী যদি অফিস থেকে গাড়ি পান, তাহলে রক্ষণাবেক্ষণ খরচ হিসেবে মূল বেতনের ৫ শতাংশ বা বছরে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত করমুক্ত থাকবে।

রোগবালাই নিয়েও করে ছাড় আছে। আপনি হৃদ্‌রোগ, কিডনি, চক্ষু, লিভার ও ক্যানসারের মতো জীবননাশী রোগে ভোগেন এবং সার্জারির খরচের জন্য অফিস যত টাকা দেবে, পুরোটাই করমুক্ত। তবে কোনো কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার পরিচালক এই সুবিধা পাবেন না।

এ ছাড়া শ্রমিক কল্যাণ তহবিল থেকে বিপদ-আপদে টাকা পেলেন, সেই টাকার পরিমাণ ৫০ হাজার টাকার কম হলে তা করমুক্ত থাকবে।

শ্রান্তি বিনোদন ছুটির টাকা করমুক্ত। অনেক প্রতিষ্ঠান ছুটির বিপরীতে নগদ অর্থ দেন। সেই ছুটি নগদায়নের টাকাও করমুক্ত। তবে তা বছরে ৬০ হাজার টাকার কম হতে হবে। অবসর গ্রহণের পর গ্র্যাচুইটি বাবদ আড়াই কোটি টাকা পর্যন্ত করমুক্ত। তবে খুব ভালো করে মনে রাখুন, গ্র্যাচুইটির টাকার নিয়োগকর্তা যে তহবিলে রাখবেন, তা অবশ্যই এনবিআর থেকে অনুমোদন করিয়ে নিতে হবে। তা না হলে আপনার গ্র্যাচুইটির টাকার ওপর কর বসিয়ে দেবে এনবিআর।

বাড়িভাড়া বাবদ পুরো আয়ের ওপর কর বসবে না। আবাসিক ভাড়া দিলে এই খাতের বার্ষিক আয়ের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে খরচ দেখিয়ে রেয়াত মিলবে। বাণিজ্যিক ভাড়ার ক্ষেত্রে এই হার ৩০ শতাংশ। করোনা পরিস্থিতিতে শহর এলাকার বহু ফ্ল্যাট খালি আছে। চিন্তা নেই, কোনো মাসে ফ্ল্যাট ভাড়া না হলে বাড়িভাড়ার আয়ে তা বাদ দিলেই হবে। এ ছাড়া বাদ যাবে পৌর কর, ভূমি রাজস্ব, গৃহ নির্মাণের কিস্তির টাকা।

আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে, গাড়ির মালিকদের এবার অগ্রিম করের পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। যেমন ১৫০০ সিসি পর্যন্ত গাড়িতে আগে ফিটনেসের পরীক্ষার সময়ে ১৫ হাজার টাকা অগ্রিম কর দিতে হতো। এবার তা বাড়িয়ে ২৫ হাজার টাকা করা হয়েছে। বছর শেষে রিটার্ন দেওয়ার সময় তা অবশ্যই সমন্বয় করে নিতে হবে। এতে করের পরিমাণ কমে যাবে।

চেক লিস্ট : কর বিবরণী জমা দিতে হলে বেশ কিছু কাগজপত্র দেখাতে হবে। সেগুলোর অন্যতম হলো বেতন খাতের আয়ের দলিল, সিকিউরিটিজের ওপর সুদ আয়ের সনদ, ভাড়ার চুক্তিপত্র, সঞ্চয়পত্রের অনুলিপি, পৌর করের রসিদ, বন্ধকি ঋণের সুদের সনদ, মূলধনি সম্পদের বিক্রয় কিংবা ক্রয়মূল্যের চুক্তিপত্র ও রসিদ, মূলধনি ব্যয়ের আনুষঙ্গিক প্রমাণপত্র, শেয়ারের লভ্যাংশ পাওয়ার ডিভিডেন্ড ওয়ারেন্ট, সুদের ওপর উৎসে কর কাটার সার্টিফিকেট।

আগামী ৩০ নভেম্বর শেষ বার্ষিক কর বিবরণী জমা দিতে হবে। শেষ মুহূর্তেও ঝামেলা এড়াতে এখনই হিসাব-নিকাশ নিয়ে বসে যান। নির্বিঘ্নে কর দিন।

খুলনা গেজেট/এম এম  




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!