আগের সংসারের মেয়েকে নিয়ে বেশ অশান্তিতে ছিল তুলি বেগম। পান থেকে চুন খসলেই প্রায় মারধর করা হতো লিপাকে। মারা যাওয়ার কিছুক্ষণ আগেও সৎ বাবা রাশেদকে দোকান থেকে বিস্কুট ও সিগারেট এনে দেয় লিপা। এরপর তার মরদেহ ঘরের আড়া থেকে খাটে নামিয়ে সৎ বাবা লিপার মাকে খবর দিতে যায়। ৯ বছরের শিশুর কি অপরাধ ছিল যে তাকে মেরে ফেলতে হবে। সোমবার সন্ধ্যায় প্রতিবেশীরা আবেগের সাথে কথাগুলো এ প্রতিবেদককে বলছিলেন।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, সোমবার (১২ ডিসেম্বর) দুপুরে নতুন বাজার বস্তির সালাউদ্দিনের গলির নিজ ঘর থেকে রাশেদা (৯) নামে ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে। বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ হলে স্থানীয়রা পুলিশকে খবর দেয়। পরে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। এ ঘটনায় নিহত রাশেদার সৎ বাবা মো. রাশেদ ও মা তুলি বেগমকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে পুলিশ।
স্থানীয় বাসিন্দা সুমী আক্তার বলেন, স্থানীয় আনন্দ নিকেতনের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী ছিল লিপা। এবার তার তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হবার কথা। ৬ বছর আগে তুলি বেগমের সাথে ছাড়াছাড়ি হয় লিপার বাবা রাসেলের। এর বছর খানেক পর রাশেদের সাথে তুলির বিয়ে হয়। তারা সালাউদ্দিন গলির বাসিন্দা। নিজেদের একটি ঘরও ওই গলিতে আছে।
তিনি বলেন, লিপাকে নিয়ে রাশেদ ও তুলি বেগমের সংসার বেশ ভালই চলছিল। বিয়ের বছর খানেক পর ওই মেয়েকে নিয়ে তাদের সংসারে অশান্তি লেগে যায়। অন্যায় না করলেও লিপাকে মারধর করা হতো। কারও বাড়িতে যেতে দেওয়া হত না তাকে। ঘর থেকে বের হলেই শুরু হত শারীরিক নির্যাতন।
লিপার সৎ বাবা রাশেদ পেশায় একজন ইজিবাইক চালক। তিনি ইজিবাইক চালিয়ে সংসার চালাতেন। সোমবার দুপুর ১২ টার দিকে ইজিবাইক চালিয়ে বাড়ি ফেরেন রাশেদ। পরে লিপাকে দিয়ে দোকান থেকে বিস্কুট ও সিগারেট আনতে বলেন রাশেদ। এর কিছুক্ষণ পর রাশেদ তড়িঘড়ি করে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। পরবর্তীতে তুলি বেগমকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। পরে তারা ঘরের আড়া থেকে লিপার ঝুলন্ত মরদেহ খাটের ওপর রাখেন। তিনি আরও বলেন, লিপার মরদেহ এমনভাবে ঝুলে ছিল যে এভাবে কেউ আত্মহত্যা করতে পারে না। তাছাড়া পুলিশ যখন লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে তখন তার মুখের ভেতর বিস্কুট ছিল বলে তিনি আরও জানান।
তিনি বলেন, এটা আত্মহত্যা নয়, পরিকল্পিত হত্যা। এ হত্যাকান্ডের সাথে তুলি বেগম জড়িত আছে কি না জানতে চাইলে তিনি স্পষ্টভাবে কিছু বলতে চাননি। তবে আগের সংসারের এ মেয়েকে নিয়ে খুব অশান্তির মধ্যে ছিলেন তুলি বেগম। কোন অপরাধ না করেই তার ওপর চলত নির্মম নির্যাতন।
লিপার খেলার সাথী ও সালাউদ্দিন গলির বাসিন্দা মো: সাইদুল ফারাজীর মেয়ে সুমাইয়া বলে, প্রতিনিয়ত তাকে মারধর করত মা। তার মা গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন। তিনি যখন বাসায় না থাকতেন তখন আমার সাথে খেলা করত লিপা। তুলি বেগমের ঘরের বারান্দায় কেউ পা রাখলেই তার সাথে শুরু হয়ে যায় বাকবিতন্ডা। দুপুর সাড়ে ১২ টার দিকে যখন লিপার মা ও সৎ বাবা ঝুলন্ত মরদেহ ঘরের আড়া থেকে নামান তখন সুমাইয়া সেখানে উপস্থিত ছিল। লিপার পা এমনভাবে ভাজ করা ছিল যে কেউ এভাবে কেউ আত্মহত্যা করে মরতে পারেনা বলে সে এ প্রতিবেদককে জানায়।
স্থানীয় বাসিন্দা শাকিল বলেন, মেয়েকে সাথে নিয়ে যেতে চেয়েছিল আগের বাবা রাসেল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণেই লিপাকে কাছে রেখে দেয় তুলি বেগম। রাশেদ লিপার সৎ বাবা। সোমবার দুপুরে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে লাশ ঝুলিয়ে রেখে বাইরে চলে যান তিনি। পরক্ষণে স্বামী ও স্ত্রী একই সঙ্গে বাড়ি ফিরে আসেন। ঘরে লিপার লাশ দেখে স্থানীয়রা পুলিশে খবর দেয়। মেয়ের মৃত্যুর কারণ জানতে চেয়ে পুলিশ তাদের দু’জনকে সাথে থানায় নিয়ে যায়। তাছাড়া উপস্থিত পুলিশ ও জনতার সামনে তুলি বেগম স্বীকার করেছেন গলার রশির গিট এভাবে তার মেয়ে দিতে পারেনা। তাছাড়া জনমুখে চাউর আছে যে, রাশেদের দ্বিতীয় সন্তান সকলের সামনে স্বীকার করেছে যে তার বাবা লিপাকে হত্যা করে ঘরের আড়ার সাথে ঝুলিয়ে রেখে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে।
এ ব্যাপারে খুলনা থানার এস আই টিপু সুলতান খুলনা গেজেটকে জানান, পুলিশ গিয়ে লিপার লাশ উদ্ধার করেছে। তাছাড়া সালাউদ্দিন গলির কয়েকজনের সাথে তুলি বেগম ও স্বামী রাশেদের সাথে বিরোধ আছে। তাদের রোষানল থেকে বাবা মাকে উদ্ধার করে থানা হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। ময়না তদন্তের রিপোর্ট হাতে এলেই পরিস্কার হবে এটা হত্যাকান্ড না আত্মহত্যা।
খুলনা গেজেট/ এসজেড