খুলনা, বাংলাদেশ | ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৩ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  অ্যান্টিগা টেস্ট: প্রথম দিনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ তুলল ২৫০, বাংলাদেশ পেল ৫ উইকেট
লকপুর গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠানের কাছে পাওনা

৩৮৮ কোটি টাকা ঋণ আদায়ে আমজাদ হোসেন ও তার স্ত্রী বিরুদ্ধে জনতা ব্যাংকের মামলা

বিশেষ প্রতিনিধি

খুলনার বহুল আলোচিত লকপুর গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৩৩৮ কোটি টাকা ঋণ খেলাপির জন্য অর্থ ঋণ আদালতে ৩০ নভেম্বর জনতা ব্যাংক, খুলনা মামলা দায়ের করেছে। মামলায় আসামি করা হয়েছে এস এম আমজাদ হোসেন ও তার স্ত্রী বেগম সুফিয়া আমজাদকে।

সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার এন্ড কমার্স ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এবং লকপুর গ্রুপের কর্ণধার এস এম আমজাদ হোসেনের বিরুদ্ধে গত বছর দুদক কয়েকটি মামলা করায় তিনি দেশ ত্যাগ করে আমেরিকায় অবস্থান করছেন বলে পারিবারিক সূত্র জানায়।

অর্থ ঋণ আদালত, খুলনায় দাখিল করা পৃথক এই তিনটি মামলা আদালত নথিভুক্ত করে এবং আসামিদের বিরুদ্ধে আদেশ দেবার জন্য আগামী জানুয়ারী ২০২৩ মাসে দিন ধার্য করেছে। জনতা ব্যাংক, খুলনা কর্পোরেট শাখার ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার এই তিনটি মামলার বাদি।

ইষ্টার্ন পলিমারের বিরুদ্ধে ১৫১ কোটি টাকার মামলা

লকপুর গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ইষ্টার্ণ পলিমার লি: মোংলা ইপিজেডে অবস্থিত এবং সম্পূর্ণ রপ্তানীমুখি প্রতিষ্ঠান। বিশেষ করে গার্মেন্টস ও হিমায়িত মৎস্য রপ্তানীকারকদের মোড়ক সামগ্রী সরবরাহ করত। উৎপাদিত মোড়ক সামগ্রীর কাঁচামাল আমদানী নির্ভর এ প্রতিষ্ঠান যা বন্ড সুবিধার প্রাপ্যতায় আমদানি হয়। প্রতিষ্ঠানটি জনতা ব্যাংকের সাথে ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে হিসাব খুলে বিদেশ হতে পন্য আমদানি করত। এই আমদানির জন্য এলসি মার্জিন ঋণ সহ বিভিন্ন প্রকার ঋণ মিলে ৩১ অক্টোবর ২০২২ পযর্ন্ত পাওনা মোট ১৫১ কোটি ৮৪ লাখ ৫ হাজার ৬১৬ টাকা। এই মামলায় আসামি করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানের এমডি হিসাবে এস এম আমজাদ হোসেন এবং পরিচালক হিসাবে তার স্ত্রী বেগম সুফিয়া আমজাদকে। মামলার আর্জিতে বলা হয়, ব্যাংক বিগত ০৫/০১/২০২২ এবং ০৭/০৪/২০২২ তারিখ বিভিন্ন প্রকার ঋণের টাকা পরিশোধের জন্য তাগাদাপত্র দেয়া হয়। কিন্তু আসামিগণ কোনরুপ ঋণ পরিশোধ না করায় ব্যাংক নিযুক্ত আইনজীবী ০১/০৮/২০২২ তারিখ লিগ্যাল নোটিশ প্রদান করেন। তারপর ঋণ আদায়ের জন্য তফশিল বর্ণিত সম্পত্তি ও ফ্যাক্টরি যেখানে যে অবস্থায় আছে তার নিলামের জন্য ২০ অক্টোবর নির্দিষ্ট করে একটি জাতীয় এবং একটি স্থানীয় পত্রিকায় নিলাম বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। কিন্তু আসামিদের অসহযোগিতার কারণে কোন বিডার নিলামে অংশগ্রহণ না করায় জমি-জমিসহ ফ্যাক্টরি বিক্রি করা সম্ভবপর হয়নি। ফলে ঋণের ১৫১ কোটি টাকা কোন ভাবেই আদায় করা যায়নি।

তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই ১৫১ কোটি টাকার ঋণের বিপরীতে রূপসার জাবুসা মৌজায় মোট নয় একর জলাভূমি বন্ধক দেখানো আছে। অথচ খুলনা সাব রেজিষ্টার দপ্তরে এই জলাভূমির দর দেখানো হয়েছে একর ৭৫ হাজার টাকা করে। এ ব্যাপারে জনতা ব্যাংক খুলনার জেনারেল ম্যানেজার অরুন প্রকাশ বিশ্বাস জানান, মোট ১৫১ কোটি টাকার মধ্যে বিভিন্ন প্রকার ঋণ রয়েছে, প্লেজ ঋণ, হাইপো, এলসি মার্জিনসহ বিভিন্ন প্রকারের ঋণ ও গ্যারন্টি রয়েছে। জমি বন্ধক ছাড়াও ফ্যাক্টরির যন্ত্রপাতি ও উৎপাদিত পন্য বন্ধক ছিল।

মুনষ্টার পলিমারের নামে ৯০ কোটি ৮১ লাখ টাকা

লকপুর গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান মুনষ্টার পলিমার এক্সপোর্ট লি: ২০১৭ সাল জনতা ব্যাংক দিলকুশা শাখা ঢাকা হতে প্রথম ঋণ গ্রহন করে। যা পরবর্তীতে খুলনা কর্পোরেট শাখায় স্থানান্তর করা হয়। মোংলা ইপিজেডে অবস্থিত সম্পূর্ণ রপ্তানীমুখি এই প্রতিষ্ঠানের কাছে ৩১ অক্টোবর ২০২২ পযর্ন্ত মোট পাওনা ৯০ কোটি ৮১ লাখ ৭৩ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। ব্যাংকের এই টাকা আদায়ের জন্য বিগত ৬ জুন ২০২২ তারিখ চূড়ান্ত তাগাদাপত্র এবং ০১/০৮/২০২২ তারিখে ব্যাংক আইনজীবী লিগ্যাল নোটিশ দেন। এই মামলায় মুন ষ্টার পলিমার এক্সপোর্ট লি: এমডি হিসাবে এস এম আমজাদ হোসেন এবং পরিচালক হিসাবে তার স্ত্রী বেগম সুফিয়া আমজাদকে আসামি করা হয়েছে । একই ভাবে এই ঋণের বিপরীতে মটগেজ রাখা জমিজমা নিলামে বিক্রির জন্য জাতীয় এবং স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। কিন্তু সে নিলামেও কেউ অংশগ্রহণ করেনি।

বাংলাদেশ পলি প্রিন্টিংয়ের ৯৫কোটি ৪৭ লাখ টাকা

লকপুর গ্রুপের অপর প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পলি প্রিন্টিং ইন্টারন্যাশনাল লি: শতভাগ রপ্তানীমুখি প্রতিষ্ঠান হিসেবে জনতা ব্যাংকের সাথে ২০১৪ সাল হতে হিসাব পরিচালনা করে আসছিল। প্রতিষ্ঠানটি বাগেরহাট জেলা ফকিরহাট থানার নওয়াপাড়া শ্যামবাগান এলাকায় অবস্থিত। এই মামলায়ও আসামি হিসাবে উল্লেখিত দুই জনের নাম রয়েছে। তবে এই তালিকায় তার আরো পাচঁটি প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। সে প্রতিষ্ঠানগুলি হলো বাগেরহাট সী ফুড, খুলনা প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং লি:, মেট্রো বিক্স লি:, রুপসা ফিস এন্ড এ্যালাইড ইন্ডা লি: ও সাউদার্ন ফুডস লি: এর এমডি হিসেবে এস এম আমজাদ হোসেন এবং পরিচালক হিসাবে বেগম সুফিয়া আমজাদকে আসামি করা হয়েছে ।

এই মামলায় মোট ৯৫ কোটি ৪৭ লক্ষ ২৯ হাজার ৭৫৩ টাকা পাওনা দেখানো হয়েছে। এজাহারে বলা হয়েছে, ব্যাংক আসামিদের বকেয়া ঋণ পরিশোধের জন্য তলব তাগাদার ধারাবাহিকতায় ৬ জুন ২০২২ তারিখে চূড়ান্তপত্র এবং পরবর্তীতে ব্যাংক আইনজীবী ০১/০৮/২০২২ তারিখে লিগ্যাল নোটিশ প্রদান করা হয়। তারপর ২০সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখ নিলামের দিন ধার্য করে দুটি পত্রিকায় নিলাম বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। কিন্তু বিবাদীগনের অসহযোগিতায় নিলামে কোন বিড়ার অংশগ্রহণ করেনি।

জমি বন্ধক মূল্য অস্বাভাবিক দেখিয়ে ঋণ ও তদন্ত কমিটি

খোজঁ নিয়ে জানা গেছে, ৩৩৮ কোটি টাকা বিভিন্ন ঋণের বিপরীতে তিনটি প্রতিষ্ঠান খুলনা রুপসায় ৮ দশমিক ১৪ একর, বটিয়াঘাটা থানার জিরোপয়েন্টে ৯ দশমিক ২৮ একর জলাভূমি এবং বাগেরহাটের ফকিরহাটে ৩ দশমিক ৩৩ একর জমি বন্ধক দেয়া হয়েছে। স্থানীয় ভূমি অফিস এবং সাব রেজিষ্টার অফিস সরকারী দর অনুযায়ী এই জমির মূল্য সর্বোচ্চ ৫০ কোটি টাকার অধিক হবে না। অর্থাৎ ৫০ কোটি টাকার সম্পত্তি বন্ধক দিয়ে প্রায় সাড়ে তিন শত কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রধান কার্যালয় হতে দেয়া ঋণ মঞ্জুরীর অতিরিক্ত টাকা এই প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয় বলে ইতিপূর্বে প্রধান কার্যালয়ের তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এই তদন্ত কমিটি গত ২৩/০৮/২০২১ তারিখে তৎকালিন ডিজিএম, জনতা ব্যাংক খুলনা কর্পোরেট শাখাকে ১১টি বিষয় অভিযুক্ত করে কারণ দর্শানো নোটিশ জারী করেন। জনতা ব্যাংক খুলনা কর্পোরেট শাখার ডিজিএম সহ তিনজন উর্দ্ধতন কর্মকর্তাকে মঞ্জুরীর অতিরিক্ত প্রায় ৫২ কোটি টাকা জামানত ছাড়াই অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ সুবিধা দেবার জন্য কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা্ নেয়া হবে না, তা জানতে শো-কজ এবং বিভাগীয় মামলা দায়ের করেছে। ব্যাংকের কেন্দ্রীয় ডিসিপ্লিনারী ডিপার্টমেন্ট এই একই ভাবে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে।

ব্যাংক কর্মকর্তাদের শো-কজ

জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: আব্দুস ছালাম আজাদের পক্ষে উপ-মহাব্যবস্থাপক একেএম ফজলুর রহমান স্বাক্ষরিত পত্রে জনতা ব্যাংক খুলনা কর্পোরেট শাখার ডিজিএম অরুন প্রকাশ বিশ্বাস, এজিএম কাজী জাফর হায়দার এবং সিনিয়র অফিসার মো: আব্দুল হাইকে জবাব দানের জন্য দশ দিনের সময় বেধে দেয়া হয়। মোট দশটি অভিযোগের প্রথমেই বলা হয়, প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন ব্যাতিরেকে মুনষ্টার পলিমারকে অতিরিক্ত ২৮ কোট ৩৭ লাখ ৪৫ হাজার টাকার ঋণ সুবিধা প্রদান করেছেন। একই ভাবে এই ঋণ প্রদানকালে প্রথম বছরে কমিশন অগ্রিম আদায়ের শর্ত পালন করা হয়নি। ৬ নং অভিযোগে বলা হয়েছে, ইষ্টার্ণ পলিমার লি:কে মঞ্জুরীকৃত ৬০ কোটি টাকার অতিরিক্ত ২১ কোটি ৫২ লাখ ওভারডিউ সুবিধা প্রদান করেছেন। একইভাবে ঋণ প্রদানের নানাবিধ শর্তাবলী মানা হয়নি । ৭ নং অভিযোগে বলা হয়েছে, ইষ্টার্ণ পলিমার লি: ঋণসীমার বিপরীতে প্রতিমাসে এক কোটি টাকার এফডিআর গঠন করে লিয়েন রাখার শর্ত পালন করা হয়নি এবং বিবিধ অনিয়ম করা হয়েছে।

পত্রে আরও বলা হয়েছে, জনতা ব্যাংক লি: চাকুরী প্রবিধানমালা -২০২০ এর ৬২ [খ] ১ উপপ্রবিধি মোতাবেক কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা্ নেয়া্ হবে না , তা পত্র প্রাপ্তির দশ দিনের মধ্যে জানাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অন্যথায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

জনতা ব্যাংকের জেনারেল ম্যানেজার যা বলেন

এ ব্যাপারে জনতা ব্যাংক খুলনা জোনের জেনারেল ম্যানেজার অরুন প্রকাশ বিশ্বাসের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, এই জমি ছাড়াও ফ্যাক্টরী যন্ত্রাংশ, উৎপাদিত পণ্যের প্লেজ ঋণ, এলসি মার্জিন ঋণসহ নানাবিধ ঋণ রয়েছে। যা সুদে আসলে এত টাকা হয়েছে। তিনি জানান, জমির মূল্য আগামীতে বৃদ্ধি পেতে পারে। তিনি জানান, এই ঋন তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। একই ভাবে এলসি মার্জিনের টাকা ১৮০ দিনের মধ্যে দেবার কথা থাকলেও তারা কোন টাকা দেয়নি। তিনি জানান, ব্যাংক ঋণের বিধি অনুযায়ী তারা এই মামলা দায়ের করেছেন। তিনি নিজে জনতা ব্যাংক কর্পোরেট শাখার ডিজিএম থাকাকালে তার বিরুদ্ধেও শোকজ করা হয়েছিল। কিন্তু তারা জবাব ব্যাংক কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেছে।

এ ব্যাপারে এম এম আমজাদ হোসেনের আমেরিকার মোবাইল নম্বরে কল করলে তিনি কল রিসিভ করেননি। ক্ষুদে বার্তা দিলেও তিনি কোন জবাব দেননি।




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!