যশোরের ভৈরব নদ দূষণের জন্য দায়ী একশ’ ছয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। এদের মধ্যে ৭৪ ব্যক্তি ও পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে নেই কোনো সেপটিক ট্যাংক। তাদের টয়লেটের বর্জ্য সরাসরি নদে ফেলা হচ্ছে। এছাড়া, দড়াটানা সংলগ্ন ১৩টি হাসপাতাল ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের অভ্যন্তরে সেপটিক ট্যাংক নেই। এসব প্রতিষ্ঠানের স্যুয়ারেজ লাইন সরাসরি নদের সাথে যুক্ত করা হয়েছে। এমনকি ওইসব প্রতিষ্ঠানের প্যাথলজিক্যাল বর্জ্যও নদে ফেলা হচ্ছে। এসবের বাইরে পৌরসভার ১৪টি ড্রেন দিয়ে ময়লা আবর্জনা এসে পড়ছে ভৈরব নদে। ইতিমধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ তাদেরকে চিহ্নিত ও তালিকা করেছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সময় বেধে দিয়ে নোটিশ প্রদান করা হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তালিকাভুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান দূষণ বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে।
যশোরবাসীর অভিযোগ, শহরের বুকচিরে বয়ে যাওয়া ভৈরব নদ দখল ও দূষণ চলছে দীর্ঘকাল ধরে। এ নিয়ে আন্দোলন করেছেন যশোরবাসী। এর ফলে গত তিন বছর আগে নদের পশ্চিম তীরের ৮৪টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছিল। কিন্তু পূর্ব প্রান্তের দেড় শতাধিক অবৈধ দখলদার এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন। আর পূর্ব-পশ্চিম উভয় পান্তে নদ দূষণকারীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তবে এবার ১০৬টি প্রতিষ্ঠানকে দূষণকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পরিবেশ অধিদপ্তর। এরমধ্যে পৌরসভার ড্রেনও রয়েছে। এদের কারণে নদের পানি দূষণ হচ্ছে ও দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকাভুক্ত দূষণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, শহরের ঘোপ নওয়াপাড়া রোডের একতা হসপিটাল, মডার্ন হসপিটাল, রেঁনেসা হসপিটাল, অসীম ডায়াগনস্টিক সেন্টার, স্ক্যান হাসপাতাল, স্ক্যান ও ইউনিক হাসপাতালের মাঝের ড্রেন, অর্থোপেডিক্স হাসপাতাল, পপুলার হাসপাতাল, লাবজোন, দেশ ক্লিনিক, কিংস হাসপাতাল এবং ওই এলাকার স্বপন সরকার ও মুনছুর আহম্মেদ। এসব হাসপাতালের অভ্যন্তরে সেপটিক ট্যাংক নেই। তাদের প্রতিষ্ঠানের সোয়ারেজ পাইপ লাইন সরাসরি নদে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এ কারণে বর্জ পড়ছে নদের পানিতে। একইসাথে হাসপাতালের বিভিন্ন বর্জ্য সরাসরি নদে ফেলা হচ্ছে।
এদিকে, কাঠেরপুলের রওশন আরা’র বাড়ি, গীরবশাহ মাজার সংলগ্ন পৌরসভার ড্রেন, রাজধানী হোটেল সংলগ্ন পৌরসভার ড্রেন, বাবলাতলা ব্রিজ সংলগ্ন পৌরসভার ড্রেন, যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে পৌরসভার ড্রেন, লোন অফিসপাড়ার হাবলু, গরুর খামার মালিক মমতাজ উদ্দীন পিন্টু, লোন অফিসপাড়ার পৌরসভার ড্রেন, চার নম্বর ওয়ার্ড লিচুতলা ব্রিজ সংলগ্ন পৌরসভার ড্রেন, লিচুতলা ব্রিজ সংলগ্ন জাহাঙ্গীর কাদের, একই এলাকার আসলাম ও মোহাম্মদ আলী, লিচুতলা এলাকার হাসানুর রহমান, নিচুতলা ব্রিজ সংলগ্ন নদীর বামপাশের বিস্কুট ফ্যাক্টরি, এখানকার পৌরসভার ড্রেন, নীলগঞ্জ সাহাপাড়ার সেলিম, একই এলাকার আনিছুর রহমান, নূর মোহাম্মদ সড়কের নাসিম, আনোয়ার হোসেন, বাবুল হোসেন, জাহাঙ্গীর মোল্লা, বুলু গাজী, হাবীব, পান্নু শেখ, ফজলে আলী বাবু, ইংসুল আলী, রাকিব হোসেন, দাউদ, স্থানীয় পৌরসভার ড্রেন, মহাসিন শেখ, বিকাশ বিশ্বাস, স্থানীয় পৌরসভার ড্রেন থেকে দুষিত পানি যাচ্ছে নদে।
এছাড়া, মোল্যাপাড়ার জামাল শেখের স্ত্রী রিনা, ফজলুর করিম টুটুল, এলাকা ভিত্তিক ড্রেন, মোল্যাপাড়ার মাসুম খন্দকার, শফিয়ার রহমান, নীলগঞ্জের সাহেব আলী, মাসুম বিশ্বাস, মফিজ ছলেমান, হাফিজুর রহমান, ছাত্তার, ঝুমঝুমপুর নদীরপাড় এলাকার হাসানুর রহমান, আজবাহার মোল্যা, রাশিদা বেগম, ডা. শরিফুল ইসলাম, রনি সর্দ্দার, নারগিছ সামাদ, ফরিদা বেগম, ফারুখ হোসেন ও স্থানীয় পৌরসভার ড্রেন, ঝুমঝুমপুর নদীরপাড়ের কাজী বুলবুল, বুদ্ধুমিয়া হাজী, পৌরসভার আরো একটি ড্রেন, নদেরপাড়ের শফি, আলী হোসেন, মাসুদ, পৌরসভার আরেকটি ড্রেন, স্থানীয় হেমায়েত শেখ, রপ্তম শেখ ও কাজী আবুল হোসেন নদ দূষণের তালিকায় রয়েছে। আর নদের পাড়ের শ্মশান রোডের মিজানুর রহমান, স্থানীয় পৌরসভার ড্রেন, ঝুমঝুমপুর বলিয়াডাঙ্গার রুহুল আমিন, মনিরুজ্জামান, আকরাম হোসেন, শাহাদত, সুবলের মাছ ফ্যাক্টরি, স্থানীয় লালন ভূঁইয়া, বদিউর রহমানের স্ত্রী ফরিদা, সাইফুল ইসলাম, মাসুদ রানা, কালাম মিয়া, আব্দুল কাদের, স্থানীয় মসজিদ, রাশিদা বেগম, ইকবালের গরুর খামার, মিলন হোসেন, সাইফুল ইসলাম, স্থানীয় একটি ড্রেন, মান্নান শেখ, পৌরসভার ড্রেন ও কৃষ্ণ বিশ্বাসের সুয়ারেজ পাইপ লাইন নদ দূষণ করে চলেছে।
অপরদিকে নীলগঞ্জ তাঁতীপাড়া এলাকার জাহাঙ্গীর খান, শহিদুল, আফিয়া বেগম, আসকার মুন্সি, সৈয়দ রাশেদুল, মুজিবর বেপারী, সোহেল, আমিরুল মোল্যা, শেখ আব্দুর রহিম দুষণের তালিকায় রয়েছে।
যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তাওহীদুল ইসলাম বলেন, জেলার মাসিক উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় রোববার ভৈরব নদ দূষণকারীদের তালিকা উপস্থাপন করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
এ ব্যাপারে যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান বলেন, ভৈরব নদ দূষণকারীদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে। তার আগে দূষণকারীদের নোটিশ প্রদানসহ অন্যান্য আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে ২৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৯২ কিলোমিটার ভৈরব নদ খনন করে যমোর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। শুরু হয় পাঁচ বছর মেয়াদি ‘ভৈরব রিভার বেসিন এলাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রকল্প’। শহর অংশের চার কিলোমিটার এলাকায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ছাড়া খনন কাজ করা সম্ভব ছিল না। ভৈরব নদের গর্ভে ও তার পাড়ে সরকারি জমিতে গড়ে তোলা ২৯৬ অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করে ২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি উচ্ছেদের চূড়ান্ত নোটিশ দেয়া হয়। নোটিশ পাওয়ার পরদিনই বেশ কয়েকজন নিজেদের বৈধ মালিক দাবি করে জেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত আবেদন করেন। পরে তারা উচ্ছেদ বন্ধে উচ্চ আদালতের দারস্থ হন।
সবশেষ ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ ৮৪টি স্থাপনা উচ্ছেদ করে। অবশিষ্ট দেড় শতাধিক স্থাপনা এখনো ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। গত তিন বছরে এ উচ্ছেদ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আর কোন পদক্ষেপ দেখা যায়নি যায়নি।