খুলনা, বাংলাদেশ | ৫ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২০ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  যাত্রাবাড়িতে ব্যাটারিচালিত অটো রিকশাচালকদের সড়ক অবরোধ, সংঘর্ষে দুই পুলিশ আহত
  জুলাই গণহত্যা : ৮ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এক মাসে তদন্ত শেষ করার নির্দেশ

মহামারী-দুর্যোগে দুর্ভোগে মুন্ডাদের জীবন-জীবিকা

মোহাম্মদ মিলন

কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশি শেখ সরদারপাড়া নিজ বাড়ির আঙিনায় বসে খাবার খাচ্ছিল নিরঞ্জন মুন্ডা (৫৮)। কেমন আছেন প্রশ্ন করতেই মুচকি হেসে জবাব দিলেন ভালো আছি। তিনি জানালেন, বাপ-দাদার ভিটা ও জমি রয়েছে ১০ শতক। এই জমিতে আলু, বেগুন, শাক-সবজি চাষ করেন। তিন ফসলী জমিতে বছরে ৩০-৩৫ হাজার টাকা আয় হয়। এছাড়া ৩৩ শতক জমি বর্গা নিয়ে ধান চাষ করা হয়। সবমিলিয়ে মুটামুটি ভালোই কাটছিলো। তবে করোনা পরিস্থিতিতে প্রায় ৩ মাস কোন কাজ করতে পারিনি। দীর্ঘদিন পর গেল সপ্তাহে ১০ শতক জমিতে উচ্ছে, আলু, শাক-সবজির বীজ রোপন করলেও এখনো পর্যন্ত গজায়নি। আর গজাবেও না। লবনপানির কারণে এ সমস্যা হয়েছে। কয়েকদিন আগে অন্য স্থানে যেয়ে দিনমজুরির কাজ করেছি। শুধু আমিই না, এখানকার অনেকেই কৃষি কাজ না করতে পেরে ইটভাটা, দিনমজুর, মাছ ধরাসহ নানা কাজের যোগ দিচ্ছে।

গত শনিবার (২৬ ডিসেম্বর) দুপুরে শেখ সরদারপাড়া, গাজীপাড়া, মাঝের আইট মুন্ডাপাড়া ঘুরে দেখা যায়, কর্মক্ষম সদস্যরা কাজে গেছেন। পাড়ার বেশিরভাগ নারী মাঠের কাজ না থাকায় ঘরে রয়েছেন। বাড়ির পুরুষরা কয়েক মাসের জন্য চুক্তিতে ইটভাটার কাজে গেছেন।

স্থানীয় ও আদিবাসীরা জানায়, খুলনার দক্ষিণে কয়রা উপজেলায় বহুবছর ধরে মুন্ডা ও মাহাতো সম্প্রদায়ের বসবাস। দেশে মুন্ডারা কখন কীভাবে বাংলাদেশে এসেছে, তার সঠিক বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে অনেকের ধারণা, মোগল ও ব্রিটিশ আমলে বন-জঙ্গল পরিস্কার করার জন্য মুন্ডাদের এদেশে নিয়ে আসেন স্থানীয় জমিদাররা। বংশ পরম্পরায় পরের জমিতে কাজ করা দিনমজুর পরিশ্রমী মানুষগুলো নানা কারণে সমাজের মূল ধারার বাইরে। কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশী শেখ সরদার পাড়া, বড়বাড়ি, বতুলবাজার, গাজীপাড়া, হরিহরপুর, দক্ষিণ বেদকাশির আংটিহারা, জোরশিং, বীনাপানি, সদরের মাঝের আইট, টেপাখালী, নলপাড়া গ্রামে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করেন।

কয়রা নৃতাত্ত্বিক আদিবাসী সমবায় সমিতির সভাপতি বলয় কৃষ্ণ সরদার বলেন, বর্তমানে কয়রা সদর, উত্তর বেদকাশি ও দক্ষিণ বেদকাশি এই তিনটি ইউনিয়নের ১২টির মতো গ্রামে মুন্ডা ও মাহাতোর ৩৭০ পরিবার বসবাস করছে। নদীর কোলঘেষে অনেকের বসবাস। নেই কোন কমিউনিটি সেন্টার, নানা সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। জীবন-জীবিকার তাগিদে যে কাজ পাচ্ছে করার চেষ্টা করছে। আর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি জমি কমে যাওয়ায় বর্তমানে কয়রায় মুন্ডাদের পেশাতেও পরিবর্তন আসছে। ইটভাটা শ্রমিকের কষ্টকর কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে তারা। করোনার সময়ে কিছু সহযোগিতা পাওয়া যায়। কিন্তু সেটি পর্যাপ্ত নয়। জমি থাকলেও লবনপানির জন্য কৃষি কাজ করা যাচ্ছে না। চরম দূর্ভোগে রয়েছে তারা।

উত্তর বেতকাশীর মাঝের আইট গ্রামের সুব্রত মুন্ডা জানান, আম্পানে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে। ভেড়িবাঁধ ভেঙে ঘর-বাড়ি তলিয়ে যায়। একই সাথে মাছ ও ফসলের জমিতে লবনপানি ঢুকে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সাদা মাছ মরে-পচে দূর্গন্ধে এক সপ্তাহ বিভিন্ন স্থানে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যায়। বর্তমানে এসব জমিতে কোন ফসল ফলানো বা মাছ চাষ করা সম্ভব নয়। অনেকেই নদীতে মাছ ধরা, মধু সংগ্রহ, ইটভাটার কাজ করছে। শুধু বাড়ির পুরুষরাই নয়, তাদের শিশু সন্তানরাও দারিদ্রতা থেকে রেহাই পেতে ইটভাটার কাজে যাচ্ছে। করোনায় অল্প-স্বল্প সহযোগিতা পেলেও তা পর্যাপ্ত ছিলো না। ২-৩ মাস মানুষ কর্মহীন হয়ে বেকার বসে ছিল। এখনো সেই পরিস্থিতি সামলেও উঠতে পারেনি।

এ বিষয়ে শেখ সরদার পাড়া এলাকার বাসিন্দা ও খুলনা বিএল কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সৌরভী মুন্ডা বলেন, আমাদের অধিকাংশরাই কৃষিকাজ নির্ভর। একদিকে করোনা পরিস্থিতি অন্যদিকে আম্পানে আমাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে। ভেড়িবাঁধ ভেঙে ফসলের জমিতে লবনপানি প্রবেশ করায় কৃষি জমি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। যে কারণে কোন ফসল হচ্ছে না। এর ফলে অনেকেই বেকার হয়ে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে জীবিকারও পরিবর্তন ঘটেছে। জীবন-জীবিকার তাগিতে অনেকে কৃষি কাজ বাদ দিয়ে ইট ভাটা, মাছ ধরা, দিনমজুরসহ নানা কাজে যোগদান করছেন।

খুলনার স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা ইনিশিয়েটিভ ফর রাইট ভিউ এর গবেষক মেরিনা যুথি বলেন, মুন্ডাদের প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে খাদ্য, জীবিকা, পানি ও শিক্ষার সুযোগ। তারা কৃষিভিত্তিক কাজে অভ্যস্ত। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাদের সে সুযোগ কমে আসছে। কর্মক্ষেত্রে সরকারিভাবে তাদের সুযোগের কথা বলা হলেও সেটি পাচ্ছে না। ইটভাড়া, মাছ ধরা এই কাজ করে দিন চলছে তাদের। সেটিও সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। আদিবাসীদের জন্য কোন বরাদ্দ আসলেও অনেক ক্ষেত্রে তাদের পর্যন্ত তা পৌছায় না। অতি দরিদ্র হওয়ায় তারা এসব বিষয়ে খোঁজ নেওয়ারও সুযোগ পায় না। করোনা আর আম্পানে তাদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সরকারি-বেসরকারিভাবে তাদের পাশে দাড়াতে হবে।

কয়রা উপজেলা নির্বাহী অফিসার অনিমেশ বিশ্বাষ বলেন, উপজেলার ৯টি গ্রামে মুন্ডা ও মাহাতো ৩৬০ পরিবারে ১ হাজার ৭৩০ জন রয়েছে। জয়বায়ূ পরিবর্তনের কারণে আদিবাসী মুন্ডা এবং মাহাতো সম্প্রদায়ের জীবিকার পরিবর্তন এসেছে। তাদের জীবন-জীবিকার জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ৬নং কয়রায় গুড়িয়াবাড়িতে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থার জন্য ওয়াটার প্লান্ট নির্মাণ করা হচ্ছে। একই সাথে পানির ট্যাংকি স্থাপন, গুরু বিতরণ, মাছ ধরার জন্য নৌকা, চালুসহ নানা সহযোগিতা প্রদান করা হয়েছে। তাদের শিশুদের লেখাপড়ার জন্য স্কুল করা হয়েছে। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাদের জীবিকারও পরিবর্তন ঘটছে। কৃষি জমি পানির নিচে চাষাবাদের জমি। যে কারণে অনেকেই ইটভাটার কাজ করছেন।

 

খুলনা গেজেট/এমএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!