চিত্তরঞ্জন দাস (৬৯)। ছিলেন মানুষ গড়ার কারিগর।ছিলেন সবার প্রিয় স্যার। তার আলোয় আলোকিত বহু শিক্ষার্থীর জীবন। এদের অনেকেই এখন বড় বড় চাকুরীজীবী। আবার কেউ ব্যবসায়ী, কেউ হয়েছেন শিক্ষক। সেই মানুষটিই আজ অসুস্থ, পড়ে আছেন বিছানায়। প্রিয় এ মানুষটি যশোর জেলার অভয়নগর উপজেলার রাজঘাট জাফরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন সহকারী শিক্ষক চিত্তরঞ্জন দাস।
বাঘুটিয়া ইউনিয়নের বিভাগদী গ্রামের এলাকায় ৬শতক কাচাঁ মাটির বাড়িতে পরিত্যক্ত ঘরে থাকছেন তিনি। এক সময়ের আলোচিত এই শিক্ষক এখন মানসিক ভারসাম্যহীন। ১৫ বছর ধরে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছেন। মৃতপথ যাত্রী হয়ে শুয়ে থাকেন সারা দিন-রাত। এভাবেই জীবন চলছে তার। একসময় যেখানে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়াতেন আজ সেটি তার আশ্রয়স্থল। নেই সংসার, নেই খাবারের ব্যবস্থা। স্ত্রী পরের বাড়িতে ভিক্ষা করে যা পান তাই খেয়ে বেঁচে আছেন এই মানুষ গড়ার কারিগর।
চিত্তরঞ্জন দাসের জরাজীর্ণ শরীর। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ তিনি। খেয়ে না খেয়ে থাকেন। ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না। কথা বলতে পারেন না।পুরো শরীরে ব্যথা। বার বার চেষ্টা করেও তার সঙ্গে কথা বলা যায়নি। বাক প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ে রয়েছেন। ১৫ বছর আগে তার ডায়বেটিস ধরা পড়ে। পায়ে ছোট একটি ক্ষত থাকার কারণে ঢাকা বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসা করা হয়। পরে চিকিৎসকের পরার্মশে পয়ের একটি অংশ কেটে ফেলা হয়েছে। ওই সময় তাঁর চিকিৎসা ব্যয়ে নওয়াপাড়া কৃষি ব্যাংক থেকে ৪৫হাজার টাকা লোন তোলা হয়। যা চিকিৎসার জন্য ব্যয় হয়ে যায়। পরে আর টাকা পয়সা না থাকায় চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যায়। দিনে দিনে তার শরীররে অবস্থা অবনতি হতে থাকে। এ থেকেই তিনি অসুস্থ হয়ে বাড়িতে পড়ে রয়েছেন।
চিত্তরঞ্জন দাসের স্ত্রী মিটু রানী দাস কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, আমার স্বামী একজন আদর্শবান শিক্ষক ছিলেন। স্কুলে চাকুরী করে কোন সম্পদ বানাতে পারেননি। আজ ১৫ বছর ধরে তিনি অসুস্থ। অর্থে জন্য চিকিৎসা করাতে পারেনি। নওয়াপাড়া কৃষি ব্যাংক থেকে ছোট একটা লোন তুলে িিচকিৎসা করেছিলাম। সুদসহ এখন ৩ লাখ ৫৫ হাজার টাকা হয়েছে। আমার দুই মেয়ে কোন রকম মানুষ করে তিন কাঠা জমি বন্ধক দিয়ে বিয়ে দিয়েছি। ভিটে বাড়িটুকু ছাড়া আর কোন সম্পদ নেই। ব্যাংক থেকে নোটিশ করা হয়েছে। আমার স্বামীর আজ মৃত পথযাত্রী। কথা বলতে পারে না। হাটা চলা করতে পারে না। সেলাইনের মাধ্যমে কোন খায়। তার পাশে সব সময় থাকতে হয়। ব্যাংকে যেয়ে যে কথা বলবো সে অবস্থা ও নেই। আমি নিরুপায় হয়ে পড়ে আছি। আমার তো দেখার কেউ নেই।
স্থানীয়রা জানান, ১৯৮৫/১৯৯৪ সালে চিত্তরঞ্জন দাস অভয়নগর উপজেলার বাঘুটিয়া মডেল স্কুল, আদিলপুর উচ্চ বিদ্যালয়, রাজঘাট জাফরপুর বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। বিদ্যালয়ে গনিত পড়াতেন তিনি। অল্প সময়ের মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগের ভালো শিক্ষক হিসেবে সবার প্রিয় হন রাজঘাট জাফরপুর বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। ওই সময় প্রতিষ্ঠানগুলো এমপিও ছিলো না । বেতনও পেতেন না। র্দীঘ ১২ বছর চাকুরী করেও কোন বেতন পাননি। বাড়িতে বাড়িতে প্রাইভেট পড়িয়ে সংসার চালিয়েছেন। তিনি সদালাপী সত্য প্রকাশের শিক্ষার্থীদের বোঝাতেন। ওই সময়ে বিজ্ঞানের স্যার পাওয়া দুরূহ ব্যাপার ছিল। যে কারণে তিনি সবার মাঝে প্রিয় ছিলেন। তিনি ইচ্ছা করলে অন্য পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করতে পারতেন । তা তিনি করেননি। শুধু এ অঞ্চলে শিক্ষা বিলিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু অর্থাভাবে সংসার তেমন চালাতে পারেননি। এরই মধ্যে তিনি অসুস্থ মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন চিত্তরঞ্জন দাস।
বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন বিদ্যালয়ে তিনি সবার আগে স্কুলে আসতেন। প্রত্যক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের খোজঁ খবর নিতেন চিত্তরঞ্জন দাস। অন্য শিক্ষকগন তার ব্যবহারে মুগ্ধ হন। তিনি একদিন স্কুলে না আসলে শিক্ষার্থীদের মন খারাপ থাকতো।
চিত্তরঞ্জন দাসের শিক্ষার্থী মনিরুজ্জামান বলেন, একসময় স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তাম। বিজ্ঞান বিভাগে অনেক ভালো পড়াতেন। স্যার যেখানে থাকছেন সেখানে আমাদের প্রাইভেট পড়াতেন। হঠাৎ স্যার অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিছুদিন পরই স্যারের জীবন ওলটপালট হয়ে যায়। এখন স্যারের অবস্থা দেখে কষ্ট লাগে। আমি সাধ্যমতো স্যারকে সহায়তার চেষ্টা করছি।
স্থানীয় বাসিন্দারা কয়েকজন জানান, দীর্ঘদিন ধরে বাঁধের পাশে পরিত্যক্ত ঘরে থাকেন শিক্ষক চিত্তরঞ্জন দাস । প্রায়ই রাস্তার ওপর বসে থাকেন। এখন তিনি বেশি অসুস্থ। তিনি সবার পরিচিত শিক্ষক। তার কাছে পড়াশোনা করে অনেকেই মানুষ হয়েছেন। অনেকে বড় চাকরি করেন, কেউ হয়েছেন শিক্ষক। অথচ চিত্তরঞ্জন দাস স্যারকে দেখার কেউ নেই। অসহায় দিন কাটছে তার। তিনি এখন মৃত শয্যায়।
ইউপি চেয়ারম্যান তৈয়বুর রহমান বলেন, চিত্তরঞ্জন দাস স্যার অসুস্থ। আমি তার ছাত্র। আমাকে নিজে হাতে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। অসুস্থ হওয়ার খবর পেয়ে তাকে অনেকবার দেখতে গেছি। তাকে অনেকবার সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। স্যার সততা নিয়ে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। স্যারের সম্পদ বলতে ভিটে বাড়ি টুকু ছাড়া কিছুই নেই।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মেজবাহ উদ্দিন বলেন, চিত্তরঞ্জন দাস এর ব্যাপারে আমার জানা ছিল না । আপনাদের মাধ্যমে বিষয়টি জেনেছি। বিষয়টি দেখতে স্থানীয় চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার চিকিৎসায় সহায়তা দেওয়া হবে।
খুলনা গেজেট/কেডি