খুশির জোয়ারে ভাসছিল সাগর ও লিমা দম্পত্তি। সন্তানকে নিয়ে তাদের ছিল নানা পরিকল্পনা। কিন্তু হঠাৎ সবকিছু শেষ হয়ে যায় তাদের। সন্তান হারানোর বেদনায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন লিমা খাতুন। তাকে সান্তনা দেওয়ার জন্য ছুটে আসছেন নিকটস্থ স্বজনরা। কিন্ত সান্তনা দেয়ার ভাষা তাদের কাছে নেই।
গত সোমবার রাতে প্রসব বেদনা ওঠে লিমা খাতুনের। কি করবেন তা বুঝে উঠতে পারেননি তিনি। শ্বাশুড়িকে সাথে নিয়ে মঙ্গলবার সকালে ভর্তি হন খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের লেবার ওয়ার্ডে।
পরিবারের অভিযোগ, সিজার করতে গিয়ে ডাক্তারের ধারালো অস্ত্রের আঘাত লাগে বাচ্চার পেটে। শনিবার (১৬ এপ্রিল) চিকিৎসাধীন অবস্থায় নবজাতকের মৃত্যু হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাসপাতালের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন মৃত শিশুটির পরিবার।
অনাগত শিশুর দাদী বকুল বেগম দু’সন্তানকে নিয়ে বটিয়াঘাটা উপজেলার দারোগার ভিটায় বসবাস করেন। সাগর গাজী তার ছোট ছেলে। তিন বছর আগে পারিবারিকভাবে লিমার সাথে সাগরের বিয়ে হয়। তিন বছর পরে গর্ভবতী হয় লিমা। ঔরসে বড় হতে থাকে তাদের অনাগত সন্তান।
পরিবারের সদস্যরা জানান, সোমবার রাতে প্রসব বেদনায় ছটফট করতে থাকে লিমা। এখানকার কোন ধাই মা পরিচিত না থাকায় সকালের জন্য অপেক্ষায় থাকে বকুল বেগম। সূর্য উঠার আগে লিমাকে নিয়ে রওনা হয় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশে। সেখানে গিয়ে লেবার ওয়ার্ডে ভর্তি করানো হয় তাকে। চিকিৎসকরা বকুল বেগমকে বলেন, চিন্তার কোন কারণ নেই, স্বাভাবিকভাবে তার বাচ্চা হবে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার এসে বলা হয় জরুরী ভিত্তিতে তাকে অপারেশন করাতে হবে। না হলে মা ও বাচ্চার মৃত্যু হবে।
তারা আরও জানান, তারপর তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় অপরেশনের ব্যবস্থাপত্র। মঙ্গলবার দুপুরের দিকে অপারেশন করা হয়। জন্ম নেয় একটি কন্যা সন্তান। এ সময়ে চিকিৎসকের ভুলের কারণে ধারালে অস্ত্রের আঘাত লাগে ওই নবজাতকের পেটে বলে তাদের অভিযোগ। এতে মারাত্মকভাবে জখম হয় শিশুটি । একপর্যায়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে নবজাতককে নিয়ে চিকিৎসকরা হাসপাতালের স্কানু বিভাগে ভর্তি করেন। সেখানে পাঁচদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর বাচ্চাটির মৃত্যু হয়।
বকুল বেগম আরও বলেন, চিকিৎসকের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে শিশুটির পেটের ডান পাশে ক্ষত হত। আঘাতে বাচ্চটির পেটের মলের নাড়িটি কেটে যায়। সেখানে গ্যাস সৃষ্টি হয়ে বাচ্চাটি মারা গেছে বলে তার দাবি। পরবর্তীতে চিকিৎসক ও হাসপাতালের লোকজন তাদের ভুল বোঝাতে থাকে। বলা হয় শিশুটি জন্মগতভাবে কিডনী রোগে আক্রান্ত হয়ে শিশুটি মারা গেছে। কিডনী রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে বাচ্চাটি পেটে ব্যান্ডেজ কেন? এমন প্রশ্নে এড়িয়ে যান সেখানকার কর্তব্যরত ডাক্তার। সাগর ও লিমা দম্পতির এটাই প্রথম সন্তান। সন্তানের মৃত্যুতে এ দম্পতি নির্বাক হয়ে পড়েছেন। কারও সাথে কথা বলছেন না তারা।
সন্তান হারানোর বেদনায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন লিমা খাতুন। রাতে যোগাযোগ করা হলে তিনি অঝরে কাঁদতে থাকেন। আমার মতো আর কোন মাকে যেন এভাবে সন্তান হারাতে না হয়। এ ঘটনার যেন পূনরাবৃত্তি না ঘটে সেজন্য তিনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নিকট অনুরোধ করেছেন। একইসাথে এ ঘটনার জন্য দায়ী ডাক্তারের বিচার দাবি করেছেন।
এদিকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসকের ভুলে নবজাতকের মৃত্যুর অভিযোগের প্রেক্ষিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। তদন্ত কমিটিকে আগামী ৭ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। রোববার হাসপাতালের পরিচালক ডা: রবিউল হাসানের নির্দেশে এ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা: মো: কাইয়ুম তালকুদারকে তদন্ত কমিটির প্রধান করে এ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলেন সার্জারি বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ডা: মুকুল এবং গাইনী বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা: নাসরিন কবির।
হাসপাতালের পরিচালক ডা: রবিউল হাসান বলেন, মৃত নবজাতকের বাবা মো: সাগর গাজীর অভিযোগের ভিত্তিতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
খুলনা গেজেট/ এস আই