দুধের শিশুকে কোলে নিয়েই ধরতে হয়েছে সংসারের হাল। মাটি কাটা, রাজমিস্ত্রীর কাজ, বাড়ি বাড়ি কাপড় বিক্রি কিংবা জুট মিলে কাজ করে চলেছে সংসার। ছেলের এক মাস বয়সেই পারিবারিক কলহের জেরে চলে যায় স্বামী। স্ত্রী-সন্তানকে ছেড়ে স্বামী চলে গেলেও হার মানেননি। শুরু হয় জীবন সংগ্রাম। একমাত্র সন্তানকে আঁকড়ে ধরে গেল ২৩ বছর জীবনযুদ্ধ চালিয়ে গেছেন খুলনার সালেহা বেগম। সালেহা বেগমের সংগ্রামী জীবনে শেষ সময়ে এসে ছেলে আনোয়ার হোসেনের সরকারি একটি অফিসে অস্থায়ী চাকরিতে কিছুটা স্বস্তি এসেছে।
এই প্রতিবেদকের কাছে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জীবন সংগ্রামের কথা বর্ণনা করেন সালেহা বেগম।
সংগ্রামী নারী সালেহা বেগম বলেন, ছেলের এক মাস বয়সেই স্বামী আমাদের ফেলে চলে যায়। ওই সময় দুধের শিশু নিয়ে কী করব সেই চিন্তায় দিশাহারা হয়ে পড়ি। তখন আমি নিজেও অসুস্থ। সন্তানকে তো মানুষ করতে হবে, সেই চিন্তা নিয়ে নেমে পড়ি কাজে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাপড় বিক্রি শুরু করি। ছেলে যখন হাঁটা শিখল তখন মানুষের কাছে রেখে আমি কাজে বের হয়েছি। মাটিকাটা, ইট-সিমেন্ট মাথায় নিয়ে বিল্ডিংয়ে ওঠাসহ নানা পরিশ্রমের কাজ করেছি। ২০০৯ সালে ক্রিসেন্ট জুট মিলে শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করি। এরপর মিল বন্ধ হলে রাজমিস্ত্রীর কাজ শুরু করি। এ কাজ করে আমি ছেলের লেখাপড়া করিয়েছি। এসএসসি ও এইচএসসি পাশ করিয়েছি। এখন সে অনার্সে পড়ছে। ছেলেকে মানুষ করার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। এখন ছেলে অনার্সে পড়ার পাশাপাশি কাজও করছে। ছেলে অস্থায়ীভাবে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাওয়ার পর আমি কাজ ছেড়ে দিয়েছি। ছেলের চাকরি স্থায়ী হলে আমি একটু স্বস্তি পেতাম। তা না হলে আমি অসহায়ই থেকে যাব। জীবনভর এই কষ্টই করতে হবে। মৃত্যুর আগে শান্তি করে যেতে পারব না।
জীবনের কষ্টের কথা তুলে ধরে সালেহা বেগম বলেন, সন্তান এবং আমার নিজের জীবন বাঁচাতে মানুষের বাসা বাড়িতেও কাজ করেছি। এ ছাড়া তিনতলা, চারতলা ও ছয়তলা বিল্ডিংয়ে ইট-সিমেন্ট মাথায় নিয়ে উঠেছি। বালু উঠিয়েছি। মিলে গিয়েও মেশিন চালিয়েছি, রাত জেগে কাজ করেছি। এভাবে ছেলেকে মানুষ করার জন্য আমি অনেক কষ্ট করেছি। ছেলেটা সবল হলে আমার মনের কষ্ট যায়। তাছাড়া আমার কষ্ট থেকেই যাবে। কষ্টের জীবন নিয়েই আমাকে চলে যেতে হবে। বাবা-মা নেই, স্বামী নেই, আত্মীয়-স্বজনও নেই। শুধু সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে কষ্ট করেছি।
তিনি আরও বলেন, একজন নারীর স্বামী না থাকলে কী ইতিহাস তৈরি হয় তা সবাই জানে। একা একটা সন্তানকে মানুষ করা, লেখাপড়া করানো খুবই কষ্টের। আমার জীবনে খাটতে খাটতে আর কিছুই নেই। এখন নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছি। আমি চাই আমার ছেলেটার স্থায়ী চাকরি হোক। যেন বাকি জীবনটা একটু শান্তিতে কাটাতে পারি। শান্তিতেই আমি মরতে চাই।
সালেহা বেগমের একমাত্র ছেলে আনোয়ার হোসেন লেখাপড়ার পাশাপাশি সরকারি অফিসে অস্থায়ী চাকরি ও রাতে ফাস্টফুডের ব্যবসা করছেন। খুলনার সরকারি হাজী মুহাম্মদ মুহসীন কলেজে হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে লেখাপড়া করছেন তিনি।
আনোয়ার হোসেন বলেন, ছোটবেলা থেকে আব্বুকে দেখিনি। আম্মুকে দেখেছি কাজ করেছেন, অনেক কষ্ট করেছেন। রাজমিস্ত্রির কাজ ও মিলে কাজ করেছেন। অনেক কষ্ট করে আমাকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। আমি অনার্সে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছি। পাশাপাশি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে অস্থায়ীভাবে চাকরি করছি। অবসর সময়ে একটি ফাস্টফুডের দোকান চালাচ্ছি। এই অস্থায়ী চাকরি ও ব্যবসার মাধ্যমে এখন আমাদের সংসার চলছে। লেখাপড়া শেষ করা এবং চাকরিটা যদি স্থায়ী করতে পারি তাহলে আমাদের পরিবার সচ্ছল হবে। আমার আম্মুর দুঃখ-কষ্ট দূর করতে পারব। আম্মু মাটি কেটে, মিলে কাজ করে কষ্টের সঙ্গে জীবন অতিবাহিত করেছেন। এজন্য আমি চাই আমার আম্মু শেষ বয়সে তার জীবনটা সুন্দরভাবে কাটিয়ে যাবেন।