ঢাকার আলী আমজাদ খানের বাসভবন খাজে দেওয়ান থেকে ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরের দিকে আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হন। নাজিরা বাজারে ১১ অক্টোবর পুলিশের সাথে গন্ডগোলের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পুলিশ তাকে ঢাকা জেলে পাঠিয়ে দেয়। পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর ৩ দফা জেলে যেতে হয়েছে তাকে।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগের যাত্রা শুরু হয়। প্রতিষ্ঠালগ্নে তিনি দলের কেন্দ্রীয় সিনিয়র যুগ্ম-সম্পাদক ছিলেন। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মুহাম্মদ শামসুল হক দায়িত্ব পালন করেন। দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক একই মামলার আসামি। ১৯৫০ সালের শেষ দিকে ঢাকার আদালতে মামলার শুনানী শেষে রায়ে সভাপতি মওলানা ভাসানী ও সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক খালাস পান। যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানসহ দুই জনের তিন মাসের কারাদন্ড হয়। তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে গোপালগঞ্জ জেলে, কিছুদিন পরে ফরিদপুর জেলে আবার গোপালগঞ্জ জেলে পাঠানো হয়। গোপালগঞ্জ তার জন্মস্থান। ইতিমধ্যেই সর্বস্তরের মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা এসেছে। নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে কর্তৃপক্ষ তাকে খুলনা জেলে পাঠিয়ে দেয়।
খুলনা জেলে এসে তিনি অবাক হলেন, ছোট্ট জেল। স্বল্প পরিসরের। সেই ব্রিটিশ আমলের সাব জেল। একটি মাত্র দালান, তার মধ্যে হাজতী ও কয়েদীর বসবাস একসঙ্গে। মাত্র একটি সেল, সেখানে ভয়ংকর প্রকৃতির সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের অবস্থান। জেলার তাঁকে ভেতরে নিয়ে গেলেন, দেখালেন প্রকৃত অবস্থা। অন্য কোন রাজনৈতিক বন্দীও এ জেলখানায় ছিল না। জেল কর্তৃপক্ষ কেমন করে এত স্বল্প পরিসরে জেলে পাঠালেন বিষয়টি বঙ্গবন্ধুকে ভাবিয়ে তোলে। এখানে ছয়টি সেল, সেলগুলোর সামনে চৌদ্দ ফিট দেওয়াল। এক দিকে ফাঁসির ঘর, অন্যদিকে বত্রিশটি পায়খানা। জেলের সকল বন্দী এখানেই পায়খানা করে। বাতাসে দুর্গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তো। আলাদা খাবারের কোন ব্যবস্থা তখন ছিলো না।
একটি সেলে বঙ্গবন্ধুকে রাখা হয়। জেলের হাসপাতাল থেকে পাঠানো ভাত ও তরকারি তাকে খেতে হতো। যে খাবার রোগীদের জন্য বরাদ্দ ছিল। টুঙ্গীপাড়া থেকে তাঁর জন্য চিড়ে, মুড়ি ও বিস্কুট পাঠানো হতো। এখানকার জেল জীবন তাকে অতিষ্ঠ করে তোলে। অন্য জেলে পাঠানোর জন্য তিনি জেল কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি করেন। তখনকার সিভিল সার্জনরা জেলের সুপারের দায়িত্ব পালন করতেন। সিভিল সার্জন মোঃ হোসেন জেল পরিদর্শনে এসে বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করেন। দু’জনের মধ্যে অনেকক্ষণ কথা হয়। সুপার তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনি কেন জেল খাটছেন? উত্তরে তিনি জানান, ক্ষমতা দখলের জন্য। সুপার অপর এক প্রশ্নে বললেন, ক্ষমতা দখল করে কি করবেন? বঙ্গবন্ধু উত্তর দিলেন, “যদি পারি দেশের জনগণের জন্য কিছু করবো।” ক্ষমতায় না যেয়ে জনগণের জন্য কিছু করা যায় না, এমন অভিমত দিলেন তিনি। জেল জীবনের সংকট সমস্যার কথা তিনি সুপারের কাছে তুলে ধরলেন। সুপার তাকে আশ্বাস দেন শীঘ্রই ব্যবস্থা করা হবে।
কিছুদিন পরে কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতা কমরেড বিষ্ণু চ্যাটার্জী ঢাকা জেল থেকে খুলনা জেলে আসেন। খুলনার আদালতে তার নামে একটি মামলা ছিল। তিনি দীর্ঘদিন কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। এই কমিউনিস্ট নেতা ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল তাঁর গ্রামের বাড়ির কাছেই স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের হাতে নিহত হন। কমরেড বিষ্ণু চ্যাটার্জী খুলনার রূপসা উপজেলার খানকা গ্রামের সন্তান। কারাবন্দী এই বাম নেতা বঙ্গবন্ধুকে জানালেন, সরকার তাঁর নামে ডাকাতি মামলা দিয়েছে, তাঁকে হয়রানি করার জন্য। তাঁকে কারাগারে ডিভিশন দেওয়া হয়নি। এ সময় কারাগারে বন্দী ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড রতন সেন ও ছাত্র ফেডারেশনের সরদার আনোয়ার হোসেন (ভাষা আন্দোলনে শহীদ, ১৯৫০ সাল, রাজশাহী জেল)।
খুলনা জেলে বঙ্গবন্ধুর তিন মাস সাজার মেয়াদ শেষ হয়েছে। নিরাপত্তা আইনের বন্দীরা ছয় মাস পর পর সরকারের কাছ থেকে একটা করে নতুন হুকুম পেত। তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেন, বোধ হয় আঠারো মাস হয়ে গেছে। ছয় মাসের ডিটেনশন অর্ডারের মেয়াদ শেষ হয়েছে। নতুন অর্ডার এসে পৌঁছায়নি খুলনা জেল কর্তৃপক্ষের কাছে। তিনি ভাবলেন জেল কর্তৃপক্ষ কোন হুকুমের ওপর ভিত্তি করে তাঁকে জেলে আটকে রাখবেন।
তিনি কর্তৃপক্ষকে জানান, অর্ডার যখন আসেনি, তখন আমাকে ছেড়ে দিন। আর যদি আটকে রাখেন তাহলে বেআইনিভাবে আটক রাখার জন্য আদালতে মামলা করবেন এমন হুমকিও দিলেন তিনি। জেল কর্তৃপক্ষ জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের সাথে আলাপ করলেন। জেলা ও পুলিশ প্রশাসন বিষয়টি সম্পর্কে জেল কর্তৃপক্ষকে জানালেন তাঁদের কাছেও কোন অর্ডার নেই যে তাঁকে জেলে বন্দী করে রাখা যাবে। তাঁর বিরুদ্ধে প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট ছিলো গোপালগঞ্জের মামলায়। খুলনা জেল কর্তৃপক্ষ পুলিশ পাহারায় তাঁকে গোপালগঞ্জে পাঠিয়ে দেন।
খুলনা গেজেট/এমএম