বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত খুলনার সুন্দরবন উপকূলীয় উপজেলা কয়রা। এ উপজেলায় গ্রামীণ দরিদ্র জনগণের কর্মসংস্থান ও খাদ্য সহায়তার জন্য গৃহিত কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) ও কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) কর্মসূচির আওতাধিন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে নির্দেশনা পালন করা হচ্ছে না। বিশেষ করে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার কর্মসূচীর মধ্যে বিভিন্ন মাঠ ভরাটের প্রকল্পের প্রায় অর্ধেক বরাদ্দ আত্মসাতের পাশাপাশি ব্যাপক অনিয়ম করা হচ্ছে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, খেলার মাঠসহ বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তুলতে মাটি দিয়ে মাঠ ভরাটের প্রকল্প নেয়া হলেও দেয়া হচ্ছে ভূগর্ভস্থ অবৈধবালু। ড্রেজারের মাধ্যমে অবাধে ভূগর্ভস্থ বালু উত্তোলন করায় একদিকে কৃষি জমি হুমকির মুখে পড়ছে, অন্যদিকে কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ায় প্রকল্পের সুফল বঞ্চিত হচ্ছে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্ররা। কর্মসংস্থানের অভাবে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ায় শিক্ষা বঞ্চিত হচ্ছে তাদের সন্তানরা।
বিগত তিন বছরের কাজ অনুসন্ধানে জানা যায়, একই স্থানে বারবার প্রকল্প দিয়ে ও নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ না করে বরাদ্দের অর্ধেকের বেশি আত্মসাৎ করা হচ্ছে। প্রকল্পে মাটি দেওয়ার কথা থাকলেও দেয়া হচ্ছে ভূপৃষ্ঠের তলদেশ থেকে অবৈধভাবে উত্তোলনকৃত বালু। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে না কর্মসংস্থান। নষ্ট হচ্ছে কৃষি জমি। বাড়ছে ভূমিধ্বসের শঙ্কা। নামমাত্র বালি দিয়ে ভুয়া মাস্টার রোলের মাধ্যমে কয়েকগুণ বেশি টাকা উত্তোলন করা হচ্ছে। শ্রমিক দিয়ে মাটি খননসহ অন্যান্য কাজ দেখিয়ে মাষ্টার রোল জমা দিলেও প্রকৃতপক্ষে মাঠ ভরাট করা হচ্ছে ড্রেজার মেশিন দিয়ে ও মাটির রাস্তার কাজ করা হচ্ছে স্কেভেটর মেশিনের মাধ্যমে।
সরেজমিনে ১৫টি প্রকল্পের কাজ পরিদর্শন করে জানা যায়, উপজেলার বাগালি ইউনিয়নের অর্জুনপুর কাটনিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিখা) প্রকল্পের আওতায় ৫ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়। ওই প্রতিষ্ঠানের মাঠ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ নিয়ে বালু দিয়ে ভরাট করা হয়। ওই সময়েও প্রায় অর্ধেক টাকা লুটপাট করা হয় বলে স্থানীয়রা জানান। এছাড়া সেখানে ভরাটকৃত জায়গায় পুনরায় মাঠ ভরাটের বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
পার্শ্ববর্তী অর্জুনপুর কাটনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠ ভরাটের জন্য ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কাবিখা থেকে ৫ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ দেয়া হয়। তবে (২৯ নভেম্বর পর্যন্ত) ওই দুটি প্রতিষ্ঠানে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রকল্পের কোন কাজ করা হয়নি। অথচ জুন মাসে উপজেলা খাদ্য গুদাম থেকে খাদ্যশস্য উত্তোলন করে বিক্রি করা হয়েছে।
প্রকল্প দুটির বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি স্থানীয় মহিলা ইউপি সদস্য হাসনা হেনা জানান, সমস্যা ছিল। দ্রুত কাজ শুরু করা হবে।
মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ কালিকাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠ মাটি দিয়ে ভরাটে ২০২২-২৩ অর্থবছরে কাবিখা প্রকল্পের ৬ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়। সেখানে যেয়ে দেখা যায়, মাটি দিয়ে ভরাটকৃত স্থানীয় ঈদগাহ সংলগ্ন ছোট একটি মাঠে নামমাত্র বালু দিয়ে সামান্য উঁচু করা হয়েছে।
ওই প্রতিষ্ঠানের সহকারি শিক্ষক জিএম আব্দুর রশিদের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ড্রেজার মেশিন দিয়ে দুই দিন বালু তোলা হয়। আর দুই দিন তিন চার জন শ্রমিক দিয়ে মাটির কাজ করা হয়। সব মিলিয়ে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়।
প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমিরুল ইসলাম বলেন, মাটি ভরাটে ২০ হাজার টাকা ও বালু ভরাটে এক লাখ টাকা ব্যয় হয়। বাকি টাকা ও বালু উত্তোলনের বিষয়ে সদ্বোত্তর মেলেনি।
মহারাজপুর ইউনিয়নের জয়পুর-শিমলার আইট দারুচ্ছুন্নাহ দাখিল মাদ্রাসার মাঠ ভরাটের জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরে কাবিটা প্রকল্পের আওতায় ২ লাখ ৯২ হাজার টাকা, একই অর্থবছরে টিআর থেকে ৫০ হাজার টাকা ও ইউনিয়ন পরিষদের উন্নয়ন সহায়তা ফান্ড থেকে মাদ্রাসা সংস্কার কাজে ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ইউনিয়ন পরিষদের উন্নয়ন সহায়তা ফান্ড থেকে আরও ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। একই অর্থবছরে কাবিটা প্রকল্প থেকে মাঠ ভরাট ও ভবন সংস্কারে ৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এর মধ্যে মাঠ ভরাটে দুই লাখ টাকা দেখানো হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন শিক্ষক জানান, পার্শ্ববর্তী কৃষি জমি থেকে মেশিনের মাধ্যমে বালু উত্তোলন করে মাঠ ভরাট ও সামান্য মাটি দিতে আনুমানিক আড়াই লাখ টাকা ব্যয় করা হয়। এছাড়া মাদ্রাসার কয়েকটি কক্ষ সংস্কার করা হয়েছে। সেখানে আনুমানিক দুই থেকে তিন লাখ টাকা ব্যয় হতে পারে। এত টাকা বরাদ্দের বিষয়ে তারা জানতেন না। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পরে তারা অবাক হয়েছেন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
আরও জানা যায়, ২০২৩ সালে মাঠ খেলার উপযুক্ত করতে স্থানীয় যুবক ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের দিয়ে মুড়ি-চানাচুরের বিনিময়ে বালুর উপরে কিছু মাটি দেয়া হয়। এছাড়া জনশ্রুতি রয়েছে ওই মাঠের জমি ও বালু দিয়ে ভরাটের খরচ দুইজন কর্মচারি নিয়োগের অনুদান থেকে প্রাপ্ত।
প্রতিষ্ঠানের সুপার মাওলানা মোঃ শফিকুল ইসলাম জানান, কাবিটা প্রকল্পের বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি তিনি ছিলেন এবং বরাদ্দের সব টাকার কাজ করা হয়েছে। খরচের বিস্তারিত বিষয়ে তথ্য ও উন্নয়নের ছবিসহ মাস্টার রোল পিআইও অফিসে জমা দেয়া রয়েছে।
তিনি আরও জানান, উন্নয়ন সহায়তা ফান্ডের কাজ তিনি করেননি, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের মেঝ ভাইয়ের তত্বাবধায়নে দুটি ভবনে বেশ কিছু সংস্কার কাজ হয়। ওই প্রকল্পের ব্যয়ের বিবরণী তার জানা নেই। তবে মাঠ ভরাট ও ভবন সংস্কারের কাজের পূর্বের ছবি দেখতে চাইলে তিনি যথাযথ দেখাতে ব্যর্থ হন। এছাড়া পিআইও অফিসের মাস্টার রোলের সাথেও ভরাটের পূর্বের মাঠের ছবি পাওয়া যায়নি। এছাড়া মাস্টার রোলে নাম দেয়া শ্রমিকদের কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায় তারা ওই প্রতিষ্ঠানে কোন কাজ করেননি।
শুধু এই তিনটি প্রতিষ্ঠান নয়, এ উপজেলার সাত ইউনিয়নে বিগত তিন অর্থ বছরে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিখা-খাদ্যশস্য/নগদ টাকা) কর্মসূচীর আওতাধিন প্রায় সকল স্কিমের কাজে অনিয়ম করা হয়েছে। প্রশাসনের সহায়তায় লাখ লাখ টাকা লুটপাট করা হয়েছে। বরাদ্দের অর্ধেক টাকা প্রশাসনের জোগসাজসে রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি ও পিআইসি কমিটির সদস্যরা আত্মসাৎ করেন বলে একাধিক অভিযোগ রয়েছে। আর যেটুকু কাজ হয়েছে তাতেও শ্রমিকদের ব্যবহার করা হয়নি। ফলে কর্মসূচির মূল লক্ষ্য ব্যাহত হচ্ছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দরিদ্র বিমোচনে ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টির মত সরকারের মহৎ উদ্যোগ ভেস্তে যাচ্ছে।
এদিকে ৭ম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলেকে একা বাড়ি রেখে স্বামী-স্ত্রী একত্রে ইটের ভাটায় কাজ করতে গিয়েছেন দেয়াড়া গ্রামের আঃ জব্বার। তারা বছরে ছয় মাস ভাটায় কাজ করেন। পরে বিভিন্নস্থানে শ্রমিকের কাজ করেন। তারা সন্তানের পড়াশুনা নিয়ে চিন্তিত। একই গ্রামের মজিবর, গোলাম বারিক, আবু সাঈদ, কালিকাপুর গ্রামের আবু হোসেন, হানিফসহ বেশ কয়েকজন জানান, শ্রমের মজুরি দিয়ে তাদের সংসার চলে। এলাকায় কাজ না থাকায় অন্যত্র যাওয়া লাগে। সন্তান একটু বড় হলে তাদের সাথে কাজ করতে নিয়ে যান। সন্তানদের পড়াশুনার খরচ মেটাতে তারা হিমশিম খায় বলে জানান তারা।
কয়রা সদর ইউনিয়নের বার বার নির্বাচিত সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান এইচ এম শাহাবুদ্দিন বলেন, কাবিটা-কাবিখা কর্মসূচির মাধ্যমে এলাকার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির কথা থাকলেও কয়রায় সেই নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। কয়রার অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র। জীবিকার তাগিদে তারা অন্যত্র চলে যাচ্ছে। বছরের প্রায় আট থেকে নয় মাস তারা বরিশাল, ঢাকা, গোপালগঞ্জ, খুলনা, বাগেরহাটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কাজ করতে যায়। তাদের সন্তানরা অভিভাবক শূন্য হয়ে পড়ে। আবার অনেকে সন্তানদের নিয়ে পরিবারসহ ইটের ভাটায় কাজ করতে যায়। তাদের সন্তানদের পড়াশুনা বন্ধের পাশাপাশি স্বাভাবিক বেড়ে ওঠায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, মাঠ ভরাটে মাটির ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে অনিয়ম কমবে, শ্রমিকদের কর্মসংস্থান বাড়বে। পাশাপাশি ভরাটকৃত মাঠ বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে কিংবা ধ্বসে নষ্ট হওয়ার শঙ্কাও কমবে। বিশেষ করে গাছ রোপণের মাধমে সবুজায়নও সহজ হবে। তিনি কাবিটা-কাবিখা কর্মসূচির মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ দুর্নীতি নির্মুলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টির আহবান জানান।
এ বিষয়ে কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুলী বিশ্বাস বলেন, এ ধরনের কোন বিষয় আমার জানা নেই। আমি এ বিষয়টি খতিয়ে দেখব।
খুলনা গেজেট/এনএম