খুলনা, বাংলাদেশ | ১৪ আশ্বিন, ১৪৩১ | ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  হাসিনা পুত্র জয়কে অপহরণ ও হত্যার ষড়যন্ত্রের মামলায় দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের জামিন নামঞ্জুর, কারাগারে প্রেরণ
  কুষ্টিয়ার খোকসায় সড়ক দুর্ঘটনায় তিন শিশু নিহত, আহত দুই
  দেশে ফিরেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস

উপকূলের মান‌বিক আ‌শিক

নিতিশ সানা, কয়রা

সুন্দরবন, যেখানে সূর্যোদয় হয় শুশুকের পিঠের মতো ভেসে আসা ছোট ছোট ডিঙি নৌকার ঘাটে ফেরার শব্দে। তারপর শুরু হয় প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সাথে লড়াই করে টিকে থাকা এক জনপদের জীবনকাব্য। কখনো আইলা, কখনো আম্পান, কিংবা বুলবুল, ফণী, সিডর, নার্গিস, মহাসেনের মতো ধেয়ে আসা অভিশাপে নদী ভাঙ্গনের ফলে স্বপ্নভঙ্গ হয় এই জনপদের। যেখানে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া বাপের শেষ ভিটেটুকুর দিকে তাকিয়ে কৃষকের সাথে আকাশও কাঁদে সেখানেই এক স্কুল শিক্ষকের ঘরে জন্ম এই গল্পের নায়কের।

শুরু হয় এ অঞ্চলের প্রতিটি ছেলেমেয়ের মতো ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যার সামনে দৃঢ়তার সাথে টিকে থাকার এক নতুন সংগ্রাম। জীবনের অনেক বাঁধা পেরিয়ে একসময় তার জীবনে আসে নতুন এক অধ্যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। সেখান থেকেই তার স্বপ্নের শুরু অভিশপ্ত এই জনপদকে নিয়ে কাজ করার।

বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায় নিজের টিউশনির টাকা দিয়ে শুরু করেন বাঘ বিধবাদের স্বনির্ভর করার চেষ্টা। প্রথমে তিনজন বাঘবিধবা (যাদের স্বামী বাঘের আক্রমণে জীবন হারিয়েছে) স্বনির্ভর করার জন্য কিনে দেন সেলাই মেশিন। বিষয়টা সোসাল মিডিয়া ফেসবুকে পোস্ট দিলে এগিয়ে আসে আরো কয়েকজন হৃদয়বান মানুষ। উৎসাহ বেড়ে যায় আশিকের তাদের সহযোগিতায় আর দশজন বাঘ বিধবাকে সেলাই মেশিন কিনে দিলেন। তারা এখন স্বাবলম্বীর পথে।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে চাকরী অথবা বিলাসী জীবনের পথে না ছুটে প্রতিষ্ঠা করলেন ইনিশিয়েটিভ ফর কোস্টাল ডেভেলপমেন্ট-আইসিডি নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। স্বপ্ন তার অবহেলিত উপকূলীয় এই জনপদের মানুষের জন্য কাজ করার। স্থানীয় কয়েকজন ছাত্র নিয়ে তৈরি করলেন স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। তারপর শুরু করলেন মানুষকে স্বনির্ভর করা আর স্বপ্ন দেখানোর কাজ।

২০১৮ সালে বাঘ বিধবাদের সাহায্যের জন্য তিনি একটি প্রকল্প জমা দেন এলজি ইলেকট্রনিক্সে। ব্যতিক্রমী কাজের জন্য এলজি ইলেকট্রনিক্স তাকে তাদের কর্মসূচি দূত মনোনীত করে এবং বাঘ বিধবাদের কল্যাণের জন্য চার লক্ষ টাকা প্রদান করে। সেই অর্থ দিয়ে ৩০ জন বাঘবিধবাকে মাসব্যাপি দর্জি কাজের প্রশিক্ষণ, সেলাই মেশিন ও প্রয়োজনীয় উপকরণ প্রদান করেন।

থেমে নেই আশিক। জন্মভূমি সুন্দরবন বিস্তৃত কয়রার মানুষদের আর্থ- সামাজিক উন্নয়নের জন্য সুন্দরবনকে ঘিরে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে গড়ে তোলেন ‘কেওড়াকাটা পর্যটনকেন্দ্র’ নামে সামাজিক আন্দোলন। পর্যটন কেন্দ্র তৈরি না হলেও সামাজিক এই আন্দোলন চলমান ও পর্যটকদের সুন্দরবন ঘুরে দেখার জন্য আইসিডি’র সৌজন্যে নৌকা অথবা ট্রলারে সুন্দরবন দর্শনের সুযোগ রয়েছে এখানে।

এছাড়াও বাংলাদেশের অন্যতম ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মুন্ডা সম্প্রদায়। যাদের এই অঞ্চলে আনা হয় সুন্দরবন কেটে জনবসতি তৈরীর জন্য। পিছিয়ে পড়া এই সম্প্রদায়ের জন্য আইসিডি’র মাধ্যমে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন বিরসা মুন্ডা প্রভাতী স্কুল।মুন্ডাশিশুদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য তার এই উদ্যোগ। আম্পানে স্কুলটি ভেঙে গেলেও আইসিডির অফিসে চলে তাদের শিক্ষাদান কার্যক্রম।

২০২০ সালে তিনি আবারও এলজি ইলেকট্রনিক্সের কর্মসূচি দূত মনোনীত হন। ৩০ জন অস্বচ্ছল মুন্ডা নারীকে প্রদান করেন নৌকা। যারা পূর্বে নৌকা ভাড়া করে সুন্দরবনে যেতেন মাছ ও কাঁকড়া শিকার করতে। তাদের আয়ের অন্যতম অংশ দিতে হতো নৌকার মালিককে।এখন আর এ সকল মুন্ডা নারীদের নৌকা ভাড়া দিতে হয় না।

করোনাকালীন সময় ও আম্পানের পরে এলাকার মানুষের জন্য নানা কাজ করেছে তার প্রতিষ্ঠিত সংগঠন আইসিডি। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় এলাকার প্রায় আট হাজার পরিবারকে খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও মানুষের সুপেয় পানির চাহিদা মেটাতে সাতটি নলকূপ স্থাপন ও আম্পানে বিধ্বস্ত দশটি পরিবারকে টেকসই ঘর নির্মাণ করে দিয়েছে আইসিডি।
তার উদ্যোগে মোট ৮০ জন অসচ্ছল নারীকে টেকসই কর্মসংস্থানের বিভিন্ন উপকরণ ও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। তাদের জীবনে এসেছে স্বনির্ভরতা।

তরুণ প্রজন্মকে তিনি এই কাজে স্বেচ্ছাসেবক করার মাধ্যমেই অনুপ্রেরণা যুগিয়ে যাচ্ছেন এই জনপদকে নিয়ে ভাবার, দেশকে নিয়ে ভাবার। তিনি তাঁর এই কার্যক্রমের স্বীকৃতিস্বরুপ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পেয়েছেন অ্যাওয়ার্ড । ভিএসও- প্রথম আলো স্বেচ্ছাসেবা সম্মাননা ২০২০, আরটিভি- মনিমিক্স প্রেরণা পদক ২০২০, সাউথ এশিয়ান ইয়ুথ লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড ২০১৯।

যখন দূরবর্তী অশনিসংকেত আসে, ঝড়ের তীব্র বেগে লাল পতাকা উড়তে থাকে, কাজ বেড়ে যায় আমাদের এই গল্পের নায়ক আশিকুজ্জামানের। যিনি মুন্ডা সম্প্রদায়ের বাচ্চাদের আলোর বাতি। উপকূলীয় উপজেলা খুলনার কয়রার প্রত্যন্ত এলাকা ৬ নং কয়রা গ্রামে তার জন্ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন তিনি। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে এসব কাজ করে যাচ্ছেন বলে খুলনা গেজেটকে বলেন তিনি।।

খুলনা গেজেট/ টি আই




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!