খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার মালতী গ্রাম। ১৯৭১ সালের ২০ মে এখানে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানি বাহিনী হানা দেয়। গুলি ও জবাই করে সেদিন প্রায় ১০ হাজার নারী-পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্থানীয় প্রশাসন বধ্যভূমির স্থান চিহ্নিত করে। দেশের মধ্যে যে কটি বধ্যভূমি রয়েছে তারমধ্যে ‘চুকনগর বধ্যভূমি’ অন্যতম। কিন্তু প্রায় সারা বছর অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
উপজেলার মালতী গ্রামের মো. ইসমাইল শেখ (৬৫) বলেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা চুকনগরে নিরীহ মানুষের রক্তে বধ্যভূমি লাল করেছে। অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। অথচ গণহত্যার সাক্ষী এ স্থান বলতে গেলে সারা বছরই পড়ে থাকে অবহেলায়। প্রশাসনের উচিত যত্ন নিয়ে বধ্যভূমিতে পূর্ণাঙ্গ কমপ্লেক্স নির্মাণ করা।’
খুলনা শহর থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার পশ্চিমে ডুমুরিয়া উপজেলার আটলিয়া ইউনিয়নের চুকনগরে গিয়ে সেখানে বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভ দেখা যায়। কিন্তু নামফলক বা সাইনবোর্ড চোখে পড়ে না। স্মৃতিস্তম্ভের বেদির পেছনের অংশে বড় একটি ফাটল রয়েছে। এক পাশের এক সারি ইট উঠে গেছে। সীমানাপ্রাচীরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনার একটি বড় অংশ সম্পূর্ণ ভাঙা। প্রাচীরের এক কোনায় পড়ে আছে বেশ কিছু ময়লা-আর্বজনা।
উপজেলা প্রশাসন ও চুকনগর গণহত্যা ১৯৭১ স্মৃতিরক্ষা পরিষদের উদ্যোগে এখানে গণহত্যার দিন ২০ মে, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসে ফুল দেওয়ার মতো ছোটখাটো অনুষ্ঠান হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৫ সালে বধ্যভূমির জন্য এখানে ৭৮ শতক জমি কেনেন সরকার। ২০০৬ সালে ৩২ শতকে তাঁদের পুণ্য স্মৃতিতে স্তম্ভ তৈরি করা হয়। এরপরে ২০২০ সালের ১৮ অক্টোবর নতুনভাবে বধ্যভূমির পূর্ণতা দেয়ার জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগে পত্রপ্রদান করেন খুলনা গণপূর্ত বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী।
১৯৭১, ২০ মে চুকনগরে হয়েছে ইতিহাসের, কোনো দেশে নিরীহ মানুষের ওপর বর্বরতম হত্যাযজ্ঞটি। পাকিস্তানিদের হাত থেকে জীবন ও সম্মান বাঁচাতে এবং যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর থেকে খুলনার আশপাশ ও বিভাগটির বিভিন্ন জেলা, উপজেলার অন্তত লাখখানেক মানুষ চুকনগর থেকে সাতক্ষীরা হয়ে ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তারা খুলনা শহর, বাগেরহাট, খুলনার বটিয়াঘাটা, দাকোপ, ডুমুরিয়া, ফুলতলাসহ বিভিন্ন উপজেলার। হাজার, হাজার মানুষ ভারতে আশ্রয় নিতে ঘর-বাড়ি ছেড়েছিলেন। তাদেরই একাংশ ১৯ মে রাতে চুকনগরে থেমেছিলেন। এমন সময় পাক বাহিনী ও রাজাকাররা নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে।
চুকনগর বধ্যভূমি সংরক্ষণ করছেন মো. ফজলুর রহমান মোড়ল। তিনি খুলনা গেজেটকে জানান, বধ্যভূমি পরিদর্শন করে শিগগিরই পূর্ণতা দেয়ার জন্য প্রকল্প প্রণয়ন করার কথা বলে গেছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব। বধ্যভূমিটি সংরক্ষণ করে আপনজন ও স্বদেশের অশেষ এই স্মৃতির প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধায়। তিনি বলেন, বিশ্বের বহু মানুষ এসে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই গণকবরের সাক্ষী হন। কিন্তু ওপরে ছাউনি না থাকায় নিচের দিকে বর্ষার পানি পড়ে স্যাঁতসেঁতে হয়ে পড়ে।
এ ব্যাপারে চুকনগর গণহত্যা ১৯৭১ স্মৃতিরক্ষা পরিষদ’র সভাপতি এবিএম শফিকুল ইসলাম বলেন, স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরও বধ্যভূমিতে স্মৃতিসৌধ ও পূর্ণাঙ্গ কমপ্লেক্স তৈরি করা হয়নি। তাঁর দুঃখ, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র’র ১৫ খণ্ডের কোথাও চুকনগরের ইতিহাস নেই। স্বীকৃতিই নেই এখনো। গণহত্যার শিকার ও শহীদদের সন্তানরা আশায়, আশায় আছি। তিনি বলেন, প্রতি ২০ মে নিজেরা যতটুকু পারি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই। সরকারি প্রতিশ্রুতি কখনোই পূরণ হয় না। কেবল স্মৃতিসৌধের মূল স্তম্ভটি হয়েছে।
ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আবদুল ওয়াদুদ খুলনা গেজেটকে বলেন, যতদ্রুত চুকনগর বধ্যভূমির পূর্ণতা দেওয়া যায়, সেজন্য জেলা প্রশাসক মহোদয়ের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার বিভাগ ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে চিঠি লেখা হবে। খুব শিগগিরি এজন্য আবেদন করা হবে।
খুলনা গেজেট / এআর / এমএম