খুলনা মহানগর বিএনপির বর্তমান কমিটি প্রায় ১১ বছর আগের। মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও এখনো পর্যন্ত গঠন করা সম্ভব হয়নি নতুন কমিটি। আর জেলা বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন হলেও তৃণমূলে নেই পূর্ণাঙ্গতা। বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগি সংগঠনের নগর ও জেলা কমিটি ছাড়া তৃণমূল প্রায় নেতৃত্বশূণ্য। বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, আন্দোলন-সংগ্রাম, নির্বাচন, কয়েকদফা সম্মেলনের প্রস্তুতি নিয়েও দলীয় কোন্দলসহ নানা কারণে শেষ পর্যন্ত নানা জটিলতায় কমিটি গঠন করা সম্ভব হয়নি। এমন অবস্থাতেও খুলনায় বিএনপি এবং অঙ্গ ও সহযোগি সংগঠন শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে বলে দাবি করেছেন দলের দায়িত্বশীল নেতারা।
নগর বিএনপি : ২০০৯ সালের ২৫ নভেম্বর খুলনার সার্কিট হাউস ময়দানে মহানগর বিএনপির সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছিল। ওই সম্মেলনে নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে সভাপতি এবং মনিরুজ্জামান মনিকে সাধারণ সম্পাদক এবং ফকরুল আলমকে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়। ২০১০ সালের ৮ ডিসেম্বর ১৭১ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। এছাড়া ১৩ সদস্য বিশিষ্ট উপদেষ্টা কমিটিও গঠন করা হয়।
দলীয় একাধিক সূত্র জানায়, কমিটির মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর প্রথম দফা সম্মেলনের তারিখ ছিল ২০১৬ সালের ৫ মার্চ। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের কারণে সম্মেলন বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৬ সালের ৩ ডিসেম্বর সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সম্মেলন নিয়ে দুই গ্রুপ মুখোমুখি অবস্থান নিলে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপে সম্মেলন স্থগিত হয়ে যায়। পরবর্তীতে আন্দোলন সংগ্রাম, নির্বাচনসহ নানা কারণে সম্মেলন আর হয়নি। ২০০৯ সালের গঠিত নগর কমিটি এখনো বহাল রয়েছে। প্রায় ১১ বছর পুরাতন এই কমিটির ১১ জন সদস্য মৃত্যুবরণ করেছেন। এছাড়া অনেকেই দল ত্যাগ ও বহিস্কার হয়েছেন। নিস্ক্রীয় রয়েছেন অনেকে। এদিকে নগর বিএনপির পাশাপাশি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে ৫ থানা, ৩১টি ওয়ার্ড ও তিনটি ইউনিয়নের কমিটিও। এ অবস্থায় সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠনের পক্ষে দলের তৃণমূলের নেতারা।
জেলা বিএনপি : ২০১৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি এসএম শফিকুল আলম মনাকে সভাপতি ও আমীর এজাজ খানকে সাধারণ সম্পাদক করে জেলা বিএনপির ২৯ সদস্য বিশিষ্ট আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল। একই বছরের ৬ ডিসেম্বর খুলনা জেলা বিএনপির ১৮১ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন দেয় কেন্দ্র। এছাড়া ৩৮ সদস্য বিশিষ্ট উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়েছে। জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে ৭টির আহ্বায়ক কমিটি রয়েছে। ২টি পৌরসভার আহ্বায়ক কমিটি রয়েছে। আর তেরখাদা ও রূপসায় ৫ সদস্য বিশিষ্ট আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও নগর সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু খুলনা গেজেটকে বলেন, ২০০৯ সালে নগর কমিটি গঠন করার পর কয়েক দফা সম্মেলনের উদ্যোগ নিয়েও করা সম্ভব হয়নি। ২০১৬ সালে নগরীর ৩১টি ওয়ার্ড ও তিনটি ইউনিয়ন গঠন করা হয়। তবে থানা কমিটি গঠন করা সম্ভব হয়নি। গত ১১ বছর খুলনায় বিএনপি আন্দোলনমুখী অবস্থানে ছিল। বিগত দু’টি নির্বাচন, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি কঠোরভাবে পালন করেছে।
তিনি আরো বলেন, খুলনার মাটিতে বিএনপি সবসময়ই শক্ত অবস্থানে ছিল, এখনো রয়েছে। বিভাগীয় সমাবেশ, আন্দোলন সংগ্রামসহ কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সকল কর্মসূচিতে নেতা-কর্মীরা স্বত:স্ফুর্তভাবে অংশ নিয়ে কর্মসূচি সফল করেছে। যে কারণে হামলা, মামলা, অত্যাচারের কারণে নেতাকর্মীদের ঘর-বাড়ি ছেড়ে বাহিরে বাহিরে অবস্থান করতে হয়েছে। তবুও তাদের মনোবল চাঙ্গা রয়েছে। দলকে নতুনভাবে সাঁজাতে হবে। সেই আলোকেই আন্দোলন সংগ্রামে যারা সাহসী ভূমিকা রেখেছে, জেল খেটেছে, নিপীড়িত হয়েছে সেইসব ত্যাগী, সাহসী ও তরুণদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হবে। তিনি বলেন, বর্তমানে করোনা মহামারীর কারণে সারাদেশে বিএনপির পূনর্গঠন প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে। এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে অচিরেই ভবিষ্যতের জন্য আন্দোলনমুখী একটি ঐক্যবদ্ধ কমিটি গঠন করা হবে-ইনশাল্লাহ।
জেলা বিএনপির সভাপতি এসএম শফিকুল আলম মনা বলেন, খুলনা একটি প্রাচীনতম জেলা। এখানে বিএনপির অবস্থান বরাবরই শক্তিশালী। ২০০১ সালের নির্বাচনে জেলার চারটি আসনের মধ্যে তিনটিই বিএনপি পেয়েছিলাম। মাঠ পর্যায়ের সাধারণ মানুষ বিএনপিকে মনেপ্রাণে চায়। বিএনপি এখন সাংগঠনিকভাবে যেকোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সংগঠিত ও শক্তিশালী। দলের হাইকমান্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সকল কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের চেয়ে বিএনপি এখন ঐক্যবদ্ধ। আগামীতে এই সরকারের পতন হবে। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠন হবে।
যুবদল : ২০১৭ সালের ২৭ এপ্রিল কেন্দ্র থেকে খুলনা মহানগর ও জেলা যুবদলের ৫ সদস্য বিশিষ্ট আংশিক পৃথক দু’টি কমিটি ঘোষণা করা হয়। এতে নগর কমিটিতে মাহাবুব হাসান পিয়ারু সভাপতি এবং নাজমুল হুদা চৌধূরী সাগর সাধারণ সম্পাদক করা হয়। পরবর্তীতে নগর যুবদলের ২২৫ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। অপরদিকে, জেলা যুবদলের এস এম শামিম কবীর সভাপতি এবং ইবাদুল হক রুবায়েত সাধারণ সম্পাদক করে ৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে ২০১ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়েছে।
নগর যুবদলের সভাপতি মাহাবুব হাসান পিয়ারু বলেন, নগর যুবদলের ২২৫ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি রয়েছে। কমিটি হওয়ার পর ৫ থানার দীর্ঘদিনের পুরাতন কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। ওয়ার্ড কমিটি গঠন করা হয়নি। তিনি বলেন, যুবদলের কেন্দ্র থেকে ৭ সদস্যের একটি বিভাগীয় সাংগঠনিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটি সম্প্রতি ৫ থানার যুবদলের নেতৃত্ব প্রত্যাশীদের ফরম বিতরণ এবং আবেদন জমা নিয়েছে। সবঠিক থাকলে আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৫ থানা কমিটি গঠন করা হবে।
জেলা যুবদলের সভাপতি মোঃ শামীম কবির বলেন, যুবদলের জেলার ১১ টি ইউনিট রয়েছে। এর মধ্যে ২০১৯ রূপসা, তেরখাদা ও দিঘলিয়া তিনটি ইউনিটের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। কেন্দ্রীয় কমিটি নির্দেশনায় বিভাগীয় কমিটির মধ্যস্ততায় সম্প্রতি খুলনায় ইউনিটগুলোর আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব পদে প্রার্থীদের আবেদন চেয়ে ফরম বিতরণ ও জমা নেয়া হয়েছে। করোনার কারণে একটু সমস্যা হচ্ছে। তবে দ্রুত সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি গঠনের চেষ্টা চলছে।
ছাত্রদল : ২০১৬ সালের ১৩ অক্টোবর দিবাগত রাতে কেন্দ্র থেকে মহানগর, জেলা, খুলনা মেডিকেল কলেজ ও খুলনা প্রকৌশল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এসময় খুলনা মহানগর ছাত্রদল কমিটিতে মোঃ শরীফুল ইসলাম বাবুকে সভাপতি ও মোঃ হেলাল আহম্মেদ সুমনকে সাধারণ সম্পাদক করে ৪০ সদস্যের আংশিক ঘোষণা করা হয়। এর ২ বছর পর ২০১৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ৩৯১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রদল।
অপরদিকে, ২০১৬ সালের ১৩ অক্টোবর কেন্দ্র ঘোষিত আংশিক কমিটিতে জেলা ছাত্রদলের মোঃ মান্নান মিস্ত্রীকে সভাপতি এবং গোলাম মোস্তফা তুহিনকে সাধারণ সম্পাদক করে করা হয়। এর দু’বছর পর ২০১৮ সালের ১০ জুন জেলা ছাত্রদলের ২৫৫ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় কমিটি।
নগর ছাত্রদলের সভাপতি মোঃ শরিফুল ইসলাম বাবু বলেন, কমিটি গঠনের পর দৌলতপুর থানা বাদে সদর, সোনাডাঙ্গা, খালিশপুর ও খানজাহান আলী থানা আহ্বায়ক কমিটি এবং বিএল কলেজ পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়। ওয়ার্ড কমিটি এখনো গঠন করা হয়নি। কেন্দ্রে কথা বলা হয়েছে, বিভাগীয় টিমের তত্বাবধায়নে নতুন করে কেন্দ্র থেকে ওয়ার্ড, থানা এবং কলেজ কমিটি পূনরায় গঠন করা হবে।
জেলা ছাত্রদলের সভাপতি মোঃ মান্নান মিস্ত্রী জানান, পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদনের পর থানা, পৌরসভা ও কলেজ ইউনিটের আংশিক কমিটি কর্মী সভার মাধ্যমে গঠন করা হয়। জেলা ছাত্রদলের ৯ টি থানার ১০টি ইউনিটে আহ্বায়ক কমিটি রয়েছে। এছাড়া ২টি পৌরসভা ও ১৯ টি কলেজে আংশিক কমিটি রয়েছে। আর দু’টি পৌরসভায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি রয়েছে। বিএনপির সকল কর্মসূচি ও সংগঠনের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি সফলে সবসময় সামনের কাতারে থেকেছে জেলা ছাত্রদল। কেন্দ্র সিদ্ধান্ত দিলেই ইউনিট কমিটিগুলোর পূর্ণাঙ্গ করা হবে।
স্বেচ্ছাসেবক দল : ২০১৮ সালে ৬ জুন খুলনা মহানগর ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের ৫ সদস্য বিশিষ্ট আংশিক কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্র। নগর কমিটিতে এস এম একরামুল হক হেলালকে সভাপতি এবং ফারুক হিলটনকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ১৭১ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়। অপরদিকে, জেলা কমিটিতে শেখ তৈয়বুর রহমানকে সভাপতি এবং আতাউর রহমান রুনুকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। পরবর্তীতে ১৭১ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়।
নগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এস এম একরামুল হক হেলাল বলেন, নগরের আংশিক কমিটি হওয়ার পর সকল থানা কমিটি ভেঙ্গে দেওয়া হয়। বর্তমানে থানা এবং ওয়ার্ড কমিটি নেই। আশা করছি সেপ্টেম্বরের মধ্যে কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা পাবো। নির্দেশনা পাওয়ার পর থানা কমিটিগুলো গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করা হবে।
জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শেখ তৈয়বুর রহমান বলেন, ৯টি থানা ও ২টি পৌরসভার আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া কয়েকটি ইউনিয়নেরও কমিটি করা হয়েছে। ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড কমিটি করার পর সম্মেলনের মাধ্যমে থানা কমিটি গঠন করা হবে।