খুলনা, বাংলাদেশ | ১০ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৫ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  অ্যান্টিগা টেস্ট: তৃতীয় দিন শেষে বাংলাদেশ ২৬৯/৯, পিছিয়ে ১৮১ রানে

সাতক্ষীরার নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নে টিআরএম বাস্তবায়নের মাধ্যমে নদীর নাব্যতা বজায় রাখার দাবি

নিজস্ব প্রতিবেদক, সাতক্ষীরা

সাতক্ষীরার বেতনা ও মরিচ্চাপ নদীর নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় বর্তমানে এই দু’টি নদীর তীরবর্তী এলাকায় প্রায় প্রতিবছরই ৬ থেকে ৮ মাস জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। নদীর নাব্যতা কমার কারণে নৌ-চলাচলও ব্যাহত হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাতে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। বসতি এলাকা প্লাবিত হয় এবং মাছের ঘেরগুলো ভেসে যাওয়ার পাশাপাশি বর্ষা মৌসুমে জনজীবন এক ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছায়।

এছাড়া জলাবদ্ধতার কারণে আমন মৌসুমে কোন ফসল ফলানো যাচ্ছে না, এমনকি শাক-সবজি চাষও প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এলাকাবাসীকে ব্যয়বহুল বোরো মৌসুমের একটি ফসলের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। পাশাপাশি পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে যা ইতিমধ্যে জনস্বাস্থ্যের ব্যাপক অবনতি ঘটিয়েছে। খাবার পানির সংকটও সীমাহীন অবস্থায় পৌঁছেছে। অন্যদিকে কর্মসংস্থানের অভাবে কাজের সন্ধানে এলাকার মানুষ স্থায়ী-অস্থায়ীভাবে এলাকা ত্যাগ (অভিবাসিত) করছে। যোগাযোগ ও খাদ্যাভাবে ছেলে মেয়েদের শিক্ষা জীবনও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। গো-চারণ ভূমি ও গো-খাদ্যের অভাবে সস্তায় তাদের পালিত পশুগুলো বিক্রী করে দিতে হচ্ছে। সেকারণে এখানে নারী নির্যাতন ও দারিদ্র্যের হারও বেশি।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জলাবদ্ধতা সমস্যাটি প্রায় চার দশকব্যাপী অব্যাহত আছে। সমস্যাটি সমাধান করার জন্যে সরকার বিভিন্ন সময়ে উদ্যোগ নিয়েছে, তবে তা বরাবরই পলি অপসারণ, বাঁধ নির্মাণ, স্লুইসগেট স্থাপন, খাল পুনঃখনন ইত্যাদিকে অগ্রাধিকার দিয়ে পরিকল্পনা প্রণীত হয়েছে। বারে বারে এসব কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেও আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যায়নি। উপরন্তু জলাবদ্ধতার বিস্তৃতি ঘটেছে।

সাতক্ষীরার জলাবদ্ধতা নিরসনে এবং বেতনা ও মরিচ্চাপ নদীর মৃত্যু ও জনদুর্ভোগ কমাতে সরকার ৩ বছর মেয়াদী ৪৭৫ কোটি ২৬ লক্ষ ১৪ হাজার টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। সাতক্ষীরা জেলার পোল্ডার নং ১, ২, ৬-৮, ৬-৮ (এক্সটেনশন)-এর নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন’ শীর্ষক সরকার গৃহীত এই প্রকল্পের কাজ ২০২০ সালের ১ জুলাই শুরু হয়েছে। যার মেয়াদ আগামী ৩০ জুন শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ঠ সংশয় রয়েছে।

এদিকে এই প্রকল্প জরিপে আইডব্লিউএম- দুটি নদীর অববাহিকায় টিআরএম বাস্তবায়নের প্রস্তাব রাখলেও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় টিআরএম প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে। তবে প্রকল্পটিতে সরকারের প্রত্যাশা কতটুকু অর্জিত হবে এবং নদীর ভবিষ্যত কি হবে তা নিয়ে ইতিমধ্যে নদী বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন। ভুক্তভোগী স্থানীয় জনগণও চাইছেন প্রকল্প বাস্তবায়নে জনমত গ্রহণ করা হোক। মূলতঃ টিআরএম প্রকল্প নদীর নাব্যতা রক্ষা এবং পলির বিকল্প অবক্ষেপনের জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল। সরকারের নেয়া সাতক্ষীরার নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সাতক্ষীরা সদর, কলারোয়া, দেবহাটা, আশাশুনি ও তালা উপজেলা এলাকার প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে মুক্ত হবে।

তবে স্থানীয় জনগণ মনে করে, সরকারের এসব কার্যক্রমে জলাবদ্ধতা তো নিরসন হচ্ছেই না বরং এই অঞ্চলের নদীগুলো যেমন ধ্বংস হয়েছে তেমনি প্রতি বছর নতুন নতুন এলাকায় জলাবদ্ধতার বিস্তার ঘটেছে এবং নতুন করে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অধিবাসী জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছে। বর্তমানে বেতনা, মরিচ্চাপ, সাপমারা ও লাবণ্যবতী নদীর পলি ভরাটে অপমৃত্যু হওয়ায় সাতক্ষীরা পৌরসভা, আশাশুনি, দেবহাটা, তালা ও কলারোয়া উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা জলাবদ্ধতায় আক্রান্ত হয়েছে। এ সমস্যা সমাধানে সরকার ও জনগণের দৃষ্টিভঙ্গীগত এই পার্থক্য দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসছে। যদিও সরকার নীতিগতভাবে জনগণের দাবি মেনে নিয়ে জোয়ার-ভাটার নদীগুলোর ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি ভিন্নতর পদ্ধতি (টিআরএম) গ্রহণ করেছে, তবুও দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, নানা অজুহাতে সরকার তা বাস্তবায়নে বিলম্ব করছে।

কেন্দ্রীয় পানি কমিটির সভাপতি এবিএম শফিকুল ইসলাম বলেন, সরকারের গৃহীত “সাতক্ষীরা জেলার পোল্ডার ১, ২, ৬-৮, ৬-৮ (এক্সটেনশন) নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন” শীর্ষক প্রকল্প এলাকার নিষ্কাশন ব্যবস্থা মূলতঃ বেতনা, মরিচ্চাপ, খোলপেটুয়া, সাপমারা ও দেশের সীমানা বিভাজিত নদী ইছামতিসহ অন্যান্য ছোট বড় অসংখ্য খালের উপর নির্ভরশীল। ইছামতির শাখা নদী কাকশিয়ালী, সাপমারা ও লাবণ্যবতী নদী। মরিচ্চাপ লাবণ্যবতী থেকে উৎপত্তি হয়ে বালিথার ত্রিমোহনা হয়ে আশাশুনি সদরে বেতনার সাথে মিলিত হয়ে খোলপেটুয়া নাম ধারণ করে প্রবাহিত হয়েছে। অন্যদিকে প্রায় ১৫০ কিমি. দীর্ঘ বেতনা নদীটি এখন পলি ভরাটে মৃতপ্রায়। আশাশুনি উপজেলার বুধহাটা বাজার থেকে চাপড়া মোহনা পর্যন্ত মাত্র ৬/৭ কিমি কোন রকমে টিকে আছে।

তিনি আরো বলেন, উজান হতে পর্যাপ্ত পানি প্রবাহ কমে যাওয়া ও সমুদ্র হতে আগত জোয়ার বাহিত উচ্চমাত্রায় পলির অবক্ষেপনে সাতক্ষীরা জেলার সাতক্ষীরা সদর, কলারোয়া, আশাশুনি ও তালা উপজেলাভূক্ত ১, ২, ৬-৮ ও ৬-৮ (সম্প্রসারণ) পোল্ডারের এবং পার্শ্ববর্তী নদীসমূহ জোয়ারবাহিত পলি ভরাটের কারণে মুমূর্ষু অবস্থায় মৃত্যুর প্রহর গুনছে। এ অবস্থায় ভাটার দিকে বেতনা ও মরিচ্চাপের মিলিত অংশ খোলপেটুয়া নদীরও অচিরে অকাল মৃত্যু ঘটার সকল আলামত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ নদীর মৃত্যু হলে উজানের বেতনা-মরিচ্চাপ অববাহিকাসহ সাতক্ষীরা শহরের জলাবদ্ধতা প্রলয়ঙ্করী আকার ধারণ করবে। যার প্রতিক্রিয়ায় মহাবিপর্যয় ঘটবে এবং গোটা এলাকাটি মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

নাগরিক নেতা আলিনুর খান বাবুল বলেন, বেতনা-মরিচ্চাপ নদী অববাহিকার এই জলাবদ্ধতা সমস্যা মোকাবেলায় সরকার বিগত এক দশক যাবত স্বল্প মেয়াদী বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে, পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদী শতবর্ষব্যাপী পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনাও গ্রহণ করেছে। বর্তমানে গৃহীত ‘সাতক্ষীরা জেলার পোল্ডার নং ১, ২, ৬-৮, ৬-৮ (সম্প্রসারণ)-এর নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন’ প্রকল্পটি পর্যালোচনার পূর্বে সরকারের বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলো এবং দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার বিষয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন।

তিনি আরো বলেন, বর্তমান সরকার গৃহীত ‘সাতক্ষীরা জেলার পোল্ডার নং ১, ২, ৬-৮, ৬-৮ (সম্প্রসারণ)-এর নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পটিও সরকারের শতবর্ষী পরিকল্পনা বাংলাদেশ ডেল্টা ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট বা বিডিপি-২১০০’র অংশ। সেখানে কেবলমাত্র নদী থেকে পলি অপসারণসহ অবকাঠামো ভিত্তিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন নয়, নদীর পাশে সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য, পরিবেশ বান্ধব, প্রযুক্তিগত ভাবে সমাধান যোগ্য এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক জোয়ারাধার পদ্ধতি (টিআরএম) বাস্তবায়নের মাধ্যমে নদীর নাব্যতা বজায় রাখার সুপারিশও করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, ২০৩০ সালের মধ্যে এ অঞ্চলের বেতনা, মরিচ্চাপ, কপোতাক্ষ, হরি-তেলিগাতী, ভদ্রা, ঘ্যাংরাইল ও হামকুড়া এই ৭টি নদীতে টিআরএম পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে নদীর নাব্যতা ও অববাহিকার উন্নয়ন করা হবে বলে পরিকল্পনায় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। যেহেতু বেতনা ও মরিচ্চাপ নদী দু’টি জোয়ার-ভাটার নদী। সে কারণে জোয়ার-ভাটার নদীর নাব্যতা রক্ষার জন্য টিআরএম অতীব গুরুত্বপূর্ণ। প্রকল্পে আইডব্লিউএম-এর সমীক্ষা ও সুপারিশকে চূড়ান্ত মুহূর্তে উপেক্ষা করা হয়েছে, যাতে প্রকল্পের সফলতা বিঘিœত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

নদী বিশেষজ্ঞদের মতে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে নির্মিত উপকূলীয় বাঁধ স্থায়ীভাবে নদী থেকে জোয়ার-ভাটার প্লাবন ভূমিকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ফলে জোয়ারবাহিত পলি জোয়ার-ভাটার প্লাবন ভূমিতে অবক্ষেপিত না হতে পেরে নদী বক্ষে বিশেষ করে নদীর মৃতঃ প্রান্ত সীমায় অবক্ষেপিত হচ্ছে যা একদিকে যেমন জোয়ার-ভাটার নদীর মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করেছে তেমনি সৃষ্টি করেছে জলাবদ্ধতা। নদীই এ অঞ্চলের জীবন। নদীর উপর বিশেষ করে জোয়ার-ভাটার ব্যবধানকে ব্যবহার করে এখানকার সভ্যতা গড়ে উঠেছে। তাই নদী না থাকলে এখানকার সভ্যতা টিকে থাকবে না। এমতাবস্থায় জলবায়ুর প্রভাব হ্রাস, উপকূলীয় এলাকার অনন্য প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যকে রক্ষা ও জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য পরিকল্পিতভাবে জোয়ার-ভাটার মাধ্যমে প্লাবনভূমিতে পলি অবক্ষেপনের ব্যবস্থা করার কোন বিকল্প নেই। যার মাধ্যমে নদীর নাব্যতা যেমন রক্ষা পাবে তেমনি ভূমি গঠন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। তাহলে জলাবদ্ধতা নিরসনের পাশাপাশি এ অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করা সম্ভব হবে।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!