দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার আইবুড়ো নদীর কোলঘেঁষে অবস্থিত মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের মথুরাপুর গ্রাম। ওই গ্রামে দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করে তাসফিয়া পারভীন। তার বাবা তৈয়বুর রহমানের জীবন-জীবিকা সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল, আর মা গৃহিনী।
সরকারের দেয়া ৯ শতক খাস জমিতে বাবা-মা এবং ৪ ভাই-বোন মিলে তাদের বসবাস। ভাই-বোনের মধ্যে তাসফিয়া সবার বড়। নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর পরিবারের চরম দারিদ্রতার কারণে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি তার। পরিবারকে সহযোগিতার জন্য সে নদীতে মাছ এবং কাঁকড়া ধরা শুরু করে। দৈনিক আয় করতো ৫০-১০০ টাকা। বাবা-মা তাকে বিয়ে দেয়ার জন্য চেষ্টা করতে থাকে কিন্তু তাসফিয়া কোনভাবেই বিয়ে করতে রাজি না।
এক পর্যায়ে তাসফিয়া জানতে পারে মথুরাপুর গ্রামে মাছ ও কাঁকড়া ধরার সাথে জড়িতদের নিয়ে লার্নিং সেন্টার শুরু হতে যাচ্ছে। ২০২১ সালে এডুকোর আর্থিক সহায়তায় উত্তরণ মুন্সিগঞ্জ ব্রিজ স্কুল তৈরি করলে সেখানে যুক্ত হয় তাসফিয়া। এরপর উত্তরণের সহায়তায় ৩ মাস মেয়াদী টেইলারিংয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। প্রশিক্ষণ শেষে এখান থেকে কাপড়সহ কিছু উপকরণ পাওয়াতে তার কাজের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। প্রশিক্ষণের দক্ষতা কাজে লাগানোর জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে তার মায়ের নামে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নেয়। সেই ঋণের টাকা থেকে ৭ হাজার টাকা দিয়ে একটি সেলাই মেশিন এবং ৪১ হাজার টাকা দিয়ে কাপড় ক্রয় করে বাড়িতে ব্যবসা শুরু করে। পাশাপাশি পড়ালেখাও চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে সে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে।
তাসফিয়া জানায়, সে লেখাপড়ার পাশাপাশি টেইলার্সের কাজ করে মাসে প্রায় ৩ হাজার টাকা আয় করছে। তার আত্মবিশ্বাস রয়েছে ভালভাবে কাজ শিখে সে সফল নারী দর্জি হয়ে নিজেই বড় টেইলার্সের মালিক হবে। একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার পাশাপাশি বাবা-মায়ের সংসারের কষ্ট দূর করবে এবং ছোট ভাই-বোনদেরকে লেখাপড়ায় সহযোগিতা করবে। যতদিন নিজে একটি দোকান করতে না পারবে ততদিন এভাবেই সে বাড়িতে কাজ করে যাবে।
উত্তরণের এডুকো প্রকল্পের প্রকল্প ব্যবস্থাপক নাজমা আক্তার বলেন, শ্যামনগর উপজেলায় মুন্সিগঞ্জ, বুড়িগোয়ালিনি, গাবুরা ও কাশিমাড়ী ইউনিয়নে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই ৪ টি ইউনিয়নের চারটি ব্রিজ স্কুলে ৩৫০ জন শ্রমজীবী শিশুকে শিক্ষাদান কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এই শিশুরা নিয়মিত ব্রিজ স্কুলে এসে লেখাপড়া করছে। এর মধ্যে ৫০ জন ইন্ডাষ্ট্রিয়াল সুইং মেশিন ও টেইলারিং এবং ৫০ জন ইলেকট্রনিকস ও মোবাইল সার্ভিসিংয়ে ও ২৫ জন ডিজেল ও পেট্রোল ইঞ্জিন মেকানিকের উপর তিন মাসের কারিগরি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অনেকের মতো তাসফিয়া পারভীন পড়াশুনার পাশাপাশি টেইলারিং এর কাজ করে নিজেকে সফল উদ্যোক্তা হবার স্বপ্ন দেখছে।
মথুরাপুর ব্রিজ স্কুলের সভাপতি মিসেস নূরজাহান খাতুন বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত ঝরে পড়া শিক্ষাবিমুখ শিশুদের কাছে এখন আদর্শ শিক্ষার বিদ্যাপীঠ হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছে স্কুলটি। আগে এখানকার শিশুরা স্কুলে যেতে পারতো না। এখন নিয়মিত স্কুলে পাশাপাশি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে অনেক শিক্ষার্থী স্বাবলম্বী হবার চেষ্টা করছে।
মুন্সীগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অসীম কুমার মৃধা বলেন, উত্তরণের এডুকো প্রকল্পের এই কার্যক্রম উপকূলীয় এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে। তাসফিয়ার মতো অনেকেই বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে তা কাজে লাগিয়ে কিছু উপার্জন করছে।
শ্যামনগর উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ সোহাগ আলম জানান, মূলত ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োজিত স্কুল বহির্ভূত শিশুদের শিক্ষার মূল স্রোতে আনার জন্যই এ ব্যবস্থা। এটি দুর্গম ও পিছিয়ে পড়া উপকূলীয় এলাকায় অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে ইলেকট্রনিকস ও মোবাইল সার্ভিসিং এবং সুইং মেশিন ও টেইলারিং প্রশিক্ষণ একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ বলে মনে করেন তিনি।
খুলনা গেজেট/এনএম