বাংলাদেশে সংস্কার ছাড়াই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে আরেকটি স্বৈরাচারী শাসনের উত্থান হতে পারে, তখন সামরিক হস্তক্ষেপ হলে সেটি হবে বড় বিপত্তি। জনসাধারণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়া অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে সংস্কার কাজ শেষ করতে বেশি সময় না লাগানোর চেষ্টা করতে হবে। এ ছাড়া জনগণকে সরকারের পাশে ধরে রাখতে দ্রুত কিছু ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে প্রশাসনে দুর্নীতি মোকাবিলা, বিদ্যুৎ সরবরাহের উন্নতি এবং উচ্চ দ্রব্যমূল্য কমানোর মতো বিষয়গুলো। শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়।
ক্রাইসিস গ্রুপের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, একটি আগাম নির্বাচন হলে সম্ভবত বিএনপি ক্ষমতায় আসবে; দলটির অতীতের শাসন বিবেচনায় তারা আওয়ামী লীগের চেয়ে সামান্য ভালো প্রমাণিত হবে বলে ধারণা করছেন অনেকে।
প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, যদি দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উল্লেখযোগ্য অবনতি হয়, তাহলে সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করতে পারে। এর মধ্য দিয়ে শুরু হতে পারে সামরিক শাসন। অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘দ্রুত সফল’ হওয়া লাগতে পারে, এমন বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে প্রশাসনে দুর্নীতি মোকাবিলা, বিদ্যুৎ সরবরাহের উন্নতি এবং উচ্চ দ্রব্যমূল্য কমানোর মতো পদক্ষেপগুলো।
‘বাংলাদেশে একটি নতুন যুগ? সংস্কারের প্রথম একশ দিন’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ব নেতাদের অন্তর্বর্তী সরকারকে তাদের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যগুলোর সমর্থনে কাজ করা উচিত এবং বাংলাদেশের রাজনীতিকে একটি নতুন যুগে নিয়ে যেতে সহায়তা করা উচিত।
ক্রাইসিস গ্রুপের মিয়ানমার ও বাংলাদেশবিষয়ক সিনিয়র কনসালটেন্ট থমাস কিন বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাপক জনসমর্থন পাচ্ছে এবং সেটা ধরে রাখার জন্য তাদেরকে দৈনিক শাসন ব্যবস্থার উন্নতি ঘটাতে হবে।
থমাস কিন বলেন, ‘যদি ইউনূস ও তার সরকার হোঁচট খায়, তাহলে দেশটির ক্ষমতায় কিছুটা পরিবর্তন নিয়ে নির্বাচিত সরকার আসতে পারে, এমনকি সামরিক শাসনের মেয়াদও শুরু হতে পারে।’
থমাস কিন আরও বলেন, যদি অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারে সফল হতে পারে, তাহলে বাংলাদেশিরা আগামী কয়েক দশকের জন্য উপকৃত হবেন। তিনি উল্লেখ করেন, অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেওয়ার ১০০ দিন পর দেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে অবস্থান করছে।
কিন বলেন, অন্তবর্তী সরকারের কাছে শাসন ব্যবস্থার উন্নতি এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সংস্কার কাজ করার সুযোগ রয়েছে, যা আবার স্বৈরাচারী শাসনের উত্থান রোধ করবে। তিনি বলেন, কাজের ক্ষেত্রটি বিশাল। বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারকে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অংশীদার, যেমন ছাত্র নেতা, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), ইসলামী দল, সামরিক বাহিনী ও সুশীল সমাজের সঙ্গে ঐকমত্য বজায় রাখতে হবে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার উদ্যোগে শক্তিশালী জনসমর্থন এবং ছাত্র নেতা ও সেনাবাহিনীসহ মূল অংশীদারদের সমর্থন রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে তার অগ্রাধিকার চিহ্নিত করেছে, সংস্কার প্রক্রিয়ার একটি রূপরেখা দিয়েছে এবং প্রাথমিক টাইমলাইন নির্ধারণ করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫ আগস্ট বাংলাদেশ থেকে শেখ হাসিনা চলে যাওয়ায় রাজনৈতিক সংস্কৃতি নবায়নের সুযোগ তৈরি হয়েছে, যা দেশকে তিক্ত বিভাজন ও সহিংসতার বাইরে রাখতে পারে।
ক্রাইসিস গ্রুপ জানায়, অন্তর্বর্তী সরকারকে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি সরকারের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের যাতে দৃঢ় সমর্থন থাকে তা নিশ্চিত করতে টেকসই ফলাফল প্রদান করতে হবে। অন্যথায়, বিকল্প কিছু ঘটলে তা বাংলাদেশ এবং এর অংশীদার সবার জন্যই অপ্রীতিকর হবে।
১০০ দিনে কী অর্জন হলো?
অভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের তিন মাস পর অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার এজেন্ডা এবং এক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যাগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের আরও এক বছর বা তার চেয়ে কিছু বেশি সময় লাগতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের কী করা উচিত?
উচ্চাভিলাষী সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত জনসমর্থন বজায় রাখতে দ্রুত ফলাফল তৈরি করা। এ সরকারকে যেন খুব বেশি সময় ক্ষমতায় থাকতে না হয়, সেই চেষ্টা করা উচিত এবং নতুন পদক্ষেপের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য গড়ে তোলা উচিত।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সহায়তা করা উচিত। এ ছাড়া বাংলাদেশের জনগণের কাছে ভাবমূর্তি উন্নয়নের জন্য ভারতের কাজ করা উচিত।
শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসন নিয়ে জনগণ ব্যাপক ক্ষুব্ধ হয়ে আছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্ষমতা ধরে রাখতে তার সরকার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে পুলিশ, বিচার বিভাগ ও আমলাতন্ত্রের স্বাধীনতাকে পরিকল্পিতভাবে ক্ষুণ্ণ করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার লক্ষ্যে পৌঁছাতে কতটা সফল হতে পারবে তা স্পষ্ট নয়, তবে বিকল্প উপায়গুলো হবে অপ্রীতিকর।
বিদেশি সরকার ও বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত অন্তর্বর্তী সরকারকে নিরাপত্তা, বিচারিক, নির্বাচনি ও অর্থনৈতিক সংস্কারে প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা। এ ছাড়া দেশের বাইরে চলে যাওয়া দুর্নীতি ও রাষ্ট্র-অনুমোদিত চুরির অর্থ পুনরুদ্ধারেও বিদেশি সরকারগুলো সাহায্য করা উচিত।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, হাসিনাকে ‘কঠোরভাবে সমর্থন’ দেওয়া ভারতের উচিত তাদের ভাবমূর্তির যে ক্ষতি হয়েছে, তা মেরামতে পদক্ষেপ নেওয়া।
ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রজন্মে একবার আসা বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের এই সুযোগটি যেন হারাতে না হয়, সেজন্য দেশ ও বিদেশের সমর্থন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
খুলনা গেজেট/এএজে