রসনা বিলাসী বাঙালির চিরায়ত লোকজ খাদ্য সংস্কৃতির সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে মিশে আছে পিঠা। শীতের পিঠা-পুলি বাঙালীর আদি খাদ্য সংস্কৃতির একটা বিশেষ অংশ। যার ধারাবাহিকতায় প্রতিবছর শীতকালে দেশজুড়ে পিঠা তৈরির উৎসব রীতিমত চোখে পড়ার মত। পিঠা নিয়ে ঘটা করে উৎসবও পালিত হয়। শীত আসতেই গ্রামীণ জনপদের প্রতি বাড়িতেই ধুম পড়ে যায় পিঠা তৈরীর। পার্বণপ্রিয় বাঙালির পিঠা তৈরীও যেন পার্বণেরই অংশ। আধুনিক সভ্যতার বেড়াজালে খেজুরের গাছ আজ বিলুপ্ত হতে চলেছে। তাই মিষ্টি রসের ভান্ডারও যেন ফুরিয়ে এসেছে সুন্দরবন উপকূলীয় পাইকগাছা থেকে। ঠিলে বা ভাঁড় প্রতি ১৫ টাকার রস তাই ঠেকেছে ১৫০ টাকায়। তবুও অতি কষ্টে শ্রমজীবি পরিবারেও চলছে রস সংগ্রহ করে পিঠার আয়োজন।
কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকালে গাছিরা ছুটছে রস সংগ্রহে, এরপর সন্ধ্যা নামতেই কোন না কোন বাড়িতে চলছে পিঠা তৈরীর আয়োজন। গাঁয়ের বধূরা চুলার পাশে বসে পিঠা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। শত কাজের ব্যস্ততায় সন্ধ্যায় চুলার পিঠে (পাশে) বসে পিঠা খাওয়ার লোভ সংবরণ করতে না পেরে ছেলে-বুড়ো সব বয়সীরাই গরম গরম ভাপা পিঠার স্বাদ নিতে চুলো (চুলা) ঘিরে বসে পড়ে গোল হয়ে। এরপর রাতে গরম রসে ডুবিয়ে রাখা হয় পিঠা। সকাল হতেই সেই আয়োজন চলে রসে ভেঁজা পিঠা খাওয়ার। এখনও গ্রামীণ জনপদে অতিথিদের বিশেষ করে মেয়ে-জামাইদের দাওয়াত (নিমন্ত্রণ) করে পিঠা খাওয়ানোর রেওয়াজ চালু আছে।
তবে দেশের একেক অঞ্চলে রয়েছে একেক রকম পিঠার জনপ্রিয়তা। দেশের উত্তরাঞ্চলে পিঠার যে ধরণ, তার থেকে আলাদা ধরনের মধ্যাঞ্চলের পিঠা। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পিঠা কিংবা পূর্বাঞ্চলের পিঠার মধ্যেও রয়েছে আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য। আবার একই পিঠা একেক এলাকায় একেক নামে পরিচিত। যেমন তেলের পিঠাকে উল্টর ও দক্ষিণ বঙ্গের অনেক এলাকায় বলে (পাকান পিঠা)।
বাংলাদেশে শতাধিক রকমের পিঠার প্রচলন থাকলেও সব অঞ্চলে মোটামুটি ২৫/৩০ ধরনের পিঠার প্রচলন রয়েছে। সেগুলো হলো ভাপা পিঠা, নকশি পিঠা, চিতই পিঠা, রস পিঠা, ইলশে পিঠা, ডিম চিতই, পাটিসাপটা, পাকান, মুঠি পিঠা, জামদানি পিঠা, হাঁড়ি পিঠা, চাপড়ি পিঠা, পাতা পিঠা, চাঁদ পাকান, সুন্দরী পাকান, পুলি, পানতোয়া, মালপোয়া, মেরা পিঠা, মালাই, কুশলি, ক্ষীরকুলি, গোলাপ ফুল, লবঙ্গ লতিকা, ঝালপোয়া, ঝুরি, ঝিনুক, সূর্যমুখী, নারকেলি, সিদ্ধপুলি, ভাজা পুলি ও দুধরাজ।
চালের গুঁড়া, নারকেল, খেজুরের গুড় দিয়ে বানানো হয় ভাপা পিঠা। গোল আকারের এ পিঠা পাতলা কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে ঢাকনা দেয়া হাঁড়ির ফুটন্ত পানিতে ভাপ দিয়ে তৈরি করা হয়। এ কারণেই এর নাম ভাপা পিঠা। গুড় গোলানো চালের আটা তেলে ছেড়ে দিয়ে যে পিঠা তৈরি করা হয়, তার নাম তেলের পিঠা। চালের গুঁড়া পানিতে গুলিয়ে মাটির হাঁড়িতে ভাজা হয় চিতই পিঠা। অতি সাধারণ এই পিঠা গুড় বা ঝাল শুঁটকি ভর্তা দিয়ে খেতে খুবই মজা। এই চিতই পিঠাকেই সারারাত দুধে বা গুড়ের রসে ভিজিয়ে তৈরি দুধ চিতই বা রসপিঠা। আরেকটি চমৎকার পিঠা হলো নকশি পিঠা। এই পিঠার গায়ে বিভিন্ন ধরনের নকশি আঁকা হয় বা ছাঁচে ফেলে পিঠাকে নানা রকম আদলে তৈরি করা হয় বলেই এই পিঠার নাম নকশি পিঠা। ছাঁচগুলো সাধারণত পাথর, কাঠ বা ধাতু দিয়ে তৈরি হয়। এসব ছাঁচের ভেতর দিকে নক্সা আঁকা থাকে। রস পাকান তৈরি হয় শুকনো সুজি, ডিম আর চিনি দিয়ে। সারাদেশেই পুলি পিঠা বেশ জনপ্রিয়। গুড় দিয়ে তৈরি হালকা বাদামি অথবা চিনির তৈরি সাদা রঙের পাটি সাপটা আরেকটি সুস্বাদু পিঠা। শীতকালে বিভিন্ন ধরনের পিঠার সঙ্গে পায়েশ ও ক্ষীরেরও রয়েছে অন্যরকম আবেদন।
গ্রামাঞ্চলের শীতের আয়োজনে ধনী-গরিবের ব্যবধান ভূলে নানান ধরণের পিঠাতে সাধ ও সাধ্যের মধ্যেই যেন রসনা বিলাস মিটানো হয় পিঠার আয়োজনে। গ্রামীণ বাঙালির পিঠা উৎসবের রসনা বিলাসী অস্তিত্ব হয়তো বা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। গ্রাম বাংলায় ধানের মৌসুম অনুযায়ী নানান পিঠা তৈরি হয়। পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন মিলে পিঠা খাওয়ার আনন্দকে কেন্দ্র করে গ্রামের দরিদ্র মজুরদের সঙ্গে নিয়ে ধান মাড়াই করে চালের আটা তৈরিতে মেতে উঠে বিভিন্ন পরিবার। পিঠা তৈরির নানান জাতের চালও শীত ঋতুতে গ্রামীণ বাজারেও কিনতে পাওয়া যায়। কোনো কোনো পরিবার অনেক আগেই পিঠা তৈরির প্রয়েজনীয় চালের গুড়াসহ অন্যান্য উপকরণ ঘরে মজুদ রাখে। খেজুর গুড় বা নারিকেলের যোগান এখন গ্রামেও ফ্রিজ ব্যবহার করে পিঠা তৈরির মজা উপভোগ করছে। তবে নিশ্চয় এ সকল পিঠার চালের গুড়া এখন মেশিনে ভাঙানো বা পাটায় পিষানো হয়ে থাকে।
গ্রামাঞ্চলে এক সময় ঢেঁকিতে নানান গান গাইতে গাইতে চাল থেকে গুড়া তৈরি করতো গ্রামীণ গৃহবধূরা। তবে কালের বিবর্তনে ঢেঁকির শব্দ এখন শুধুই স্মৃতি। তবুও পিঠা উৎসব যুগ যুগ ধরে টিকিয়ে রেখেছে। গ্রামাঞ্চলে শীতের পিঠা তৈরিকে যেমন উৎসব হিসেবে গণ্য করা হয় সে তুলনায় শহরে পিঠাপুলির ব্যবহার খুব কমই চোখে পড়ে । তবে সাম্প্রতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আয়োজিত শীতের পিঠা উৎসব শহুরে জীবনে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।
আর তাই রসনা বিলাসী বাঙালির আদি খাদ্য সংস্কৃতির অংশ হিসেবে পিঠা উৎসব সত্যিই নান্দনিকতার বহিঃপ্রকাশ। শীতের সকালে গ্রামীণ জনপদে পিঠার ঘ্রাণ আসলেই দেশীয় ইতিহাসের কালজয়ী সাক্ষী।
খুলনা গেজেট/ এস আই