গত এক মাসে রাজশাহী ও নাটোরে অন্তত ১৩টি ‘গুপ্ত হামলার’ ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন দু’জন। প্রায় প্রতিটি ঘটনায় হামলাকারীরা হেলমেট অথবা মুখোশ পরে মাইক্রোবাসে বা মোটরসাইকেলে এসে হামলা করে চলে যায়। আক্রান্তরা সবাই বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। একটি ঘটনায়ও হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এই ‘গুপ্ত হামলায়’ জড়িত কারা– সে প্রশ্নের জবাব মিলছে না।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, এসব ঘটনায় নাটোরের নলডাঙ্গা ও রাজশাহীর বাগমারাকেন্দ্রিক সর্বহারাদের একটি দলের সম্পৃক্ততা রয়েছে। তবে তাদের পেছনে কারা, তা পরিষ্কার নয়। ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে ঠিক এভাবেই আবির্ভাব ঘটেছিল ‘হাতুড়ি বাহিনীর’। এবারও সাধারণ নির্বাচনের আগে একই কায়দায় হামলা হচ্ছে। বিএনপি ও জামায়াতের অভিযোগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে চলমান আন্দোলন দমাতে ‘গুপ্ত হামলা’ করা হচ্ছে। স্থানীয়দের ধারণা, মুখোশধারীদের পেছনে শক্তিশালী কেউ রয়েছে, তাই শনাক্ত বা গ্রেপ্তার হচ্ছে না।
নাটোর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব রহিম নেওয়াজ বলেন, ‘সরকারের ইন্ধনে চোরাগোপ্তা হামলা হচ্ছে। তাই পুলিশ কাউকে ধরছে না।’ তিনি বলেন, ‘কার কাছে মামলা করব? মামলা করতে যাওয়ারও নিরাপত্তা নেই। পুলিশ মামলা নিতে চায় না।’
গত শুক্রবার সন্ধ্যায় নাটোর সদরে সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে মাওলানা সাইদুল ইসলাম নামে এক মাদ্রাসাশিক্ষককে পিটিয়ে জখম করে সড়কের ওপর ফেলে যায় মুখোশধারীরা। তিনি মাঝদীঘা নুরানি হাফেজি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এবং চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনের কর্মী বলে জানা গেছে।
সাইদুল ইসলাম জানান তিনি মাগরিবের পর মাদ্রাসায় কোরআন পাঠ করছিলেন। এ সময় পাঁচ-সাতজন তাঁকে মাদ্রাসা থেকে কলার ধরে টেনেহিঁচড়ে সাদা মাইক্রোবাসে তোলে। গাড়িতে পিটিয়ে বাঁ হাত ভেঙে দেয়। তিন কিলোমিটার দূরে চিকুরমোড় এলাকায় ফেলে দেয়।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেন বলেন, কী কারণে হামলা হয়েছে তা ধারণা করতে পারছেন না। এ বিষয়ে কিছুই জানেন না।
নাটোর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাছিম আহমেদ বলেন, ‘খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ যায় ঘটনাস্থলে। জড়িতদের শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনা হবে।’
এই ঘটনা ছাড়াও গত এক মাসে নাটোরের লালপুর, নলডাঙ্গা ও সিংড়া উপজেলায় বিএনপি-জামায়াতের চার নেতাকে মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা একইভাবে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে কুপিয়ে জখম করে ফেলে যায়। এ ছাড়া হেলমেট ও মুখোশ পরে মোটরসাইকেলে এসে অন্তত পাঁচজনের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। কুপিয়ে রগ কেটে দেওয়া, গুলি করা এবং হাত-পা ভেঙে সড়কে ফেলে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। আক্রান্ত ওই পাঁচজন পদে না থাকলেও বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এমন ১০টি হামলার ঘটনার ছয়টিই ঘটেছে নলডাঙ্গায়।
প্রথম ‘গুপ্ত হামলা’ হয় গত ১৬ অক্টোবর। সেদিন রাত ৮টার দিকে নলডাঙ্গা বাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে হেলমেট এবং মুখোশ পরা পাঁচ-ছয়জন স্থানীয় জামায়াত নেতা মাওলানা আবু নওশাদ নোমানী ও নাসির উদ্দিনকে রড দিয়ে বেধড়ক পেটায়। এতে দু’জনের হাত ভেঙে যায়।
গত ২৫ অক্টোবর নলডাঙ্গার পল্লিচিকিৎসক আলাউদ্দিন ফার্মেসি বন্ধ করে বাড়ি ফেরার পথে হেলমেটধারীদের আক্রমণের শিকার হন। পিটিয়ে তাঁর হাত ভেঙে দেওয়া হয়। এক দিন পর নলডাঙ্গা বাজার থেকে মাধবপুরের বাড়ি ফেরার পথে আক্রান্ত হন উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি ফজলুর রহমান। তিনি নলডাঙ্গা কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সাবেক ইমাম এবং অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক। তাঁকেও পাঁচ-ছয় মুখোশধারী চাপাতি ও রামদা দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপায়। তারা মৃত ভেবে তাঁকে ফেলে যায়। পরে স্থানীয়রা উদ্ধার করে তাঁকে রাজশাহী মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করে। অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে ঢাকায় পাঠানো হয়।
গত ৩০ অক্টোবর রাত ১০টার দিকে নলডাঙ্গা মহিষভাঙ্গা ইউনিয়ন জামায়াতের আমির মোশাররফ হোসেন হামলার শিকার হন। ‘স্থানীয় থানার ওসি খবর পাঠিয়েছেন’– এ কথা বলে একটি সাদা মাইক্রোবাসে আসা কয়েক মুখোশধারী তাঁকে বাড়ি থেকে নিয়ে যায়। গাড়িতে তুলে মাধনগর বিলের মধ্যে ফেলে রড, হকিস্টিক ও রামদা দিয়ে কুপিয়ে তাঁর দুই হাত ও দুই পা ভেঙে দেয়। সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত করে। এর পর মৃত ভেবে তাঁকে ফেলে যায়। পরে স্থানীয়রা তাঁকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করেন।
পার্শ্ববর্তী লালপুর উপজেলায় ৩ নভেম্বর রাতে যুবদল নেতা মাসুদ রানাকে বাড়ি ফেরার পথে জোর করে একটি সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নেয় কয়েক মুখোশধারী। তারা কুপিয়ে তাঁকে আহত করে। মাসুদ এখন রাজশাহী মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
স্থানীয়রা জানান, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে নাটোর জেলা জামায়াতের আমির বেলালউজ্জামানকে সিংড়ার শেরকোলের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে কুপিয়ে আহত করে সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনার কিছুদিন পর তিনি মারা যান।
জামায়াতের একটি সূত্র জানায়, রাজশাহী ও নাটোর ছাড়াও ভোলায় একটি ছুরিকাঘাতের ঘটনা রয়েছে। তবে সেখানে কোপানো হয়নি। এ ছাড়া জামায়াতের নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা সেক্রেটারি মো. ইয়াকুবকে গত ২৯ অক্টোবর ঢাকার মহাসমাবেশ থেকে বাড়ি ফেরার পথে পিটিয়ে হাত ভেঙে দেওয়া হয়।
একই দিন রাজশাহীতে জামায়াত কর্মী পল্লিচিকিৎসক এরশাদ আলী দুলালকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে খুন করে অজ্ঞাত হামলকারীরা। ওই রাতে সাবেক শিবির নেতা ও চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ গোলাম কাজেম আলী খুন হন একই কায়দায়। ৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় খুন হন রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও জামায়াত নেতা মাহবুবুর রহমান। এ ঘটনায় স্থানীয়রা এক ব্যক্তিকে ধরে পুলিশে দেয়। তবে হত্যার কারণ জানা যায়নি।
নাটোরের একাধিক সূত্র সমকালকে জানায়, আত্মসমর্পণের সুযোগ নিয়ে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (সর্বহারা) সাবেক সদস্যরা প্রকাশ্যে এসেছে। তাদের কেউ কেউ টাকার বিনিময়ে অপরাধ করছে। পুলিশ জেনেও কিছু করছে না। কারণ, স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী দুই আওয়ামী লীগ নেতার প্রশ্রয় পাচ্ছে তারা।
গত ২৯ অক্টোবর সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় স্থানীয় বিএনপির নেতা সাইফুল ইসলাম আফতাব গুলিবিদ্ধ হন। গত ১২ নভেম্বর রাত ৮টার দিকে নলডাঙ্গার বিপ্রবেলঘড়িয়া ইউনিয়নের ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি সজীব হোসেনকে বাড়ি থেকে সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নেয় মুখোশধারীরা। তাঁর হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। রাজশাহী মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সজীব জানান, মুখোশ পরে থাকায় হামলাকারীদের চিনতে পারেননি। এ ঘটনায় মামলাও হয়নি।
আক্রান্ত চারজনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সমকাল। তাদের কেউ নাম প্রকাশ করে কথা বলতে রাজি হননি। তবে তারা জানান, পুলিশ মামলা নিয়েছে দেরিতে। এখন হামলাকারীদের ধরতে তৎপরতা নেই। সজীবের বাবা ওয়াজেদ আলী বলেন, ‘ছেলে কাউকে চিনতে পারেনি। তাই থানায় মামলা করা হয়নি।’
নাটোরের পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘সাতটি মামলা হয়েছে। তদন্ত করে জড়িতদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে।’