শক্তিশালী গণতন্ত্র নিশ্চিতের মূল ভিত্তি ও চালিকাশক্তি হচ্ছে মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের শাসন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। এমন সব স্পর্শকাতর বিষয়গুলো মানা হচ্ছে না- এমন অজুহাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর, মূলত যারা পশ্চিমা ভাবধারার বাইরে স্বতন্ত্র অবস্থান নেয়, তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ অব্যাহত থাকে। তাদের জাতীয় স্বার্থের বাইরে অবস্থান করলেই এসব দেশের সরকারের ওপর আসে নিষেধাজ্ঞার খড়গ। তাতেও ক্ষান্ত হয় না ওয়াশিংটন। আনুগত্য অস্বীকারকারী দেশের সরকার উৎখাতে পরিকল্পিত সেনা অভ্যুত্থান ঘটানোর অভিযোগও রয়েছে বিশ্বের এই পরাশক্তির বিরুদ্ধে। অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি সামরিক অভিযান চালিয়ে গোটা দেশ ধ্বংস করে দেয়ার মতো সুস্পষ্ট প্রমাণও দেখেছে বিশ্ববাসী।
মার্কিন প্রভাব বলয়ের বাইরে অবস্থান করায় দশকের পর দশক নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়েছে ইরান, চীন, রাশিয়াসহ অনেক দেশ। সরাসরি সশস্ত্র হামলার শিকার হয়েছে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বহু দেশ।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এমন সব বিতর্কিত দ্বৈতনীতি ফের সমালোচিত হচ্ছে। এবার তাদের মূল ভূখণ্ডে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মতপ্রকাশের অধিকারের ওপর ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম দমন-পীড়ন চালাচ্ছে ফেডারেল পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ফিলিস্তিনে নিপীড়ন বন্ধ, ইসরায়েলকে একতরফা অন্ধভাবে সমর্থন-পোষণ বন্ধের দাবিতে বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে সপ্তম স্থানে থাকা নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস গেল সপ্তাহে উত্তাল হয়ে ওঠে। মুখোশধারী ইহুদিপন্থী ও বিক্ষোভবিরোধী আরেকটি পক্ষ খোদ পুলিশের সামনে নির্বিচারে হামলা চালায় ফিলিস্তিনে যুদ্ধবন্ধের দাবিতে সক্রিয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর। তাদের আন্দোলন গুঁড়িয়ে দিতে বেপরোয়া অভিযান চালায় পুলিশ। বাদ যাননি দুই অধ্যাপকও। শিক্ষার্থীদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়ানোয় তাদের প্রকাশ্য দিবালোকে মাটিতে ফেলে হাতকড়া পড়ায় পুলিশ। পাঠিয়ে দেয়া হয় কারাগারে।
এই ঘটনার প্রায় ৭ মাস আগে থেকে তেল আবিবের পক্ষ নিয়ে গাজায় চালানো ইসরায়েলি সশস্ত্র হামলায় একতরফা সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে ওয়াশিংটন। গাজায় হামলায় নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা ইতোমধ্যে ছাড়িয়ে গেছে ৩৪ হাজার। সেই হামলার জেরে এবার মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্দোলন থামানোর নামে ফেডারেল পুলিশের বর্বরোচিত হামলার পর আবার যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈতনীতি ও বিমাতাসূলভ আচরণ বিশ্বব্যাপী সমালোচিত হয়েছে।
নিজেদের এমন নাজুক অবস্থানের মধ্যেই প্রতিবছরের মতো এবারও ২৪ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র নিজ দেশকে বাদ দিয়ে অন্য দেশ নিয়ে ‘বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদন’ প্রকাশ করেছে। এমন প্রতিবেদনে শুধু মানবাধিকারের বিষয় নয়, ‘গণতন্ত্র’, ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’র মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলোকে কায়দা করে ব্যবহার করা হয় ভিন্নমতের দেশগুলোকে ঘায়েল করতে। যেসব দেশের অবস্থা এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়, সেসব দেশের কোনোটিই যুক্তরাষ্ট্রের মাপকাঠিতে পাস নম্বর পায় না। এসব দেশে মানবাধিকার ও মতপ্রকাশ চরমভাবে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে বলেও তোপধ্বনি তোলে পশ্চিমারা। সেসব দেশের বিরোধীদলের মতকে দেয়া হয় সর্বোচ্চ প্রাধান্য, যা ফেডারেল সরকার কখনো নিজ দেশে চর্চা করে না।
যেসব দেশের সরকারের কার্যকলাপ তাদের অপছন্দ হয়, সেই দেশের সরকারকে উৎখাত, সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করতেও পিছুপা হয় না মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। দেশে দেশে তাদের অর্থায়নে তাঁবেদার সংগঠন লালন-পালন করে, যারা চাহিবামাত্র নিজ দেশের যত রকমের অসত্য, অর্ধসত্য বা বানোয়াট তথ্য দিয়ে তাদের নিয়মিত সহায়তা করে- এমন কথাই উঠে এসেছে বিশ্লেষক ও গবেষক আবদুল মান্নানের সম্প্রতি প্রকাশিত এক নিবন্ধে।
যে যুক্তরাষ্ট্র গোটা বিশ্বে ‘মানবাধিকার’, ‘গণতন্ত্র’ আর ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতার’ কথা বলে মাতব্বরি করে, সেই যুক্তরাষ্ট্রের বিবেক দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই মুহূর্তে কী ঘটছে এক ঝলক দেখে নেয়া যাক। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের মাটি জোরপূর্বক দখল করে ইউরোপ থেকে নিয়ে আসা ইহুদিবাদীদের জন্য ইসরায়েল নামক একটি বিতর্কিত রাষ্ট্র সৃষ্টি করার পর গোটা মধ্যপ্রাচ্যে বিরামহীনভাবে গণহত্যা আর তার আদি বাসিন্দাদের উচ্ছেদ কার্যক্রম চলছে।
এই বিতর্কিত রাষ্ট্রটি সৃষ্টির পেছনে ছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য আর ফ্রান্সের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। উসমানিয়া খিলাফতের অবসানের পর তেলসমৃদ্ধ এই আরব অঞ্চলে পশ্চিমা শক্তিগুলোর প্রয়োজন ছিল একটি শক্তিশালী খুঁটি, যাকে ব্যবহার করে তারা আরবভূমির প্রাকৃতিক সম্পদ লুটপাট করতে পারে। প্রতিষ্ঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠমিত্র ইসরায়েল। সেই থেকে এখানে এই পরাশক্তিগুলোর প্রত্যক্ষ মদদে ফিলিস্তিনে চলছে নির্বিচারে গণহত্যা। বর্তমান গণহত্যার শুরু গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে, যা সাত মাসের বেশি সময় ধরে চলছে।
ন্যক্কারজনক গণহত্যাকে সহায়তা করতে মার্কিন কংগ্রেস সম্প্রতি ইসরায়েলের জন্য ২৩ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দের অনুমোদন দেয়। সেই যুক্তরাষ্ট্রই এখন বাংলাদেশসহ অন্য দেশের মানবাধিকার নিয়ে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে হাঁকডাক দেয়। ‘মানবাধিকারের ফেরিওয়ালা’ দেশ যুক্তরাষ্ট্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের এমন ঘৃণিত ইতিহাস আরও অনেক আছে। ১৯৭০ সালের ৪ মে দেশটির কেন্ট স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য আধাসামরিক বাহিনী ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করা হয়। গার্ড সদস্যরা ছাত্রদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালালে দুজন নিহত ও ছয়জন গুলিবিদ্ধ হয়।
ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধের দাবিতে গত ১৫ দিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চলছে তীব্র ছাত্র আন্দোলন ও বিক্ষোভ। এতে যোগ দিয়েছেন ফিলিস্তিনে গণহত্যাবিরোধী শিক্ষকরাও। শুরুটা দেশটির একেবারে প্রথম কাতারের কুলীন বিশ্ববিদ্যালয় নামে খ্যাত নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফিলিস্তিনে মার্কিন মদদে গণহত্যা বন্ধ করার দাবিতে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস দখল করে সেখানে তাঁবু খাটিয়েছেন।
সেই বিক্ষোভ দমনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পুলিশ ডাকার সিদ্ধান্ত নিলে এর প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষক ওয়াকআউট করেন। পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে পুলিশ বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আটক করে নিয়ে যায়। হার্ভার্ড, বোস্টন, এমআইটি, টেক্সাসসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভকারীদের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। বৃহস্পতিবার (২ মে) পর্যন্ত সেই গ্রেপ্তারের সংখ্যা এক হাজার ছুঁইছুঁই করছে।
ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া তাদের সমাবর্তন বাতিল করেছে। এই আন্দোলনে জায়নবাদবিরোধী ইহুদিসহ অন্য ধর্মাবলম্বীরাও অংশ নিচ্ছেন। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই বিক্ষোভ দমনে আধাসামরিক বাহিনী তলব করার চিন্তা করছে। সার্বিক বিচারে মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে যে, এই আন্দোলন সত্তরের দশকের ভিয়েতনামের পক্ষের আন্দোলনে রূপ নিচ্ছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন মার্কিন করপোরেশন ঘোষণা করেছে, এই বিক্ষোভ যদি থামানো না হয়, তাহলে তারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অর্থায়ন বন্ধ করে দেবে।
সোমালিয়ায় জন্মগ্রহণকারী ইলহান ওমর মার্কিন কংগ্রেসে রিপাবলিকান দল থেকে একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। সেই সঙ্গে তিনি কংগ্রেসে প্রথম মুসলমান সদস্য। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইলহান কংগ্রেসে (যুক্তরাষ্ট্রের সংসদ) ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের দখলদারি বন্ধের দাবিতে বক্তব্য দিয়েছিলেন। এই ‘অপরাধে’ তাকে পররাষ্ট্রবিষয়ক সংসদীয় কমিটিসহ সব কমিটি থেকে বাদ দেয়া হয়। কয়েক দিন আগে তার কন্যা কলেজছাত্রী ইসরা হিরসিকে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে শুধু গ্রেপ্তারই করা হয়নি, তাকে তার কলেজ থেকে বহিষ্কার পর্যন্ত করা হয়। এখন সেই তরুণী কারাবন্দী। তবে তার মা মেয়ের কারাবরণ নিয়ে গর্বিত বলে মত দিয়েছেন।
খুলনা গেজেট/কেডি