যশোরে গত ছয় বছরে সড়ক-মহাসড়ক উন্নয়নের জন্য জেলা পরিষদের মালিকানাধীন অন্তত ৪ হাজার ২০০টি গাছ কাটা হয়েছে, যার অর্থমূল্য প্রায় ১৪ কোটি টাকা। বিপুলসংখ্যক গাছ কাটা হলেও এ সময় নতুন করে একটি চারাও রোপণ করেনি জেলা পরিষদ। চলতি তাপপ্রবাহের মধ্যে এই গাছ নিধনের বিষয়টি নিয়ে আরও বেশি আলোচনা হচ্ছে। কারণ প্রচণ্ড গরমে কয়েক সপ্তাহ ধরে যশোর ও সংলগ্ন অঞ্চলে মানুষসহ সব প্রাণীর জীবন প্রায় ওষ্ঠাগত।
মঙ্গলবার যশোরে দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। পরিবেশবাদীরা বলছেন, চার সহস্রাধিক গাছ নিধন করায় ৮০০ হেক্টর বনভূমির সমপরিমাণ বন ধ্বংস করা হয়েছে; যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পরিবেশের ওপর।
জেলা পরিষদের তথ্য বলছে, গত ছয় বছরে তাদের মালিকানাধীন চারটি সড়কের ৪ হাজার ২১০টি গাছ কাটা হয়েছে, যার দাম প্রায় ১৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৮ সালে যশোর-খুলনা মহাসড়কে ১ হাজার ৮৯৫টি, ২০২১ সালে যশোর-ঝিনাইদহ সড়কের হৈবতপুর সেতু এলাকা থেকে ১২টি গাছ কাটা হয়। এর পরও যশোর-ঝিনাইদহ সড়ক থেকে নানা সময়ে কাটা পড়েছে আরও ৮৩৫টি গাছ। ২০২২ সালে যশোর-চুকনগর মহাসড়কে ৫০৭টি গাছ কাটা হয়। বর্তমানে যশোর-নড়াইল সড়কে ৯৬১টি গাছ কাটা চলমান; যার দাম ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এ ছাড়া ঐতিহাসিক যশোর-বেনাপোল সড়কে শতবর্ষীসহ ৬৯৭টি গাছ বিক্রির উদ্দেশ্যে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তবে পরিবেশবাদীদের আন্দোলন ও হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকায় আপাতত গাছ কাটা থেকে বিরত রয়েছে জেলা পরিষদ।
জানা গেছে, সম্প্রতি যশোর-নড়াইল মহাসড়কের ৯৬১টি গাছ কাটার কার্যাদেশ দিয়েছে জেলা পরিষদ। ইতোমধ্যে সড়কের দুই ধারের গাছ কাটা চলছে। গাছশূন্য হয়েছে যশোর-ঝিনাইদহ, যশোর-খুলনা, যশোর-চুকনগর মহাসড়ক। যশোর-চুকনগর সড়কে তাকালে আগে দু’ধারে প্রচুরসংখ্যক গাছ চোখে পড়ত বলে উল্লেখ করেন সুবীর ঘোষ। রাজারহাট এলাকার এ প্রবীণ ব্যক্তি বলেন, এখন এ সড়ক যেন বিরান ভূমি। যশোর-ঝিনাইদহ সড়কের চুড়ামনকাটি বাজারের ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম বলেন, সাত মাস আগেও এই সড়কে বড় বড় গাছ থাকায় শ্যামল ছায়ায় ঘেরা ছিল। এখন সেসব গাছ নেই।
বৃহত্তর যশোর অঞ্চলের পরিবেশ নিয়ে কাজ করেছেন চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক মো. ছোলজার রহমান। তিনি বলেন, ‘পরিবেশের প্রতি অতীত ও বর্তমানের দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক আচরণের পাশাপাশি আরও কয়েকটি কারণ এ অঞ্চলে উষ্ণায়নের জন্য দায়ী। গত এক দশকের মধ্যে এ অঞ্চলের অনেক সড়ক-মহাসড়কের দুই পাশের গাছ উজাড় করা হয়েছে। জমির হিসাবে সড়কের পাশ থেকে উজাড় করা হয়েছে প্রায় ৮০০ হেক্টরের গাছ। অল্প সময়ে একসঙ্গে এত গাছ কেটে ফেলা গরম বেড়ে যাওয়ার বড় একটি কারণ। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় আমাদের জরুরিভাবে বেশি বেশি বৃক্ষরোপণে জোর দিতে হবে।
যশোর রোড উন্নয়ন ও শতবর্ষী গাছ রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব জিল্লুর রহমান ভিটু বলেন, ‘সড়ক উন্নয়ন হবে– ভালো কথা। গাছ রেখেও পার্শ্ববর্তী দেশে উন্নয়ন চলছে। কিন্তু গাছ কাটতে পারলে তো টাকা খাওয়া যাবে। জেলা পরিষদ অপরিকল্পিতভাবে গাছ সাবাড় করেছে। তারা গাছ কেটেই যাচ্ছে; কিন্তু একটি গাছও লাগায়নি। যশোর অঞ্চলের মহাসড়কের দু’ধারের সব গাছ খেয়ে তারা মরুভূমি বানিয়ে ফেলেছে। এর প্রভাবে কয়েক বছর ধরে এ অঞ্চলে আবহাওয়া বিরূপ আচরণ করছে।
তবে যশোর জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আছাদুজ্জামান বলেন, ‘সড়ক ও জনপথ বিভাগ মহাসড়ক সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য জেলা পরিষদকে গাছ কাটার চিঠি দেয়। সেই চিঠির আলোকে জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটি ও বিভাগীয় কমিশনারের অনুমোদন সাপেক্ষে গাছ কাটার টেন্ডার করা হয়। গাছ বিক্রির টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে।’
জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুল বলেন, ‘গাছ লাগানোর জন্য আমাদের প্রতি কোনো নির্দেশনা নেই। সড়কগুলো কয় লেন হবে– এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এ অবস্থায় গাছ লাগালে তো হবে না। আমরা সড়ক ও জনপথ বিভাগে রাস্তার শেষ সীমানা বের করে দেওয়ার চিঠি দেব। বিগত সময়ে গাছ বিক্রির টাকা আছে ব্যাংকে। নির্দেশনা পেলে আমরা গাছ লাগাব।’
সূত্র : সমকাল
খুলনা গেজেট/এইচ