খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার কাছারি বাড়ি আর আর জি টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়টির বেশ সুনাম আছে। এখানে পড়াশোনা ভালো। এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল সন্তোষজনক। শিক্ষকেরাও যথেষ্ট যত্নশীল বলে জানিয়েছেন অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা।
কিন্তু বিদ্যালয়টির সব ইতিবাচক দিক খেয়ে ফেলেছে এর অস্বাস্থ্যকর পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা। ৩৯৭ জন শিক্ষার্থীর জন্য বিদ্যালয়টিতে শৌচাগার আছে চারটি। দুটি ছেলেদের, দুটি মেয়েদের।
বিদ্যালয়টির পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা জানার জন্য সরেজমিনে গত ৫ সেপ্টেম্বর গিয়ে দেখা যায় শৌচাগারগুলো দুর্গন্ধযুক্ত। ভেতরে আলোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। বিদ্যুৎ সংযোগ আছে, কিন্তু লাইটগুলো নষ্ট। হাত ধোয়ার বেসিনও অকেজো। শৌচাগারের ভেতরে টিস্যু তো নেই-ই, হাত ধোয়ার কোনো সাবানও নেই। তবে অন্যস্থানে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা থাকলেও সেই জায়গাটিও বেশ অপরিচ্ছন্ন।
কাছারি বাড়ি আর আর জি টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির এক ছাত্রী বলেন, ‘শৌচাগারের অবস্থা এত নোংরা যে বাধ্য হয়ে চেপে থাকি। স্যারদের বললেও কোনো লাভ হয় না।’
স্বাস্থ্যকর পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থার জন্য বিদ্যালয়টিতে একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী থাকলেও কাজটি করেন খন্ডকালীন নিয়োগপ্রাপ্ত একজন আয়া। তবে তার কাজের মধ্যে শৌচাগার পরিষ্কার করা পড়ে না।
কাছারি বাড়ি আর আর জি টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বীরেশ্বর বৈরাগী খুলনা গেজেটের কাছে স্বীকার করেন তার বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শৌচাগার নেই। অপরিচ্ছন্নতার জন্য তিনি উল্টো শিক্ষার্থীদের দায়ী করেন। বলেন, দৈনিক তিন থেকে চার বার শৌচাগার পরিষ্কার করা হচ্ছে। ছাত্রছাত্রী নিজেরাই জিনিসপত্র নষ্ট করে। আর প্রতিদিন সাবান দেওয়া হলেও তা থাকে না। এমনকি তারা কলগুলোও নষ্ট করেছে।
প্রধান শিক্ষকের এমন বক্তব্য কয়েকজন ছাত্রীকে জানালে শিক্ষকের ভয়ে কেউই কথা বলতে রাজি হননি। একজন ছাত্রী নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, প্রধান শিক্ষককে যদি এ ধরনের শৌচাগার ব্যবহার করতে হতো, তাহলে এতোদিনে এ অবস্থার উন্নতি হত। নিজেদের ব্যবহারের শৌচাগারটি স্বাস্থ্যকর রেখে শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে অবিচার করছেন শিক্ষকেরা।
দুর্গন্ধযুক্ত ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশের এ ধরনের পয়নিষ্কাশন পরিস্থিতি কি শুধু কাছারি বাড়ি আর আর জি টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়েরই? মাঠের চিত্র বলছে একদমই তা নয়। এ ঘটনা বরং সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই মোটামুটি একই রকম।
জেলার রুপসা উপজেলার বাগমারা আল আকসা দাখিল মাদ্রাসাটি ঘুরে দেখা যায় আরও ভয়াবহ চিত্র। এ মাদরাসায় মোট শিক্ষার্থী ৬৮৪ জন। আর শৌচাগার পাঁচটি, যার মধ্যে মেয়েদের দুটি এবং ছেলেদের তিনটি। পাঁচটির মধ্যে দুটিই অকেজো। চালু তিনটা আবার জরাজীর্ণ। শৌচাগারের ভেতরে পর্যাপ্ত আলো নেই। বদ্ধ কক্ষ। বাতাস বের হওয়ার সুযোগ নেই। এ মাদরাসায় নেই কোনো পরিচ্ছন্নতাকর্মী এবং এখানেও সাবান বা টিস্যুর ব্যবস্থা রাখা হয়নি। মেয়েদের পিরিয়ডকালীন সময়ের জন্যও কোনো ব্যবস্থা নেই মাদরাসাটিতে।
মাদরাসার সুপার এইচ এম মিজানুর রহমান অবশ্য সরলবাক্যেই বলেন, টাকার অভাবে নতুন শৌচাগার নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছে না। আর মাদরাসায় পরিচ্ছন্নতাকর্মী না থাকায় পরিষ্কার করা সম্ভব হয় না। মাদরাসায় মেয়েদের বিশেষ সময়ের জন্য কোনো ব্যবস্থা না থাকায় ছুটি দিয়ে দেন বলেও জানান তিনি।
প্রায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চিত্র একই
খুলনার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোরই পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা তাহলে এমন? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে জেলা শিক্ষা অফিসারের কার্যালয়ে যায় খুলনা গেজেট। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের কার্যালয় থেকে জানা গেল খুলনায় এক হাজার ১৫৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৪২০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ১৩১টি মাদরাসা রয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দুই লাখ ৩৬ হাজার ৩১৯, মাধ্যমিকে এক লাখ ৫৭ হাজার ৮২ এবং মাদ্রাসায় ২৮ হাজার ৬৭৮ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। সবাই অর্থাৎ চার লাখ ২২ হাজারের মতো শিক্ষার্থীর অন্তত ৮০ শতাংশ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছে।
পরিস্থিতি আরও গভীরে গিয়ে বোঝার জন্য দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি খুলনা সদর ও উপজেলার মোট ২৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরেজমিনে ঘুরে দেখে খুলনা গেজেট। ঘুরে দেখা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো হচ্ছে ডুমুরিয়া উপজেলার থুকড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শাহপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রূপসা উপজেলার ৫৬নং বাগমারা দক্ষিণ পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কয়রা উপজেলার জয়পুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও দেয়াড়া পশ্চিমপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো হচ্ছে নগরীর সরকারি করোনেশন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, সরকারি ইকবালনগর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, মহেশ্বরপাশা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, খানজাহান আলী মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ডুমুরিয়া উপজেলার শাহপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, শাহপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, হাজীডাঙ্গা খলসী মাধ্যমিক বিদ্যালয়, শলুয়া পূর্ণচন্দ্র মাধ্যমিক বিদ্যালয়, রূপসা উপজেলার সামছুর রহমান মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ফুলতলা উপজেলার শিরোমণি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কয়রা উপজেলার বাঁশখালি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কাটনিয়া অর্জনপুর কলুখালি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, লালুয়া বাগালি এম এম মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং সুন্দরবন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়।
এ ছাড়া থুকড়া ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা, ডুমুরিয়া মহিলা দাখিল মাদ্রাসা; বাগমারা আল আকসা কাওমী মাদ্রাসা, বাগমারা আল আকসা দাখিল মাদ্রাসা; গিলাতলা আহমাদিয়া দাখিল মাদ্রাসা, জয়পুর শিমলার আইট দারুচ্ছুন্নাহ দাখিল মাদ্রাসা ঘুরে প্রায় প্রতিটিতেই একই পরিস্থিতি চোখে পড়ে।
২৫টির মধ্যে ২০টি প্রতিষ্ঠানের শৌচাগার ব্যবস্থা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। নিয়মিত পরিষ্কারের অভাবে দুর্গন্ধযুক্ত ও স্যাতস্যাতে পরিবেশ এগুলোতে। তবে ২৫টিতেই শৌচাগারের ভেতরে সাবান বা টিস্যুর কোনো ব্যবস্থা নেই। অবশ্য শৌচাগারের বাইরে হাত ধোয়ার জন্য কল আছে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে।
পিরিয়ডের সময় শিক্ষার্থীরা ছুটিতে থাকে
খুলনা গেজেটের অনুসন্ধান অনুযায়ী ১৮টি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর তুলনায় শৌচাগার কম। এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও আছে, যেখানে ছেলে-মেয়েদের জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেই। যেমন কয়রা উপজেলার ৩২নং জয়পুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১১০ জন শিক্ষার্থীর জন্য দুটি শৌচাগার। যা ছেলেমেয়ে উভয়ই ব্যবহার করে।
ছাত্র-ছাত্রী আলাদা লেখা থাকলেও কেউ-ই তা মানে না এমনটিই দাবি বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক জামাল উদ্দীনের। তিনি দাবি করেন, ছেলে-মেয়েদের বললেও তারা কথা শোনে না। এদিকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী না থাকায় নৈশ প্রহরীকে দিয়ে শৌচাগার পরিষ্কার করান বলে জানান তিনি।
কয়রার জয়পুর শিমলার আইট দারুচ্ছুন্নাহ দাখিল মাদ্রাসারও একই অবস্থা। মাদরাসার নলকূপটিও নষ্ট। পাশের মৎস্যঘেরের নোনাপানি ও ১০০ মিটার দূরের নলকূপটিই ভরসা শিক্ষার্থীদের।
প্রান্তিক পর্যায়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ুয়া মেয়েদের জন্য পিরিয়ডকালীন কোনো ব্যবস্থা নেই। একই অবস্থা মাদ্রাসার প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই। আবার বিদ্যুতের ব্যবস্থা থাকলেও তার অধিকাংশই লাইট বা সুইচবোর্ড নষ্ট।
তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় প্রতি মাসে পিরিয়ডকালীন সমস্যায় ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে অনুপস্থিত থাকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষের এ ব্যাপারে কোনো মাথা ব্যথা নেই।
এতে শুধু যে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে শিক্ষার্থীরা, তা নয়। শিক্ষা ঝুঁকিতেও আছে তারা। সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে কিশোরীরা।
রুপসা উপজেলার বাগমারা আল আকসা দাখিল মাদ্রাসার এক শিক্ষার্থী জানান, দুর্গন্ধের কারণে শৌচাগারেই যাওয়া যায় না। পিরিয়ডের সময় প্যাড বদলানোর কোনো উপায় নেই। ফলে বাড়িতে থাকাটাই ভালো বলে মনে করি। যদিও অনুপস্থিত থাকার এ সময়ের ক্লাসের পড়াগুলো বুঝতে কষ্ট হয়।
অনেক মেয়ে শিক্ষার্থী শৌচাগার ব্যবহার করে না
তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে যে চিত্র পাওয়া গেছে, তাতে বোঝা যায়, অপরিচ্ছন্নতা ও দুর্গন্ধযুক্ত পরিবেশের কারণে প্রতি দশজন শিক্ষার্থীর মধ্যে অন্তত তিনজন শৌচাগারই ব্যবহার করে না। কেউ স্কুলের আশপাশের বাড়িতে যায় অথবা বাসায় ফিরে নিজেদেরটা ব্যবহার করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারি করোনেশন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির এক ছাত্রী বলেন, স্কুল শেষে বাসায় ফিরে শৌচাগার ব্যবহার করি।
সন্তানদের এসব বিষয় নিয়ে শঙ্কিত অভিভাবকেরা। বাগমারা আল আকসা দাখিল মাদরাসার ৭ম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর মা বলেন, আমার মেয়ে মাদরাসার শৌচাগারে যেতে চায় না। গেলে বমি আসে। মাঝেমধ্যে আমরা অভিভাবকেরা পানি ঢেলে শৌচাগার পরিষ্কার করি। নোংরা পরিবেশের কারণে অনেক সময় প্রস্রাব পায়খানা চাপিয়ে রাখে বাচ্চারা। স্কুলে অপেক্ষারত অনেক অভিভাবকদের ক্ষেত্রেও এমনটি হয়। তিনি আরও বলেন, মাদরাসা কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
শিক্ষকদের দায়সারা জবাব
পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থার এ দুরাবস্থার ব্যাপারে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মন্তব্য ভিন্ন। নগরীর সরকারি করোনেশন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মোছাঃ মাকামী মাকছুদা খুলনা গেজেটকে বলেন, ‘আমাদের এখানে প্রতিটি ভবনে পর্যাপ্ত শৌচাগারের ব্যবস্থা আছে। নিয়মিত পরিষ্কারও করা হয়। যারা এ ব্যাপারে অভিযোগ করেছে তারা মিথ্যা বলেছে।’
সরকারি ইকবালনগর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ফারুকুল ইসলাম খুলনা গেজেটকে বলেন, ‘আমাদের বিদ্যালয়ে পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থার সব সরঞ্জাম আগে থেকে কেনা থাকে। মেয়েরা কোনো অভিযোগ করতেই পারে না। অনেক জিনিস বরং বাচ্চারা নষ্ট করে ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো ঠিক করা হয়।’
ডুমুরিয়া উপজেলার শাহপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা শর্মিলা ঢালী বলেন, সপ্তাহে দুই থেকে তিন বার আমার বিদ্যালয়ের তিনটি শৌচাগারই পরিষ্কার করা হয়। শিক্ষার্থী বেশি থাকায় এগুলো সংরক্ষণ করা মুশকিল। তদারক ব্যবস্থা নিয়েও সফল হওয়া যায়নি। শিক্ষার্থী অনুযায়ী শৌচাগারের সংখ্যা পর্যাপ্ত না হলেও কিছু করার নেই। কারণ এ ব্যাপারে সরকারিভাবে কোনো বরাদ্দ নেই।
কয়রা উপজেলার কাটনিয়া অর্জনপুর কলুখালি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রকাশ সানা দোষ দেন করোনা মহামারীকে। বলেন, করোনায় দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থার এ দশা হয়েছে। সরকারিভাবে কোনো বাজেট না থাকায় স্কুল কর্তৃপক্ষের সাধ্যের বাইরে কিছু করা সম্ভব হয় না। তবে এ অবস্থা উপজেলার প্রায় প্রতিটি বিদ্যালয়ে।
প্রকাশ সানার দাবি এ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে গেলে সরকারিভাবে প্রকল্প নিতে হবে।
বিদ্যালয়টির আহ্বায়ক কমিটির সভাপতি ও বাগালী ইউপি চেয়ারম্যান সামাদ গাজী বলেন, ওই বিদ্যালয়ের যাতায়াত ব্যবস্থা অত্যন্ত খারাপ। এজন্য নিয়মিত বিদ্যালয়ে যেয়ে খোঁজখবর নেওয়া সম্ভব হয় না।
সরকারের পক্ষ থেকে যা বলা হচ্ছে
খুলনা জেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন দশা নিয়ে খুলনা গেজেটের পক্ষ থেকে প্রথমে কথা বলা হয় জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. রুহুল আমীনের সঙ্গে। তিনি বলেন, পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থার কিছু জায়গায় ঘাটতি আছে তবে অধিকাংশ জায়গাই ভালো। সরকারিভাবে এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) মাধ্যমে পয়নিষ্কাশনের সরঞ্জাম সরবরাহ করা হচ্ছে। এছাড়া যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা আছে তারা নিজেরাই এগুলো ঠিক করার চেষ্টা করছে।
সন্তোষজনক জবাব না পেয়ে জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. মনিরুজ্জামান তালুকদারের সঙ্গে কথা বলা হয়। তিনি বলেন, প্রতিটি বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার ও ওয়াশব্লক অর্থাৎ নিরাপদ পানীয় জলের সুব্যবস্থা থাকার সরকারি নির্দেশনা আছে। সরকারি বেসরকারি সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই এটা নিশ্চিত করার কথাও বলা আছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে বিষয়টা নিশ্চিত করবে ব্যবস্থাপনা কমিটি।
এ ছাড়া জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আরেকটা কার্যক্রম আছে বলে জানান ডিসি। সেটা হচ্ছে মেয়েদের জন্য হাইজিন কর্ণার বা ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার জন্য স্বাস্থ্যসম্মত আলাদা স্থান করা। এতে তারা বিশেষ দিনগুলোতে ভালো পরিবেশ পাবে এবং স্বাস্থ্যসম্মতভাবে ন্যাপকিন বদলানো থেকে শুরু করে সব ধরনের সেবা নিতে পারবে।
জেলা প্রশাসক আরও বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে দুই বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কার্যক্রমটা একটু স্থগিত আছে। আমরা এটা আবার নতুন করে চালু করব এবং শিক্ষা অফিস, স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী অফিসার, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির নেতাদের নিয়ে শিগগির ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ ব্যাপারে খুলনা গেজেটের পক্ষ থেকে কথা বলার চেষ্টা করা হয় শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরি নওফেল এবং শিক্ষামন্ত্রীর একান্ত সচিব আবু আলী মোঃ সাজ্জাদ হোসেনের সঙ্গে। তাদেরকে মোবাইল ফোনে না পেয়ে বিষয়বস্তু উল্লেখ করে খুদেবার্তা (এসএমএম) পাঠানো হয়। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন
অস্বাস্থ্যকর শৌচাগার ব্যবহার, সাবান দিয়ে হাত না ধোয়া, দীর্ঘক্ষণ প্রস্রাব-পায়খানা চাপিয়ে রাখা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এতে ডায়রিয়া, কৃমি, টাইফয়েড, চর্ম রোগ, পেটে পীড়াসহ নানান সমস্যা দেখা দিতে পারে। এমনটিই জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিষয়ক পরামর্শক ডাক্তার সানজিদা হুদা সুইটি খুলনা গেজেটকে বলেন, দীর্ঘক্ষণ প্রস্রাব-পায়খানা চাপিয়ে রাখলে প্রস্রাবে প্রদাহ (ইউরিন ইনফেকশন) হতে পারে। এ ছাড়া মেয়েদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সাদাস্রাব হতে পারে।
সানজিদা হুদা আরও বলেন, প্রস্রাবে প্রদাহ হলে অনেক সময় টিউবও ব্লক হয়ে যেতে পারে। এতে বন্ধ্যাত্বসহ বিয়ের পরবর্তী সময়ে নানা রকম শারীরিক সমস্যা হতে পারে। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া এমন অনেক রোগীই আমরা পেয়ে থাকি যাদের অধিকাংশ দীর্ঘক্ষণ প্রস্রাব চাপিয়ে রাখার ফলে এ ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মূত্র ব্যবস্থা বিভাগের চিকিৎসক (ইউরোলজিস্ট) ও পুরুষরোগ বিষয়ক পরামর্শক নিরুপম মন্ডল খুলনা গেজেটকে বলেন, অস্বাস্থ্যকর শৌচাগার ব্যবহারের ফলে প্রসাবের রাস্তায় জীবাণু সংক্রমিত হতে পারে। এতে পুরুষ শিশুদের যৌনাঙ্গের অগ্রতকে প্রদাহ, অভ্যন্তরে পুঁজ হওয়া এবং অন্ডকোষে প্রদাহ হতে পারে।
দেশের অন্যতম মূত্র ব্যবস্থা বিজ্ঞানের চিকিৎসক এবং ইনসাফ বারাকাহ কিডনি অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালের ইউরোলজি বিভাগের প্রধান ফখরুল ইসলাম খুলনা গেজেটকে বলেন, শৌচাগার স্বাস্থ্যকর না হলে বাচ্চাদের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়, খিটখিটে মেজাজ এমনকি বাইরে প্রস্রাব করতে যেতেও ভয় পায়। আমাদের কাছে ইদানীং এ ধরনের সমস্যা নিয়ে অনেক বাবা-মা আসেন। যাদের বাচ্চারা প্রস্রাব চাপিয়ে রাখে আবার শৌচাগারে যেয়ে বমি করে ফেলে।
ফখরুল ইসলাম বলেন, প্রস্রাব চাপিয়ে রাখলে প্রস্রাবের থলি ফুলে যায়, ঠিকমত প্রস্রাব হয় না, প্রস্রাবের সাথে রক্ত যেতে পারে, থলি ফেটে যেয়েও রক্তক্ষরণ হতে পারে। অনেক সময় থলি অকেজো হয়ে যায়, আবার এর কর্মক্ষমতার পরিবর্তনও হয়। এতে কোন কোন বাচ্চার ঘনঘন প্রস্রাব হয় আবার অনেকের প্রস্রাব কম হয়। ছেলে শিশুদের তুলনায় মেয়েদের প্রস্রাবে প্রদাহ সমস্যাটা বেশি দেখা দেয়।
ফখরুল ইসলাম আরও বলেন, যে সমস্ত প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের সমস্যা প্রথমত সেগুলো আগে ব্যবহার উপযোগী করে তোলা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে অনুপ্রাণিত করতে হবে। আবার সরকারের সুনির্দিষ্ট নীতিও থাকা দরকার। আর শিশুদের পাঠ্যপুস্তকের শিক্ষার পাশাপাশি এ ধরনের মৌলিক শিক্ষাগুলোও দিতে হবে। নইলে অসুস্থ মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠবে তারা। যা সমাজের জন্য মোটেও ভাল কিছু বয়ে আনবে না।
খুলনা গেজেট/ টি আই/এমএম