খুলনা, বাংলাদেশ | ৫ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২০ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রক্টর নিয়োগ নিয়ে ছাত্রদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া
  ৭ দিনের জন্য আন্দোলন স্থগিত করেছেন তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা
  ইউনাইটেড হাসপাতালের চেয়ারম্যানসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা
  ৪০তম ব্যাচের ক্যাডেট এসআইদের সমাপনী কুচকাওয়াজ স্থগিত
মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণ কাজ উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে

প্রথমবার সরকারীভাবে পালিত হচ্ছে কপিলমুনি মুক্ত দিবস

পারভেজ মোহাম্মদ ও অলিউল্লাহ গাজী

১৯৭১ সালে খুলনার বৃহত্তম রাজাকার ঘাটি হিসেবে ব্যবহৃত কপিলমুনির রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর বাড়ি।
১৯৭১ সালে খুলনার বৃহত্তম রাজাকার ঘাটি হিসেবে ব্যবহৃত কপিলমুনির রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর বাড়ি।

৯ ডিসেম্বর শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার ও আনছারের রক্তন্সাত কপিলমুনি মুক্ত দিবস। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে এবারই প্রথম সরকারীভাবে দিবসটি পালিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ও যুদ্ধক্ষেত্র সংরক্ষণে উদ্যোগ নিয়েছেন। সারা দেশের ন্যায় কপিলমুনি যুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে ইত্যেমধ্যে এই যুদ্ধক্ষেত্রে প্রকল্প গ্রহণের জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে দুই কোটি টাকা বরাদ্দও করা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ. ক. ম মোজাম্মেল হক (এমপি) বুধবার দুপুর ১২ টায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত কপিলমুনিতে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণ কাজের শুভ উদ্বোধন ও যুদ্ধকালীন রাজাকারদের ব্যবহৃত ঘাঁটি (তৎকালীন মিনি ক্যাম্প হিসেবে পরিচিত) রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর বাড়ি পরিদর্শন করবেন। এরপর স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী অনির্বাণ লাইব্রেরী পরিদর্শন, পরবর্তীতে বিকেল ৩ টায় কপিলমুনি মুক্ত দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিবেন।

এদিকে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে জনতার রায় কার্যকর করে ১৫১ রাজাকারের মৃত্যুদ- কার্যকরের বিরল ইতিহাস সমৃদ্ধ কপিলমুনি মুক্ত দিবস সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যবিধি মেনে উপজেলা প্রশাসনের আয়োজনে দিবসটি পালনের প্রস্ততি নেওয়ায় এলাকার মানুষ ব্যাপক উৎফুল্ল ও আবেগ আপ্লুত। কপিলমুনি যুদ্ধে আত্মসমর্পনকারী রাজাকারদের মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়া সেই সহচরী বিদ্যামন্দির মাঠেই নির্মিত হয়েছে সুসজ্জ্বিত মঞ্চ, সড়কের বিভিন্ন স্থানে নির্মিত হয়েছে তোরণ।

খুলনা-৬ আসনের সংসদ সদস্য মোঃ আক্তারুজ্জামান বাবু জানান, কপিলমুনি মুক্ত দিবসে বড় ধরণের কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। কপিলমুনি যুদ্ধের ঘটনাগুলো সরকারী নথিতে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরায় ও তা যথাযথভাবে সংরক্ষণে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ.বি.এম. খালিদ হোসেন সিদ্দিকী জানান, কপিলমুনি ম্ক্তু দিবসের অনুষ্ঠানের কাজ এগিয়ে চলছে। এই যুদ্ধের দুই জন শহীদ পরিবারসহ অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হবে। অন্যদিকে স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ সরকারের এই মহৎ উদ্যোগকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ. ক. ম মোজাম্মেল হক (এমপি), জনপ্রতিনিধি খুলনা ৬ এর সংসদ সদস্য মোঃ আক্তারুজ্জামান বাবু সহ স্থানীয় দুই কৃতি সন্তান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব শেখ ইউসুফ হারুন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ এর শুভাগমনে স্থানীয়দের কিছু দাবি দাওয়া সামনে উঠে এসেছে।

১৫১ রাজাকারের মৃত্যুদ- কার্যকর করা সেই ঐতিহাসিক কপিলমুনি সহচরী বিদ্যামন্দির মাঠ, যেখানে বুধবার পালিত হবে মুক্ত দিবসের অনুষ্ঠান।

স্থানীয়দের দীর্ঘ দিনের দাবি বিনোদগঞ্জ পৌরসভা বাস্তবায়ন, কপিলমুনি সহচরী বিদ্যামন্দিরের মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতি বিজড়িত মাঠের দক্ষিণ পার্শ্বে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার ও আনছার গ্যালারী নির্মাণ, মুক্তিযুদ্ধা স্মৃতি কমপ্লেক্স এর আওতায় যাদুঘর, অডিটেরিয়াম, পার্ক, অতিথিশালা এবং বীরাঙ্গণা গুরুদাসীর নামে স্থাপনা নির্মান সহ কপিলমুনি-কানাইদিয়া ব্রীজের অসম্পূর্ণ কাজ সম্পন্ন, কপিলমুনি ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (কে কে এস পি) কে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় একটি পূর্ণাঙ্গ ক্রীড়া শিক্ষা একাডেমীতে রূপান্তরের জোরালো দাবী উঠে এসেছে।

উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের এই দিনে ৪৮ ঘন্টা রক্ষক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ১৫৫ রাজাকারের আত্মসর্মাপনের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ খুলনার সর্ব বৃহৎ শত্রু ঘাটির পতন ঘটে। ঐ দিন উপস্থিত হাজার হাজার জনতার রায়ে আত্মসমর্পণকৃতদের মধ্যে ১৫১ জন রাজাকারকে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে গুলি করে রায় কার্যকর করা হয়। তৎকালীন পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর দোসররা সারা দেশব্যাপী সাধারণ নিরীহ মানুষের উপর অবর্নণীয় অত্যাচার ও নির্যাতন চালাতে থাকে। আর এ অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকার মত জেলার পাইকগাছার সর্বত্র প্রতিরোধ দূর্গ গড়ে ওঠে। এ সময় পাক দোসররা বিশাল অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঘাঁটি করে ঐতিহ্যবাহী কপিলমুনিতে। অত্যাচারি বহু পরিবার সে সময় বিদেশে পাড়ি জমায়। কপিলমুনির পরিত্যাক্ত স্বর্গীয় রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর সুরম্য বাড়িটি পাকিস্তানী দোসররা ঘাঁটি হিসাবে বেছে নেয় এবং এলাকায় নিযার্তনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। এ সময় তারা এলাকায় নিরীহ মানুষেদের ধরে ক্যাম্পে এনে শরীরের বিভিন্ন অংশে কেটে লবন দিত। এমনকি নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করে সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে লাশ নদীতে ফেলে দিত। এলাকার হিন্দুদের বসবাস বেশী থাকায় এখানকার হিন্দুদের উপর চলত অমানুষিক অত্যাচার ও নির্যাতন। তাদের ধন সম্পাদ লুট, এমনকি তাদেরকে জোর করে হিন্দু ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্মেও দীক্ষিত করা হত। বাধ্য করা হতো মুসলমান ধর্ম গ্রহণে।

এ সব অত্যাচারের বিরুদ্ধে পাইকগাছার রাড়ুলি, বাঁকা, বোয়ালিয়া ও গড়ুইখালি মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প গড়ে তোলে। খুলনাঞ্চলের মধ্যে কপিলমুনির শত্রু ঘাঁটি ছিল সবচেয়ে বড় ঘাঁটি। সাড়ে ৩’শর বেশি পাকসেনা ও তাদের দোসররা এখানে অবস্থান নেয়। ছাদের উপরে সব সময় তাক করা থাকত ভারী অস্ত্র, কামান ও মেশিনগান। ১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বর ক্যাপ্টেন আরেফিনের নেতৃত্বে একদল মুক্তি বাহিনী প্রথমে কপিলমুনি রাজাকারদের ঘাঁটিতে আঘাত করে। কিন্তু সুরক্ষিত দুর্গ আর রাজাকারদের শক্ত অবস্থানের কারনে সেই যুদ্ধে কোন সফলতা পায়নি। পরবর্তিতে পুনরায় পরিকল্পনা করে দক্ষিন খুলনার বিভিন্ন এলাকার কমান্ডিং অফিসাররা উপজেলার রাড়ুলীর বাঁকা ক্যাম্পে এসে সকলে একত্রিত হন এবং কপিলমুনিকে রাজাকার মুক্ত করতে পরিকল্পনা গ্রহন করেন। ঐ সময় পরিকল্পনায় অংশ গ্রহন করেন নৌ-কমান্ডার গাজী রহমত উউল্লাহ দাদু, শেখ কামরুজ্জামান টুকু, স.ম বাবর আলী, গাজী রফিক, ইউনুস আলী ইনু, শেখ শাহাদাত হোসেন বাচ্চু, মোড়ল আব্দুস সালাম, আবুল কালাম আজাদ সহ অনেকে কপিলমুনি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন।

মুক্তিযোদ্ধারা ৫ টি ভাগে বিভক্ত হয়ে অবশেষে ৭ ডিসেম্বর রাতে চারিদিক থেকে কপিলমুনি শত্রু ঘাঁটি আক্রমণ করেন। দীর্ঘ যুদ্ধ শেষে ৯ ডিসেম্বর বেলা ১১ টার দিকে অস্ত্র ফেলে সাদা পতাকা উড়িয়ে ১৫৫ জন রাজাকার পাকিস্তানি দোসররা আত্মসমার্পন করে। সাথে সাথে পতন ঘটে খুলনাঞ্চলের বৃহত্তর শত্রু ঘাঁটির। এই যুদ্ধে খুলনার আইসগাতির আনোয়ার ও সাতক্ষীরার আশাশুনির গলডাঙ্গা গ্রামের গাজী আনসার আলী নামে দুই মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। শত্রুদের বন্দি করে নিয়ে আসা হয় কপিলমুনি সহচরী বিদ্যামন্দির ঐতিহাসিক ময়দানে। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে, এলাকার হাজার হাজার জনতার ঢল নামে ময়দানে। জনগনের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাৎক্ষণিক যুদ্ধকালীন কমান্ডাররা সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজাকারদের প্রকাশ্যে গুলি করে মৃত্যুদন্ড দিয়ে জনতার রায় কার্যকর করা হয়।

অথচ স্বাধীনতা যুদ্ধের এই ঐতিহাসিক ঘটনার যথাযথ স্বীকৃতি মেলেনি। সেখানকার স্মৃতি সংরক্ষণে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। দেয়ালে পেরেকবিদ্ধ সৈয়দ আলী গাজীর পরিবার ও সকলের পরিচিত গুরুদাসী মাসিরা আজও অবহেলিত। এলাকাবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে বর্তমান শেখ হাসিনা সরকার কপিলমুনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ এবং গণআদালতের রায় কার্যকরের ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর প্রাক্কালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী এই কর্মসূচি নিয়েছেন।

 

খুলনা গেজেট /এমএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!