হাতে সময় মাত্র ১১ মাস। এরপরই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি বছরের শেষ সপ্তাহে অথবা আগামী বছরের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হবে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারের জনসভা থেকে আভাস দিয়েছিলেন ২০২৪ সালের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু গত শুক্রবার সরকারের চার বছর পূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে তিনি চলতি বছরের শেষে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ারও আভাস দেন। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারাও একই ইঙ্গিত দিচ্ছেন। এই ১১ মাসকে নির্বাচনী মাস হিসেবে ধরে নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এজন্য রোডম্যাপও তৈরি করা হয়েছে। দলের সব উইংকে এরইমধ্যে নির্বাচনমুখী করা হয়েছে। নির্বাচনকে টার্গেট করে এখন থেকে সব ধরনের কর্মসূচি পালন করবে দলটি। বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা বলেন, আমাদের হাতে আসলে এখন খুব একটা বেশি সময় নেই। তাই নির্বাচনের জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছি। দলীয় নেতাকর্মীদের নির্বাচনমুখী কর্মসূচি পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নির্বাচনের অংশ হিসেবে এরইমধ্যে সদ্যবিদায়ী মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ারকে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটিতে যুক্ত করা হয়েছে। অবসরোত্তর ছুটিতে থাকায় তাকে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো পদে বসানো হয়নি। তবে তাকে দলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সাবেক কো-চেয়ারম্যান এইচ টি ইমাম যে কক্ষে বসতেন সেখানে কবির বিন আনোয়ারকে বসতে বলা হয়েছে।
এদিকে দলটির পক্ষ থেকে যারা আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে ইচ্ছুক তাদের নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় তৎপর হতে বলা হয়েছে। মানুষের দোরগোড়ায় গিয়ে তাদের সুবিধা-অসুবিধা দেখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিরোধী পক্ষ কোনো নির্বাচনী এলাকায় যেন অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে না পারে সেজন্য সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এদিকে রাজধানীতে থাকা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অফিস ও ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়কে এখন থেকেই নির্বাচনমুখী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে দেখা যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় নেতারা এরইমধ্যে বিভাগ ও জেলা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় করে বিভিন্ন কর্র্মসূচি পালন শুরু করেছেন। বিশেষ করে দলটির সাংগঠনিক সম্পাদকরা দৌড়ঝাঁপ করছেন বেশি। প্রথম দিকে বিভাগ অনুযায়ী তারা দায়িত্ব পালন করলেও এখন জেলা পর্যায় নিয়েও কাজ করছেন। আগামী নির্বাচনকে টার্গেট করে আওয়ামী লীগ তাদের কাউন্সিলে নেতৃত্বের তেমন কোনো পরিবর্তন করেনি। নেতৃত্ব পরিবর্তন হলে নানা ধরনের বলয় তৈরি হয়। নির্বাচন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো বলয়ে দলকে নিতে চাননি দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। তবে নির্বাচনের পরপরই আগাম কাউন্সিল করে নেতৃত্বের পরিবর্তন আনতে পারে দলটি। গত বছরের শেষদিকে আগামী নির্বাচনে দলের কাকে কাকে মনোনয়ন দেয়া হবে তার একটি খসড়া তৈরি করেছে বলে দাবি করেন আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা। তারা বলেন, একেকটি আসনে দুই থেকে তিনজনের নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে।
তাদের বিষয়ে এখন আরও বিস্তর খোঁজ-খবর নেয়া হচ্ছে। চলতি বছরের আগস্টের আগেই সংসদ সদস্য পদে তালিকা চূড়ান্ত করা হবে। প্রথমদিকে তিনশ’ আসনের জন্যই মনোনয়ন চূড়ান্ত করবে আওয়ামী লীগ। পরে জোটবদ্ধ কিংবা অন্য কোনো রাজনৈতিক ফরমেটে নির্বাচন হলে তখন আসন অনুযায়ী মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হবে। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা বলেন, নির্বাচন পর্যন্ত দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখাই এখন মূল চ্যালেঞ্জ। এজন্য নানা ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে যেসব আসনে কোন্দল হতে পারে সেসব আসনের দিকে আলাদাভাবে দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। এজন্য দলটির যুগ্ম সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকরা তৎপর রয়েছেন। আর সবকিছু তত্ত্বাবধান করছেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি নিজেও নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। এরইমধ্যে কয়েকটি জেলায় জনসভা করে আগামী নির্বাচনে দলের জন্য ভোট চেয়েছেন। কেন আওয়ামী লীগকে ভোট দিতে হবে সে যুক্তিও তুলে ধরেন তিনি। দলীয় নেতারা জানান, আপাতত প্রতি মাসে অন্তত তিনটি করে জেলায় জনসভা করতে চান আওয়ামী লীগ সভাপতি।
নির্বাচনের আগে জনসভার সংখ্যাও বাড়বে। এদিকে অতীতে যারা নানা কারণে দল থেকে শাস্তি পেয়েছিলেন তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়ে মূলত নির্বাচনের বৈতরণী সহজে পার হওয়ার কৌশল নিয়েছে আওয়ামী লীগ। অনেক জায়গায় বহিষ্কৃতরা অনেক শক্তিশালী ও দলের জন্য অপরিহার্য। সবমিলিয়ে আগামী ১১ মাস নির্বাচনের দিকে চোখ রেখেই এগোচ্ছে আওয়ামী লীগ। লক্ষ্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদের কর্তৃত্ব নিজেদের হাতে রাখা। দেশকে পরিচালনা করা। এ প্রসঙ্গে দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আফম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, নির্বাচন হচ্ছে রাজনীতির প্রাণ। আওয়ামী লীগ বড় ও সবচেয়ে জনপ্রিয় দল। তাই আমাদের নির্বাচনের প্রস্তুতি সবসময় থাকে। কোন্দলের বিষয়টি এখানে আপেক্ষিক। কারণ বড় দলে নেতৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া আওয়ামী লীগ হচ্ছে গণতান্ত্রিক দল। এখানে যোগ্যতা অনুযায়ী সবারই কাজ করার সুযোগ রয়েছে।
তিনি বলেন, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যাদেরকে মনোনয়ন দেবে তাদের জন্য দলের সবাই ঐক্যবদ্ধ থেকে কাজ করবে। অতীতে এ ধরনের বহু উদাহরণ রয়েছে। টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ।
অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলনে থাকা বিএনপি’র চোখ এখন আন্দোলনে। নানা ইস্যুতে সরকারবিরোধী আন্দোলন করলেও এখন দলটির লক্ষ্য সব বিরোধী রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আদায় করা। এজন্য যুগপৎ আন্দোলনও শুরু হয়েছে। সামনের সময়ে দলগুলোর সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে সরকার পতনের এক দফা বা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি নিয়ে মাঠে থাকতে চায় দলটি। নেতারা বলছেন, এতদিন ইস্যুভিত্তিক নানা কর্মসূচি পালিত হলেও সামনে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সব আন্দোলন ও কর্মসূচি আবর্তিত হবে। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে বিএনপি। একইসঙ্গে দেশব্যাপী গণসমাবেশ, গণমিছিলের মতো নানা কর্মসূচির মাধ্যমে দাবি আদায়ের চেষ্টা চলছে দলটির। নির্বাচনী বছরে পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে চায় দলটি।
বিগত সময়ে দেয়া বিভাগীয় সমাবেশ, গণমিছিলসহ কর্মসূচিতে ব্যাপক উপস্থিতিতে উজ্জীবিত দলের নেতাকর্মীরা। দলটির নীতিনির্ধারকরা বলছেন, ২০২৩ সাল হবে আন্দোলনের বছর। পুরো বছরজুড়ে আন্দোলন ও নির্বাচন এই বাস্তবতা সঙ্গী করে চলবে বিএনপি। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন ও সরকারের পদত্যাগ নিশ্চিত করতে নানা হিসাবনিকাশ করেই আন্দোলন অব্যাহত রাখছেন বিএনপি নেতারা। দলীয় সমীকরণের সূত্র ধরেই গত বছরের শেষ তিন মাস মাঠের নেতাদের সক্রিয় করতে সভা-সমাবেশ করেছেন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা। সারা দেশে বিভাগীয় সমাবেশের মধ্যদিয়ে আন্দোলনে গতি ফিরেছে বলে মনে করছেন তারা। ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে চলতি বছরও রাজপথ দখলে রাখতে চায় বিএনপি। এই মুহূর্তে সরকার পতন ও নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলনের বিকল্প নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অতীতের নানা অভিজ্ঞতা থেকে আন্দোলনের ধরন আগেই প্রকাশ করছে না হাইকমান্ড। নেতারা বলছেন, পরিস্থিতি বুঝে কর্মসূচি ঠিক করা হবে। পরিস্থিতির আলোকে কর্মসূচি পরিবর্তন করা হবে। নেতাকর্মীরা বিভ্রান্ত হন এমন কোনো কর্মসূচি দেয়া হবে না। বিশেষ করে সাধারণ মানুষকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করা যায় এমন সব ভাবনাকে গুরুত্ব দেয়া হবে। নেতারা বলছেন, রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের যে রূপরেখা দেয়া হয়েছে এটি সব মহল গ্রহণ করেছে। তাই এই রূপরেখা সব মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে নেতারা কাজ করছেন। এই কার্যক্রম আরও জোরদার করা হবে। বিএনপি’র শীর্ষ নেতারা বলছেন, যুগপৎ আন্দোলনের ১০ দফা কর্মসূচি আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই ক্রমেই গণআন্দোলনে রূপ নেবে। ১০ দফাকে ‘সরকার পতনের এক দফা’ দাবিতে রূপান্তর করা হবে। সরকার পতনের মধ্যে বাকি ৯ দফার সমাধান রয়েছে। এজন্য দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশে দ্রুত সময়ের মধ্যেই যুগপৎ আন্দোলনের মধ্যদিয়ে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে চান নেতারা।
নতুন বছরের প্রথম থেকেই একের পর এক কর্মসূচি ঘোষণা ও বাস্তবায়ন করা হবে। এরইমধ্যে সরকারবিরোধী সমমনা দল ও জোটগুলোর সঙ্গে আন্দোলনের রূপরেখার ছক আঁকা হয়েছে। এই সময়ে শরিকদের নিয়ে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করা হবে। বিএনপি বলছে- সামনে নির্বাচন। তত্ত্বাবধায়ক কিংবা জাতীয় সরকার ছাড়া দেশে কোনো নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। এই সময়ে সরকারকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা হবে। জনগণকে নিয়েই গণঅভ্যুত্থান ঘটানো হবে। বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, সরকারের পতন ও নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলনের বিকল্প নেই। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলমান থাকবে। একটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। দেশের মানুষ সেই আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। জনগণকে সম্পৃক্ত করেই আমরা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে গণতন্ত্র উদ্ধার করবো।
তিনি বলেন, আমার বিভাগীয় সমাবেশে জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত অংশ নিয়েছে। লাখ লাখ মানুষ নানা বাধা, হামলা, মামলা উপেক্ষা করে বিএনপি’র সমাবেশে যোগ দিয়েছে। আমরা আগামী রাষ্ট্র মেরামতের ২৭ দফা ও যুগপৎ আন্দোলনের ১০ দফা নিয়ে দেশের মানুষকে বার্তা দিয়েছি। জনগণকে সম্পৃক্ত রেখেই চূড়ান্ত আন্দোলনের লক্ষ্যে পৌঁছাবো। বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আমরা গণতন্ত্র উদ্ধারের আন্দোলনে আছি। এজন্য ১০ দফা ঘোষণা করেছি। আমাদের আন্দোলন হবে যুগপৎভাবে। আন্দোলনের মধ্যদিয়েই ১০ দফা আদায় করবো। সেখানে সরকারের পদত্যাগ নিশ্চিত করে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করবো। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে আন্দোলনের গতি বাড়বে।
খুলনা গেজেট/ বিএমএস