খুলনা, বাংলাদেশ | ৫ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২০ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রক্টর নিয়োগ নিয়ে ছাত্রদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া
  ৭ দিনের জন্য আন্দোলন স্থগিত করেছেন তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা
  ইউনাইটেড হাসপাতালের চেয়ারম্যানসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা
  ৪০তম ব্যাচের ক্যাডেট এসআইদের সমাপনী কুচকাওয়াজ স্থগিত

নিরবে কেটে গেল বীরাঙ্গণা গুরুদাসীর মৃত্যুর এক যুগ!

পারভেজ মোহাম্মদ

বীরাঙ্গণা গুরুদাসী মন্ডলের শেষ বিদায়ের স্মৃতি কপিলমুনি আবাসস্থলটি এখন ময়লার স্তুপে ঢাকা পড়েছে।
বীরাঙ্গণা গুরুদাসী মন্ডলের শেষ বিদায়ের স্মৃতি কপিলমুনি আবাসস্থলটি এখন ময়লার স্তুপে ঢাকা পড়েছে।

কপিলমুনিতে সাজ সাজ রব। কপিলমুনি যুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্সের নির্মাণ কাজের উদ্বোধনে আসছেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের স্বয়ং মন্ত্রী। তোরণে তোরণে ভরে গেছে কপিলমুনি। সুসজ্জ্বিত মঞ্চ নির্মাণ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত কপিলমুনি সহচরী বিদ্যামন্দির মাঠে। হয়ত এমন স্বপ্নও ছিল বীর মুুক্তিযোদ্ধাদের। নতুন প্রজন্মের সকলে স্বাগত জানিয়েছে এই মহতী উদ্যোগকে। বেঁচে থাকলে এলোচুলে লাঠি হাতে যথারীতি মাতিয়ে রাখতেন সকলকে। প্রটোকল ভেঙ্গে নির্বিঘ্নে চলার এমন সাহস ছিল শুধু তারই। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বীরাঙ্গণা গুরুদাসী। সকলের মাসি আর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মা।

আজ ৮ ডিসেম্বর ছিল বীরাঙ্গণা গুরু দাসীর মৃত্যুর এক যুগ। কেউ মনে রাখেনি গুরুদাসীকে। তাইতো এই দিনটিতেও অবহেলা আর অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে বাড়িটি। তবে আশার কথা জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ। তিনি জানান, গুরুদাসীকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশের দাবি জানিয়ে স্থানীয় জনৈক এস এম মুস্তাফিজুর রহমানের আবেদন ও একটি আঞ্চলিক পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনকে আমলে নিয়ে গুরুদাসীকে এবারের গেজেটে নাম অর্ন্তভূক্ত বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হচ্ছে। গুরুদাসীকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে ছোট বেলা থেকে চিনি। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটে তার নাম অর্ন্তভূক্তি হলে সেটি হবে তার প্রতি আমার ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধা সম্মান দিয়ে গেজেট প্রকাশ হয়েছে। ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত গেজেটে তারা ২৭১ জন বীরাঙ্গনাকে সম্মান দিয়েছেন। শুরুটা ২০১৬ সালের ১২ অক্টোবর। এই দিন মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় ৪১ জন বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়ে প্রথম গেজেট প্রকাশ করে। যদিও এই তালিকায় নাম নেই মুক্তিযোদ্ধাদের ‘মা’ হিসেবে খ্যাত পাইকগাছার বীরাঙ্গনা গুরুদাসী মন্ডলের। রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণার অন্যতম অনুঘটক গুরুদাসী মন্ডলের আবাসস্থল পাইকগাছা উপজেলার কালীনগর গ্রামে। ১৯৭১ সাল, বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক ভূখন্ডের জন্মলগ্নে চলছে প্রচন্ড প্রসব বেদনা। ধাত্রি মাতারূপী লক্ষ বীরাঙ্গনার অন্যতম গুরুদাসী মন্ডল। তখন সুখের সংসার তার, স্বামী গুরুদাস মন্ডল, ছেলে অংশুপতি, খোকন, অঞ্জলি ও ছোট্ট শিশু মেয়ে পারুলকে নিয়ে। পেশায় দর্জি গুরুপদ। মোটা চালের দু’মুঠো ভাত, মোটা কাপড়ে বেশ যাচ্ছিল দিন। শুরু হল মুক্তিযোদ্ধা। বাড়ছে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর অত্যাচার। সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে অনেকেই। গুরুপদ মন্ডল তাদের একজন। সপরিবারে ভারতে আশ্রয় নিলেও গুরুদাসী মন্ডল জন্ম ভূমির টানে অস্থির। এক পর্যায়ে দেশে ফেরা। তখনও সুযোগ পেলেই চলে অত্যাচার। গুরুদাসীর ওপর নজর পড়ে বারোআড়িয়া ক্যাম্পের রাজাকারদের। নিজের সৌন্দর্য্য তখন শত্রুরূপে দেখা দিল। অপ্রতিরোধ্য এই বাহিনীর বেশির ভাগ সদস্যদের নিয়ন্ত্রনহীন পথ চলা। গুরুপদ মন্ডল তাদের আক্রশের শিকার। অপরাধ তিনি মুক্তি বাহিনী। পালাক্রমে নির্যাতনে কাতর গুরুপদর কাহিনী বর্ণনায় আজও শঙ্কিত হয় প্রত্যক্ষদর্শীরা।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, রাতভর নির্যাতনের পর সকালে জনসম্মুখে গুরুপদ মন্ডলকে অস্ত্রের মুখে নদীতে নামতে বাধ্য করে। একপর্যায়ে গুলি করে হত্যা করে গুরুদাসী মন্ডলের স্বামী গুরুপদ মন্ডলকে। এবার গুরুদাসী মন্ডলের ওপর চলে নির্যাতন। শারীরিক নির্যাতনের পর শুরু হয় নারীত্বের প্রবল অপমান। চোখের সামনে স্বামীকে মেরে অংশুপতি, খোকন আর পারুলকে মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে আছড়ে মারে। মৃত সন্তানদেরকে চোখের সামনে মাটিতে পুঁতে ফেলতে দেখে গুরুদাসী মন্ডল। প্রিয়জন হারাবার বেদনা, পাশবিক নির্যাতনে সম্ভ্রম হারাবার লজ্জায় পাগল প্রায় গুরুদাসী তবুও মুক্তি পায়নি এই নরপিচাশদের হাত থেকে। আদিম উম্মাদনায় খোরাক যোগাতে বহুরাত কাটাতে হয়েছে বারোআড়িয়া রাজাকার ক্যাম্পে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে বারোআড়িয়ার রাজাকার ক্যাম্প দখল করে মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে গুরুদাসীর দেখা মেলে রাজাকার ক্যাম্প দখলের পর। ভয়ংকর স্মৃতি চারণে বীরাঙ্গনা গুরুদাসী হয়ে ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের ‘মা’। এটি ছিল গুরুদাসীর জীবদ্দশায় সর্বোচ্চ সম্মান। ততক্ষণে গুরুদাসী মন্ডল হারিয়ে ফেলে মানসিক ভারসাম্য। স্বাধীনতার পর খুলনা বিভাগের মুজিব বাহিনীর প্রধান শেখ কামরুজ্জামান টুকু মানসিক হাসপাতাল, পাবনাতে ভর্তি করায় গুরুদাসী মন্ডলকে। আর কোন দিন পুরোপুরি সুস্থ হয়নি গুরুদাসী। ভয়ংকর স্মৃতি তাড়া করে ফিরেছে প্রতিদিন। হাতে লাঠি নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরে বেড়াতো গুরুদাসী। কখনও শহরে আবার কখনও গ্রামের পথ ধরে পাগল প্রায় নারীর পথচলা আজ শুধুই স্মৃতি।

‘সাপ-সাপ’ শব্দে ভয় দেখানো আর হঠাৎ পিঠে লাঠির আঘাতে আঁতকে ওঠা শুধুই গল্প। গুরুদাসী স্বাধীন দেশের মানুষের কাছে পাগলী মাসি, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ‘মা’। স্বাধীন দেশে যার প্রাপ্তি ছিল পাইকগাছার কপিলমুনি জাফর আউলিয়া সড়কের ধারে এক টুকরো সরকারী জমি আর মানুষটির থাকার ছোট্ট বাড়ি। যেখানে অভাবে, অনাদারে, অযত্নে কেটেছে বেশ কিছু দিন। মুক্তিযোদ্ধাদের অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি ছিল একটু আনন্দের। গুরুদাসীর পাশে থাকার চেষ্টাও ছিল তাদের। আজ গুরুদাসী নেই। ২০০৮ সালের ৮ ডিসেম্বর রাতের পর গুরুদাসী শুধুই স্মৃতি। তার স্মৃতি রক্ষায় ২০০৮ সালেই শেষ কৃত্যানুষ্ঠানে গুরুদাসী স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ গড়ে তোলা হয়েছে। সেদিনই তার বাড়িটিতে গুরুদাসী মন্ডল স্মৃতি যাদুঘর ও পাঠাগার হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা হয়েছিল। এর মধ্যে রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধারা শোষিত-বঞ্চিত, অপমানিতও। কিন্তু ১১ বছরেও গুরুদাসীর শেষ কৃত্যানুষ্ঠানে দেয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়নি। আক্ষেপ করে সাংবাদিকদের এমনটি জানান, বীর মুক্তিযোদ্ধা স ম বাবর আলী।

সরেজমিন গুরুদাসীর বসত ঘরটি দেখতে গেলে সেখানে গুরুদাসী মন্ডল স্মৃতি রক্ষা সাইন বোর্ডে অস্থিত্ব পাওয়া যায়নি। ভূতুড়ে বাড়িটির ভেতরে ময়লার স্তুপ। স্থানীয়দের অভিযোগ বীরাঙ্গনা গুরুদাসীর বসতভিটা এখন নেশাসক্তদের আড্ডাস্থল। গুরুদাসী মন্ডল বীর সন্তানের মা। মুক্তিযোদ্ধা সম্মানের গেজেটে তালিকায় তার নাম না থাকলেও বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশ নামক ভূখন্ড জন্মের প্রসব বেদনার নীরব স্বাক্ষী গুরুদাসী। তাইতো সৃষ্টিকর্তা শেষ বিদায়ের ডাকটিও দিয়েছেন এই বিজয়ের মাসেই। দেশের প্রতি গভীর ভালবাসার এটাই তার বিরল সম্মান। তাইতো জাতির জনকের জন্ম শত বার্ষিকী উদ্যাপন ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে আজ কপিলমুনি মুক্ত দিবস সরকারী ভাবে উদ্যাপিত হচ্ছে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ. ক. ম মোজাম্মেল হক (এমপি), খুলনা-৬ এর সংসদ সদস্য মোঃ আক্তারুজ্জামান বাবু, বিশেষ অতিথি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব শেখ ইউসুফ হারুন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ। স্থানীয়দের দাবি কপিলমুনি মুক্ত দিবসে এই অনুষ্ঠানেই গুরুদাসীর শেষ বিদায়ের স্মৃতি কপিলমুনি আবাসস্থলটিতে লাইব্রেরী নির্মাণের ঘোষণা ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ‘মা’’ গুরুদাসীর মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি।

 

খুলনা গেজেট /এমএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!