দুই মাসে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা, হামলা ও ধরপাকড় বেড়েছে। পুরনো মামলার বিচারে গতি বেড়েছে। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো মামলায় সাজা দেয়া হচ্ছে। অধিকাংশ মামলাই পুলিশের ওপর হামলা, কাজে বাধা, ককটেল বিস্ফোরণ, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও নাশকতার চেষ্টার অভিযোগে। এই মামলায় কেউ কেউ ছয় মাস থেকে ১০ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হচ্ছে। অনেকে কারাগারে থেকেই সাজার খরব শুনছেন। গত ৭ দিনে ঢাকার বিভিন্ন আদালতে অন্তত ৪টি মামলার সাজা দেয়া হয়েছে। সাজা পাওয়া বেশির ভাগই বিএনপি’র সাবেক এমপি ও অঙ্গসংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা। এমন অবস্থায় বিএনপি নেতাদের মামলা পরিচালনা করা আইনজীবীরা বলছেন, তারা যথাযথ আইনি সুযোগ পাচ্ছেন না। এমনকি গুম হওয়া ব্যক্তিদেরও সাজা দেয়া হয়েছে।
মৃত আসামিরও সাজা হয়েছে। এই আইনজীবীরা বলেন, রায়ের পরে মামলার নথি দেয়া হচ্ছে না। একমাস ঘুরেও নথি যোগাড় করতে পারেননি বলে অভিযোগ করেছেন তারা।
আদালত সূত্রে জানা যায়, গত দুই মাসে বিএনপি’র অন্তুত ৪৭৮ জন নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। অনেককে অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে। তবে গেল সপ্তাহের মাত্র ৩ দিনে ৩২১ জন নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার ১ দিনেই শতাধিক নেতাকর্মীকে সাজা দেয়া হয়। এছাড়া গত ২০শে নভেম্বর একদিনে বিএনপি’র শীর্ষ পাঁচ নেতাসহ ১৩৬ জনকে কারাদণ্ড দিয়েছিল আদালত।
রাজধানীর উত্তরা-পূর্ব থানা, লালবাগ থানা, পল্টন ও কোতোয়ালি থানার পৃথক চার মামলায় বিএনপি’র জাতীয় নির্বাহী কমিটির স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সহ-সম্পাদক আব্দুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল, বিএনপি’র উত্তর যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এসএম জাহাঙ্গীর, যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকারসহ ১৯৫ জনকে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। বৃহস্পতিবার ঢাকার পৃথক চারটি আদালত এ রায় ঘোষণা করেন। রাজধানীর উত্তরা-পূর্ব থানার মামলায় উত্তর যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এসএম জাহাঙ্গীরসহ ৭৫ জনের পৃথক তিন ধারায় আড়াই বছরের সাজা দিয়েছেন আদালত। ঢাকার অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট হাসিবুল হক এ রায় ঘোষণা করেন। রাজধানীর লালবাগ থানার মামলায় পৃথক দুই ধারায় বিএনপি’র ৫০ জন নেতাকর্মীর ৩ বছর ৩ মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। পাশাপাশি ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল ইসলাম এ রায় ঘোষণা করেন। বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় রাজধানীর কোতোয়ালি থানার মামলায় যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকারসহ ১২ জনের সাত বছরের সাজা দিয়েছেন আদালত। পাশাপাশি তাদের ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ছয় মাসের সাজা দেয়া হয়েছে। তবে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ৮ জনকে খালাস দেয়া হয়েছে। এছাড়া পল্টন থানার মামলায় ৩৫ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছেন আদালত।
এদিকে সম্প্রতি রায় হওয়া ৪টি মামলার সাজার ধরন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এসব মামলায় সাজার হার প্রায় ৯০ শতাংশ। এজহারনামীয় কোনো আসামিই কারাদণ্ড থেকে রেহাই পাননি। শুধুমাত্র অজ্ঞাতনামা ও সন্দেহভাজন কিছু আসামি খালাস পেয়েছেন।
বিএনপি’র সহ-আইন বিষয়ক সম্পাদক এডভোকেট জয়নুল আবেদীন মেসবাহ বলেন, বিভিন্ন সাজানো মামলায় সাজা দিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের ভয় দেখানো হচ্ছে। উচ্চ আদালত পুরনো মামলার বিচার শেষের নির্দেশনা দিলেও আদালত অন্য মামলা বাদ দিয়ে রাজনৈতিক মামলা বেছে নিয়েছেন। দ্রুত গতিতে মামলার বিচার কাজ শেষে করতে একদিন পরপর শুনানি হচ্ছে। টানা শুনানি হওয়ার নজিরও আছে। সাক্ষীদের ফোন করে ডেকে আনছে রাষ্ট্রপক্ষ। তিনি বলেন, রাতেও শুনানি হচ্ছে।
দ্রুত গতিতে সাজার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট মহসিন রশিদ বলেন, আমি শুনেছি, এসব মামলায় কোনো নিরপেক্ষ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়নি। পুলিশের সাক্ষ্য নিয়েই মামলার সাজা দেয়া হয়। এমনকি ফৌজদারি কার্যবিধিতে বর্ণিত বিচারিক স্তরগুলোও অনুসরণ করা হয়নি। ফলে যথাযথ বিচারিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই তড়িঘড়ি করে বিএনপি নেতাদের সাজা দেয়া হয়েছে। একটি কথা হলো, দেশে ফৌজদারি মামলার বিচার শেষে দেখা যায় আসামিদের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার মাত্র ২০ শতাংশ। আর ৮০ শতাংশ মামলাতেই আসামিরা খালাস পান। অথচ বিএনপি নেতাদের মামলায় ৯০ শতাংশ সাজা হচ্ছে। এটা একটি ইঙ্গিত বহন করে। বিচারে পুলিশ বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে সাক্ষী হাজির করেছে। রায়েও একটি বিশেষ উদ্দেশ্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী জেডআই খান পান্না বলেন, বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে যেভাবে সাজা হচ্ছে, এটা যদি সবসময় সব ক্রিমিনাল ও সব ব্যক্তির বেলায় হতো তাহলে খুশি হতাম। এমন গতি থাকলে দেশে কোনো জটই থাকতো না। একটি বিষয় পরিষ্কার তা হলো ট্রায়াল ছাড়া কাউকে সাজা দেয়ায় কোনো প্রবিশনই নাই। এককথায় জুডিশিয়ারিতে ট্রায়াল ছাড়া কেউ সাজা দিতে পারেন না।
এ পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত নেতাদের মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসনের এক উপদেষ্টা, একজন ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম মহাসচিব একজন, সম্পাদক ও সহ-সম্পাদক চারজন, নির্বাহী কমিটির সদস্য তিনজন, যুব ও স্বেচ্ছাসেবকদলের পাঁচ শীর্ষ নেতা এবং জেলা পর্যায়ের কয়েকজন সিনিয়র নেতা আছেন। সাজা হয়েছে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব (৪ বছরের সাজা), ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাজাহান (৪ বছরের সাজা) যুগ্মমহাসচিব হাবিব-উন- নবী খান সোহেল (২ মামলায় সাড়ে ৩ বছর), তথ্যবিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল (২ মামলায় সাড়ে ৩ বছর), স্বেচ্ছাসেবক-বিষয়ক সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপু (দেড় বছর), গ্রামসরকার-বিষয়ক সহ-সম্পাদক বেলাল আহমেদ (৪ বছরের সাজা), সহপ্রচার সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীম (৪ বছরের সাজা), নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ রবিউল আলম (আড়াই বছরের সাজা), হাবিবুর রশিদ (২ বছরের সাজা), আকরামুল হাসান (২ বছরের সাজা), যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরব (২ মামলায় সাড়ে ৪ বছরের সাজা), যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু (২ বছরের সাজা), স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান (২ বছরের সাজা), যুবদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি মামুন হাসান (৩ বছরের সাজা), সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকার (একাধিক মামলায় সাজা), রংপুর জেলা বিএনপি’র সদস্যসচিব আনিসুর রহমান লাকু (১০ বছরের সাজা) ও মহানগর বিএনপি’র সদস্য সচিব এডভোকেট মাহফুজ উন নবী ডন (১০ বছরের সাজা), রাজশাহী জেলা বিএনপি সভাপতি আবু সাঈদ চাঁদসহ যুবদল, ছাত্রদল এবং অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের অনেক নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। এছাড়া ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এসএম জাহাঙ্গীর, বিএনপি’র জাতীয় নির্বাহী কমিটির স্বেচ্ছাসেবক-বিষয়ক সহ-সম্পাদক আব্দুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল (ছয় বছর ৯ মাস), স্বেচ্ছাসেবকদলের সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসানকে সাজা দেয়া হয়েছে।