দেশে একসময় ব্যানার ও সাইনবোর্ড লেখার কাজ করতেন শৌখিন বা পেশাদার শিল্পীরাই। গ্রাম থেকে শহর সর্বত্রই চোখে পড়তো তাদের দোকান। কখনো দোকান আবার কখনো বা অন্য কোন দেয়ালে কাপড় টাঙ্গিয়ে রং তুলি দিয়ে ব্যানার লেখার দৃশ্য নিয়মিতই দেখা যেতো। সময়টা ডিজিটালের হওয়ায় মফস্বল থেকে শহর সর্বত্রই আর্টের দোকানের পরিবর্তে গড়ে উঠেছে ডিজিটাল সেন্টার। আর এভাবেই এখন বিলুপ্তির পথে রং তুলিতে ব্যানার লেখার চর্চা। তবুও রং তুলি দিয়েই দীর্ঘ তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে ইসমাইল হোসেন ধরে রেখেছেন বিলুপ্ত প্রায় হাতে লেখা ব্যানার, সাইনবোর্ড লিখন।
সেকালে কয়রায় আর্ট শেখার কোন সুযোগ ছিলনা। কিন্তু আর্ট তাকে ভীষণ টানতো। বড় সংসার হওয়ায় টানাপোড়েন সত্ত্বেও আর্ট শেখার আগ্রহ তার রয়ে যায়। আর্ট তাকে শিখতেই হবে। প্রায় ৪২ বছর আগে তিনি ছুটে যান সাতক্ষীরার কলারোয়ায় নিখিল কুমার অধিকারীর কাছে, যাকে তিনি গুরু বলেই ডাকেন।
১৯৮৩ সালে কয়রাকে থানা থেকে উপজেলায় রূপান্তরের পর সেখানে গড়ে উঠতে থাকে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি দপ্তর। প্রয়োজন পড়ে সেখানে যোগদান করা বিভিন্ন অফিসারগণের নাম লিপিবদ্ধকরণের । কিন্তু বোর্ডে তাদের নাম লিপিবদ্ধ করতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে যেতে হতো একশ’ কিলোমিটার দূরের জেলা শহর খুলনায়।
ইসমাইল হোসেন বিষয়টি ভেবে কয়রাবাসীর জন্য এটাকে অপমান মনে করলেন। সে বছরেই উপজেলা পরিষদের সামনে তিনি গড়ে তোলেন ‘বিউটি আর্ট’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
সেই থেকে সরকারি বেসরকারি দপ্তরগুলোর বেশির ভাগ কাজের জন্য ডাক পড়ে ইসমাইল হোসেনের। ৮৩’ পরবর্তী সময়ে থেকে উপজেলায় এমন কোন দপ্তর নেই যেখানে ইসমালের রং তুলির আচর পড়েনি।
সুন্দর হাতের লেখা শেখানোর কারিগর
বিউটি আর্টকে তিনি শুধু বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি উপলব্ধি করলেন স্কুল কলেজে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী রয়েছে। কিন্তু রেজাল্ট ভালো করলেও অধিকাংশ শিক্ষার্থীর হাতের লেখা খারাপ। এজন্য তারা অনেক জায়গায় পিছিয়ে পড়ে। ২০১৩ সালে তিনি পুরো উপজেলার স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের সুন্দর হাতের লেখা ও অংকন শেখানোর কাজে নেমে পড়লেন। যোগাযোগ করলেন স্কুল কর্তৃপক্ষের সাথে। কোথাও সামান্য পারিশ্রমিক, আবার কোথাও বিনা পারিশ্রমিকে সুন্দর হাতের লেখা শিখিয়েছেন ছাত্র-ছাত্রীদের।
কখনো শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতে নিজেই তাদের পুরস্কৃত করেন। স্কুলের বাহিরেও তার বাসায়ও অনেক শিক্ষার্থীরা ভীড় করে লেখা শিখতে। তবে করোনায় উপজেলাব্যাপী তার এ কর্মযজ্ঞ বন্ধ রয়েছে। তবে আবারও তিনি শুরু করতে চান।
ইসমাইল হোসেনের বয়স এখন ৬৩ বছর। বাকি জীবন কি করতে চান? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আর্ট শুধু আমার পেশা নয়, এটা আমার ভাললাগা ভালোবাসা। নীলকন্ঠ নামে আমার একজন ছাত্র রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে মুম্বাইয়ে কাজ করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মিজান আমার কাছে শিক্ষা নিয়েছে। এগুলো মনে হলে গর্বে আমার বুক ভরে যায়। বাকি জীবন এই শিল্পের মাধ্যমে আমি দেশ ও মানুষের সেবায় কাজ করে যেতে চাই। নতুন প্রজন্মকে সুন্দর হাতের লেখা শেখাতে চাই।
কালনা আমিনিয়িা বহুমুখী ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা ইউনুস আলী বলেন, ইসমাইল হোসেন খুবই সজ্জন ব্যক্তি। আমার প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন ধরে ছাত্র-ছাত্রীদের হাতের লেখা সুন্দর করার প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে বন্ধ রয়েছে ওনার কার্যক্রম।
ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, তিনি খুবই আন্তরিক মানুষ। বিনা বেতনেই তার কাছে শিখেছি। তার অমায়িক ব্যবহার মানুষকে মুগ্ধ করে। আমি তাকে এখনো স্যার বলেই সম্বোধন করি।
ইসমাইল হোসেন ৩৬ বছর ধরে জীবনের ধ্যান জ্ঞান হিসেবেই এই পেশাতেই আকড়ে আছেন। বিউটি আর্ট নামক প্রতিষ্ঠানটি তার সন্তানের মত। সেখানেই তিনি সৌন্দর্য্য ছড়িয়ে চলেছেন। ধরে রেখেছেন ডিজিটাল প্যানা, ফেস্টুন যুগে ঐতিহ্যবাহি রং তুলির কারুকাজ।