জাপানের ফার্মাসিউটিক্যাল জায়ান্ট তাকেদা ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির তৈরি ডেঙ্গুপ্রতিরোধী টিকা ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। ‘কিউদেঙ্গা’ নামের টিকাটি এরই মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন অনুমোদন দিয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাজ্য, আর্জেন্টিনা, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও ব্রাজিল এটি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জাপান আগেই এটির ব্যবহার শুরু করেছে।
টিকাটি দ্রুত বাংলাদেশে আনার কথা ভাবছে সরকার। বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, শুধু মশা মেরে ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব নয়, দ্রুতই টিকা প্রয়োগ শুরু করতে হবে।
অনুমোদন দেওয়ার পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, তাকেদার তৈরি ডেঙ্গুর টিকা শুধু ৬ থেকে ১৬ বছর বয়সীদের দেওয়া যাবে। এই বয়সী যারা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত অথবা যারা ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাস করে, তাদের টিকাটি দেওয়ার পরামর্শ দেয় ডব্লিউএইচও।
তাকেদার ডেঙ্গুর টিকা দুই ডোজের। প্রথম ডোজ নেওয়ার তিন মাস পর দ্বিতীয় ডোজ নিতে হবে। এটি ডেঙ্গুর দ্বিতীয় ধরনের (ভ্যারিয়েন্ট) জন্য তৈরি। তবে অন্য তিনটি ধরন প্রতিরোধেও কাজ করবে। ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র, পানামা ও ফিলিপাইনে এক হাজার ৮০০ তরুণ-তরুণীর ওপর এই টিকার পরীক্ষা চালানো হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ডেঙ্গুর চারটি ধরনের ক্ষেত্রেই ‘কিউদেঙ্গা’ চার পর্যন্ত সুরক্ষা দেয়। এই ফলাফলের পর এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার ২০ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবকের ওপর আরেকটি পরীক্ষা চালায় তাকেদা। এতে দেখা যায়, ভ্যাকসিনগ্রহীতাদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার হার অন্যদের তুলনায় ৮৪ শতাংশ কম এবং টিকাটি ৬১ শতাংশ পর্যন্ত রোগ প্রতিরোধ করে।
বাংলাদেশেও সম্প্রতি ডেঙ্গুর চারটি ধরনের উপযোগী টিকার পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ভার্মন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউভিএম) লার্নার কলেজ অব মেডিসিন। ‘টিভি-০০৫’ নামের টিকাটি এক ডোজের বলে জানিয়েছেন এর গবেষকরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পেলে ডেঙ্গুর এই টিকা দেশে ব্যবহার করা হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
আইসিডিডিআর,বি জানায়, ‘টিভি-০০৫’ টিকা শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের শরীরে প্রয়োগে নিরাপদ এবং এটি ডেঙ্গু প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরিতে সক্ষম।
১৯৯৭ সালে ফরাসি একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ও স্বাস্থ্যসেবা সংস্থা সানোফি ডেঙ্গুর টিকা নিয়ে কাজ শুরু করে। ২০১৫ সালে তাদের তৈরি টিকা ‘ডেঙ্গভ্যাক্সিয়া’ মেক্সিকোতে অনুমোদন পায়। এরপর ১৯টি দেশে সেটির ব্যবহার শুরু হয়। পরে সানোফির আরেক গবেষণায় দেখা যায়, কিছু ক্ষেত্রে ‘ডেঙ্গভ্যাক্সিয়া’ উল্টো কাজ করে। যেমন, যাদের ডেঙ্গু হয়নি তাদের টিকাটি দেওয়া হলে, তারা যদি কখনও ডেঙ্গু আক্রান্ত হন, তবে অসুস্থতা গুরুতর হতে পারে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী বলেন, ‘ডেঙ্গুপ্রবণ অনেক দেশে টিকার প্রয়োগ হচ্ছে। আবার ডেঙ্গু নেই– এমন দেশও টিকা নিচ্ছে। সুইডেনে অনেকে ব্যক্তি উদ্যোগে টিকা নিচ্ছেন। বাংলাদেশেও দ্রুত ডেঙ্গুর টিকা প্রয়োগ শুরু হওয়া দরকার।’
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, ‘যেহেতু তাকেদার টিকা ডব্লিউএইচও অনুমোদন দিয়েছে, দ্রুতই সেটি আমদানির অনুমোদন দিয়ে বাংলাদেশে সহজলভ্য করা উচিত। টিকা ডেঙ্গু রোগীর জটিলতা ও মৃত্যু কমাবে।’
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন ও সোসাইটি অব ভাইরোলজিস্টের পৃথক গবেষণায় উঠে এসেছে, এ বছর বাংলাদেশে ডেঙ্গুর দ্বিতীয় ধরনের প্রকোপ বেশি। ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, ‘তাকিদার টিকার ভালো দিক হলো, এটি ডেঙ্গুর দ্বিতীয় ধরন প্রতিরোধে কার্যকর। ডেঙ্গভ্যাক্সিয়ার চেয়ে দামেও কম। আরেকটি সুবিধা হলো, এই টিকার ক্ষেত্রে আগে ডেঙ্গু হয়েছে কিনা তা দেখার প্রয়োজন নেই।’ তার মতে, শুধু মশা মেরে ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব নয়। বাজারে এখন ডেঙ্গুর যে দুটি টিকা রয়েছে সে দুটি নিয়েই সরকারকে ভাবতে হবে। সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না।
এদিকে, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে একটি জরুরি বৈঠক হয়। অধিদপ্তরের ১৫ পরিচালক এতে অংশ নেন। বৈঠকে করোনা মহামারির সময়ের মতো ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে একটি জাতীয় পরামর্শক কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া ডেঙ্গুতে দ্রুত মৃত্যুর কারণ জানতে প্রতিটি হাসপাতালে পর্যালোচনা কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়। বৈঠকে, ডেঙ্গুর টিকা ‘কিউদেঙ্গা’ ও ‘টিভি-০০৫’ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। তবে আনার ব্যাপারে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাশার খুরশীদ আলম বলেন, ‘আমরা টিকার বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলোচনা করে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
খুলনা গেজেট/ টিএ